সকল প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য, যিনি আমাদেরকে সর্বোত্তম দীনের অনুসারী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উম্মত হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপর, যিনি আমাদেরকে কল্যাণকর সকল পথ বাতলে দিয়েছেন ও সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে সতর্ক করেছেন। আরও সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পরিবারবর্গ (আহলুল বাইয়াত) এবং উনার সাথীদের উপর, যারা তার আনীত দ্বীন ও আদর্শকে পরবর্তী উম্মতের নিকট যথাযথ ভাবে পৌঁছে দিয়েছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত যারা তাদের অনুসরণ করবে তাদের সবার উপর।
* মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেনঃ ‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল, একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্ত্বা ছাড়া। (সূরা আর-রাহমানঃ ২৬-২৭)
* তিনি আরও ইরশাদ করেনঃ “কুল্লু নাফসীন যা-য়িকাতুল মাওত”/ ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১৮৫)
* অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেনঃ ‘আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে। যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে, তখন তারা না এক মুহূর্ত পিছে যেতে পারবে, আর না এগিয়ে আসতে পারবে।’ (সূরা ইউনুসঃ ৪৯)
* আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ ‘আর মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র। তাঁর আগেও বহু রাসুল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন বা শহীদ হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুত কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাআলা তাদের সওয়াব দান করবেন।’ (আলে ইমরানঃ ১৪৪)
সুতরাং এই পৃথিবীর জাগতিক নিয়মানুসারে নবী রাসুলরাও মৃত্যুবরণ করবেন। কারণ আমরা মুসলিম’রা একান্তভাবেই বিশ্বাস করি সকল নবী রাসুলরাই যেহেতু মানুষ ছিলেন, সেহেতু তাঁদের মৃত্যু হওয়াই স্বাভাবিক। তবে নবী রাসুলদের এই স্বাধীনতা দেওয়া হয় যে, আপনি কী পৃথিবীতে থাকতে চান? না কী চলে যেতে চান। কিন্তু নবী-রাসুলরা আল্লাহর কাছে চলে যাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
* হযরত আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুস্থ অবস্থায় বলতেন যে, কোন নবীর (জান) কবয করা হয় না, যতক্ষণ না তাকে জান্নাতে তার স্থান দেখানো হয় আর তাকে (জীবন অথবা মৃত্যুর) যেকোন একটা বেছে নেয়ার অধিকার না দেয়া হয়। (সহী বুখারি, হাদিস নাম্বারঃ ৬৫০৯/আংশিক)
পবিত্র সূরা নাসর (মাক্কী সূরা নাম্বারঃ ১১০) নাযিল হওয়ার পর থেকেই আল্লাহর রাসূল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুনিয়া থেকে বিদায়ের আশংকা করছিলেন। যেহেতু তিনিই শেষনবী এবং বিশ্বনবী, তাই মানবজাতীর জন্য শুধুমাত্র জান্নাতের সুসংবাদদাতা বা জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে নয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের বাস্তব রূপকার হিসাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটা আদর্শসমাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাওয়াও তার এইপৃথিবীতে আসার অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই হিসেবে মক্কা-মদিনাতে একটা সুন্দর মুসলিম মডেল সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামো নির্মাণের কাজ তিনি ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছেন। ভবিষ্যতে তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী খলীফাগণ উক্ত কাঠামোর উপর ভিত্তি করে আরও সুন্দরভাবে ইসলামী খেলাফত ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন, এই আশা রেখেই তিনি তার উম্মতদের’কে ডেকে বললেনঃ َعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ ‘তোমাদের উপরে অবশ্য পালনীয় হ’ল আমার সুন্নাত ও সুপথ প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত’। (তিরমিযী হাদীস নাম্বারঃ ২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হাদীস নাম্বারঃ ৪৩; মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ১৬৫)। এর মধ্যেই তিনি ঘোষনা দিলেন হজ্জ্বে যাবেন এবং তিনি উম্মতদের সামর্থ্যবান সবাইকে শেষবারের মত একবার তার সাথে হজ্জ্বে পেতে চান ও দেখতে চান। এই ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে চারদিকে আবেগের ঢেউ উঠে গেল। দলে দলে লোক মক্কা অভিমুখে ছুটলো। মদীনা ও আশপাশের লোকেরা তার সাথী হলেন হজ্জ্বে। এই ব্যস্তসময়েও আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে কোন শৈথিল্য দেখান নি। মু‘আয বিন জাবাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু)’কে ইয়ামনের গভর্ণর নিয়োগ দিয়ে পাঠালেন এবং তাকে প্রয়োজনীয় সমস্ত দিক নির্দেশনা শেষে বললেন:
مُعَاذُ، إِنَّكَ عَسَى أَنْ لاَ تَلْقَانِيْ بَعْدَ عَامِيْ هَذَا، وَلَعَلَّكَ أَنْ تَمُرَّ بِمَسْجِدِيْ وَقَبْرِيْ
‘হে মু‘আয! এইবছরের পরে তোমার সঙ্গে আমার হয়তো আর সাক্ষাত নাও হতে পারে। তখন হয়তো তুমি আমার এই মসজিদ ও কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে। মৃত রাসূলের কবর যেয়ারতে হয়তো তোমরা আসবে’ (আহমাদ হাদীস নাম্বারঃ ২২১০৭, ছহীহাহ হাদীস নাম্বারঃ ২৪৯৭)।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মুখে এই কথা শুনে ভক্ত সাহাবী মু‘আয রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বিচ্ছেদ ব্যথায় হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
আরাফাতের ময়দানে প্রথম ভাষনঃ
৯ যিলহাজ্জ শুক্রবার সকালে তিনি মিনা হ’তে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ওয়াদিয়ে নামেরাহ’তে (وادي نمرة) অবতরণ করেন। যার একপাশে আরাফাত ও অন্যপাশে মুযদালিফাহ অবস্থিত। অতঃপর সূর্য ঢলে পড়লে তিনি ক্বাছওয়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আরাফাত ময়দানের বাতনে ওয়াদীতে (بطن الوادي) আগমন করলেন। এটি ছিল একটি পাহাড়ী টিলা। যা জাবালে রহমত (جبل الرحمة) বলে খ্যাত। তার উপরে উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় তিনি সম্মুখে উপস্থিত মুসলিমদের উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দেন। আরাফাতের ময়দানের উক্ত ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেনঃ
أَيّهَا النَّاسُ اسْمَعُوْا قَوْلِيْ، فَإِنِّيْ لَا أَدْرِيْ لَعَلِّيْ لاَ أَلْقَاكُمْ بَعْدَ عَامِيْ هَذَا بِهَذَا الْمَوْقِفِ أَبَدًا-
(১) ‘হে জনগণ! তোমরা আমার কথা শোন! কারণ আমি জানি না এরপর আর কোনদিন তোমাদের সঙ্গে এই স্থানে মিলিত হ’তে পারব কি না’। (সূত্র ১)
َإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِيْ شَهْرِكُمْ هَذَا، فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا،
(২) ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও মাল-সম্পদ, তোমাদের পরস্পরের উপরে এমনভাবে হারাম, যেমনভাবে তোমাদের আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)।
أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَىَّ مَوْضُوْعٌ وَدِمَاءُ الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعَةٌ وَإِنَّ أَوَّلَ دَمٍ أَضَعُ مِنْ دِمَائِنَا دَمُ ابْنِ رَبِيعَةَ بْنِ الْحَارِثِ كَانَ مُسْتَرْضِعًا فِى بَنِى سَعْدٍ فَقَتَلَتْهُ هُذَيْلٌ-
(৩) ‘শুনে রাখ, জাহেলী যুগের সকল কিছু আমার পায়ের তলে পিষ্ট হ’ল। জাহেলী যুগের সকল রক্তের দাবী পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের রক্ত সমূহের প্রথম যে রক্তের দাবী আমি পরিত্যাগ করছি, সেটি হ’ল রাবী‘আহ ইবনুল হারেছ-এর শিশু পুত্রের রক্ত; যে তখন বনু সা‘দ গোত্রে দুগ্ধ পান করছিল, আর হোযায়েল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল’।
وَرِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعٌ وَأَوَّلُ رِبًا أَضَعُ رِبَانَا رِبَا عَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَإِنَّهُ مَوْضُوْعٌ كُلُّهُ-
(৪) ‘জাহেলী যুগের সূদ পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের সূদ সমূহের প্রথম যে সূদ আমি শেষ করে দিচ্ছি সেটা হ’ল আব্বাস ইবনু আবদিল মুত্ত্বালিবের পাওনা সূদ। সূদের সকল প্রকার কারবার সম্পূর্ণরূপে শেষ করে দেওয়া হ’ল’।
فَاتَّقُوا اللهَ فِى النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوْهُنَّ بِأَمَانِ اللهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوْجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللهِ وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لاَّ يُوْطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُوْنَهُ. فَإِنْ فَعَلْنَ ذَلِكَ فَاضْرِبُوْهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ-
(৫) ‘তোমরা মহিলাদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে তাদেরকে হালাল করেছ’।
وَقَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابَ اللهِ.
(৬) ‘আর জেনে রাখ, আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি এমন এক বস্ত্ত, যা মজবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আর সেটি হলো আল্লাহর কেতাব’। (সূত্র ২)
أَيُّهَا النَّاسُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِيْ، وَلاَ أُمَّةَ بَعْدَكُمْ؛ فَاعْبُدُوْا رَبَّكُمْ، وَأقِيْمُوْا خَمْسَكُمْ، وَصُوْمُوْا شَهْرَكُمْ، وَأعْطُوْا زَكَاتِكُمْ، وَأطِيْعُوْا وُلاَةَ أَمْرِكُمْ؛ تَدْخُلُوْا جَنَّةَ رَبِّكُمْ-
(৭) ‘হে জনগণ! শুনে রাখ আমার পরে কোন নবী নেই এবং তোমাদের পরে আর কোন উম্মাতও নেই। অতএব তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর, রামাযান মাসের ছিয়াম রাখো, সন্তুষ্ট চিত্তে তোমাদের মালের যাকাত দাও, তোমাদের প্রভুর গৃহে হজ্জ কর, তোমাদের শাসকদের আনুগত্য কর, তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ কর’। (সূত্র ৩)
وَأَنْتُمْ تُسْأَلُوْنَ عَنِّىْ فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُوْنَ. قَالُوْا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ. فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ، اللَّهُمَّ اشْهَدِ اللَّهُمَّ اشْهَدْ. ثَلاَثَ مَرَّاتٍ-
(৮) আর তোমরা আমার সম্পর্কে যখন জিজ্ঞাসিত হবে, তখন তোমরা কি বলবে?
লোকেরা বলল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি সবকিছু পৌছে দিয়েছেন, দাওয়াতের হক আদায় করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন’।
অতঃপর তিনি শাহাদাত আঙ্গুলি আসমানের দিকে উঁচু করে ও সমবেত জনমন্ডলীর দিকে নীচু করে তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক’। (সূত্র ৪)
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এই ভাষণ উচ্চকণ্ঠে জনগণকে শুনাচ্ছিলেন রাবী‘আহ বিন উমাইয়া বিন খালফ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা! মক্কায় হযরত বেলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর উপরে লোমহর্ষক নির্যাতনকারী, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ১৪ নেতার অন্যতম নিকৃষ্টতম নেতা ও বদর যুদ্ধে নিহত উমাইয়ার ছেলে আজ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পাশে দাড়ানো সাহাবী। তিনি উচ্চকন্ঠে এই ভাষন শুনাচ্ছেন বাকি সবাই’কে! (সূত্র ৫)
মর্মস্পর্শী বিদায়ী এই ভাষণ শেষে জনগণের নিকট থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ এবং আল্লাহকে সাক্ষী রাখার এই অনন্য মুহূর্তের পরপরই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয় এক ঐতিহাসিক দলীল, ইসলামের সম্পূর্ণতার সনদ, যা ইতিপূর্বে নাযিলকৃত কোন ইলাহী ধর্মের জন্য নাযিল হয়নি। এই পরিপূর্ণতা একমাত্র ইসলাম’কে দেয়া হয়েছে। পবিত্র ওহী নাযিল হলো-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِيْناً-
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপরে আমার নেয়ামত’কে পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (সূরা মায়েদাহ ৫/৩)।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মুখে এই আয়াত শ্রবণ করে হযরত ওমর ফারূক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কেঁদে উঠলেন। তার কেঁদে ফেলার কারণ জিজ্ঞেস করলে এর উত্তরে তিনি বললেন, إِنَّهُ لَيْسَ بَعْدَ الْكَمَالِ إِلاَّ النُّقْصَانُ ‘পূর্ণতার পরে তো কেবল ঘাটতিই এসে থাকে’
৬)। এই আয়াত নাযিলের পর সত্যই আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অল্প কিছুদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন।
[এই আয়াত প্রসঙ্গে জনৈক ইহুদী পন্ডিত হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু)’কে বলেন, যদি এরূপ আয়াত আমাদের উপরে নাযিল হতো, তাহলে আমরা ঐ দিনটিকে ঈদের দিন হিসাবে উদযাপন করতাম’। এর উত্তরে ইবন আববাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা ঐদিন একটি নয়, বরং দু’টি ঈদ একসঙ্গে উদযাপন করেছিলাম। (১) ঐদিন ছিল শুক্রবার, যা আমাদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন (২) ঐদিন ছিল ৯ই যিলহাজ্জ আরাফাহর দিন। যা হ’ল উম্মতের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে বার্ষিক ঈদের দিন’ (সূত্র ৭)]
মিনায় দ্বিতীয় ভাষনঃ
সুনানে আবু দাঊদের বর্ণনা অনুসারে ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন সকালে সূর্য উপরে উঠলে (حين ارتفع الضحى) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি সাদা-কালো মিশ্রিত খচ্চরে (بغلة شهباء) সওয়ার হয়ে (কংকর নিক্ষেপের পর) জামরায়ে আক্বাবায় এক ভাষণ দেন। এমতাবস্থায় লোকদের কেউ দাঁড়িয়েছিল কেউ বসেছিল। হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর ভাষণ লোকদের শুনাচ্ছিলেন। এইদিনের ভাষণে তিনি আগেরদিন আরাফাতের ময়দানে দেওয়া ভাষণের কিছু কিছু অংশ আবারও বলেন (সূত্র ৮)। সহী মুসলিম শরীফে আবু বাকরাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এদিনে তিনি ঘোষনা করেনঃ-
لِتَأْخُذُوا مَنَاسِكَكُمْ فَإِنِّى لاَ أَدْرِى لَعَلِّى لاَّ أَحُجُّ بَعْدَ حَجَّتِى هَذِهِ
(১) হে জনগণ! তোমরা আমার নিকটে থেকে হজ্জ ও কুরবানীর নিয়ম-কানূন শিখে নাও। সম্ভবতঃ আমি এ বছরের পর আর হজ্জ করতে পারব না’। (সূত্র ৯)
তিনি আরও বলেনঃ
وَسَتَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ فَيَسْأَلُكُمْ عَنْ أَعْمَالِكُمْ، أَلاَ فَلاَ تَرْجِعُوْا بَعْدِى ضُلاَّلاً، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ-
(২) ‘সত্বর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সাবধান! আমার পরে তোমরা পুনরায় ভ্রষ্টতার দিকে ফিরে যেয়ো না এবং একে অপরের গর্দান মেরো না’।
أَلاَ هَلْ بَلَّغْتُ؟ قَالُوْا نَعَمْ. قَالَ اللَّهُمَّ اشْهَدْ، فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ، فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ-
(৩) ‘ওহে জনগণ! আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? লোকেরা বলল, হাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতগণকে কথাগুলি পৌঁছে দেয়। কেননা উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকের চাইতে অনুপস্থিত যাদের কাছে এগুলি পৌঁছানো হবে, তাদের মধ্যে অনেকে অধিক বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছে’ (সূত্র ১০)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, উক্ত ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেছিলেন,
أَلاَ لاَ يَجْنِى جَانٍ إِلاَّ عَلَى نَفْسِهِ لاَ يَجْنِى وَالِدٌ عَلَى وَلَدِهِ وَلاَ مَوْلُوْدٌ عَلَى وَالِدِهِ-
(৪) ‘মনে রেখ, অপরাধের শাস্তি অপরাধী ব্যতীত অন্যের উপরে বর্তাবে না। মনে রেখ, পিতার অপরাধের শাস্তি পুত্রের উপরে এবং পুত্রের অপরাধের শাস্তি পিতার উপরে বর্তাবে না’।
أَلاَ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ مِنْ أَنْ يُعْبَدَ فِى بِلاَدِكُمْ هَذِهِ أَبَدًا وَلَكِنْ سَتَكُونُ لَهُ طَاعَةٌ فِيمَا تَحْتَقِرُونَ مِنْ أَعْمَالِكُمْ فَسَيَرْضَى بِهِ-
(৫) মনে রেখ, শয়তান তোমাদের এই শহরে পূজা পাওয়া থেকে চিরদিনের মত নিরাশ হয়ে গেছে। তবে যেসব কাজগুলিকে তোমরা তুচ্ছ মনে কর, সেসব কাজে তার আনুগত্য করা হবে, আর তাতেই সে খুশী থাকবে’। (সূত্র ১১)
১১ হিজরীর ছফর মাসের প্রথম দিকে অর্থাৎ মৃত্যুর মাসখানেক পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওহোদ প্রান্তে ‘শোহাদা কবরস্থানে’ গমন করেন এবং তাদের জন্য এমনভাবে দো‘আ করেন যেন তিনি জীবিত ও মৃত সকলের নিকট থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করছেন। দো‘আর শেষে তিনি বলেন, وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلاَحِقُوْنَ ‘আল্লাহ চাহেন তো নিশ্চয়ই সত্বর আমরা তোমাদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি’। (সূত্র ১২)
ওহোদের শোহাদা কবরস্থান যেয়ারত শেষে মদীনায় ফিরে এসে মসজিদে নববীতে মিম্বরে বসে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, إِنِّى فَرَطٌ لَكُمْ، وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ، إنَّ مَوْعِدَكُمُ الْحَوْضُ وَإِنِّىْ وَاللهِ لأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِى الآنَ، وَإِنِّىْ أُعْطِيْتُ مَفَاتِيْحَ خَزَائِنِ الأَرْضِ، أَوْ مَفَاتِيْحَ الأَرْضِ، وَإِنِّىْ وَاللهِ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوْا بَعْدِى، وَلَكِنِّى أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنَافَسُوْا فِيْهَا وزاد بعضهم: فَتَقْتَتَلُوْا فَتُهْلِكُوْا كَمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبلَكُمْ- ‘আমি তোমাদের আগেই চলে যাচ্ছি এবং আমি তোমাদের উপরে সাক্ষ্য দানকারী। আর তোমাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হবে হাউয কাওছারে! আমি এখুনি আমার ‘হাউয কাওছার’ দেখতে পাচ্ছি। আমাকে পৃথিবীর সম্পদরাজির চাবিসমূহ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমার এ ভয় নেই যে, আমার পরে তোমরা শিরকে লিপ্ত হবে। কিন্তু আমার আশংকা হয় যে, তোমরা দুনিয়া অর্জনে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর তোমরা পরস্পরে লড়াই করবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন তোমাদের পূর্বের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে’। রাবী ওক্ববা বিন আমের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আট বছর পরে (অর্থাৎ ওহোদ যুদ্ধের পরে) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই যেয়ারত করেন মৃতদের নিকট থেকে জীবিতদের বিদায় গ্রহণকারীর ন্যায় (كالمودَّع للأحياء والأموات) (সূত্র ১৩)
এরপর একদিন শেষরাতে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদে নববীর অদূরে বাক্বী‘ গোরস্থানে গমন করেন এবং তাদেরকে সালাম দিয়ে দো‘আ করেন। দো‘আ শেষে তিনি বলেন, إِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلاَحِقُوْنَ ‘আল্লাহ চাহেন তো সত্বর আমরা তোমাদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি’। এর মাধ্যমে তিনি যেন কবরবাসীদেরকে তাঁর সত্বর আগমনের সুসংবাদ শুনালেন। (সূত্র ১৪)
অসুস্থতার সূচনাঃ
হিজরী ১১, সোমবার, ২৯ সফর। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল-বাকী গোরস্থানে জানাযার নামাযে অংশগ্রহণ শেষে ফেরার পথেই সুতীব্র মাথাব্যথা অনুভব করতে শুরু করলেন, গায়ের তাপমাত্রা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে গেল। আবু সাঈদ খুদরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তাঁর মাথার কাপড়ের উপর দিয়েও শরীরের উত্তাপ অনুভূত হচ্ছিল। দেহ এত গরম ছিল যে, হাত পুড়ে যাচ্ছিল। এতে আমি বিস্ময়বোধ করলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, إِنَّا كَذَلِكَ يُضَعَّفُ لَنَا الْبَلاَءُ وَيُضَعَّفُ لَنَا الأَجْرُ ‘নবীগণের চাইতে কষ্ট কারও বেশী হয় না। এজন্য তাদের পুরস্কারও বেশী হয়ে থাকে’। তারপরও উনি এই অসুস্থ অবস্থায় আরও এগারো দিন নামাযে ইমামতী করে গেলেন। কিন্তু অসুস্থতা ধীরে ধীরে অনেক বেড়ে গেল। এভাবে প্রায় তের বা চৌদ্দ দিন উনি অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন।
জীবনের শেষ সপ্তাহঃ
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শারীরিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। এইসময় তিনি বারবার তার সব স্ত্রীদের জিজ্ঞেস করতে থাকেন,َيْنَ أَنَا غَدًا أَيْنَ أَنَا غَدًا ‘আগামীকাল আমি কোথায় থাকব? আগামীকাল আমি কোথায় থাকব’? তারা উনার এইকথার তাৎপর্য বুঝতে পেরে বললেন, ‘আপনি যেখানে খুশী থাকতে পারেন’। তখন তিনি আয়েশার গৃহে গমন করেন। এই সময় তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। ফযল বিন আববাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ও আলী ইবন আবী তালেব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর কাঁধে ভর করে অতিকষ্টে তিনি পা টিপেটিপে হাঁটছিলেন (تخط قدماه)। অতঃপর তিনি আয়েশার কক্ষে প্রবেশ করেন এবং জীবনের শেষ সপ্তাহটি সেখানেই তিনি অতিবাহিত করেন।
অন্যসময় আয়েশা (রাদিল্লাহু আনহু) সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস এবং অন্যান্য দো‘আ যা তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট থেকে শিখেছিলেন, সেগুলি পাঠ করে ফুঁক দিয়ে বরকতের আশায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাত তাঁর দেহে বুলিয়ে দিতেন। এবারো তিনি সেটাই করতে চাইলেন। কিন্তু নিজের হাত টেনে নিয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِىْ وَارْحَمْنِىْ وَأَلْحِقْنِىْ بِالرَّفِيْقِ الأَعْلَى ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমাকে রহম কর ও আমাকে সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত কর’।
মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বেঃ
জীবনের শেষ বুধবার। সেইদিন তাঁর দেহের উত্তাপ ও মাথাব্যথা খুব বৃদ্ধি পায়। তাতে তিনি বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়তে থাকেন। এ অবস্থায় তিনি বললেন, তোমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি এনে আমার উপরে সাত মশক পানি ঢাল। যাতে আমি বাইরে যেতে পারি এবং লোকদের উপদেশ দিতে পারি। সেইভাবে পানি ঢালা হলে উনি সুস্থবোধ করলে বলতে থাকেনঃ حَسْبُكُمْ حَسْبُكُمْ ‘ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও’। একটু হালকা বোধ করায় তিনি মাথায় পট্টি বাঁধা অবস্থায় যোহরের প্রাক্কালে মসজিদে প্রবেশ করেন। এইদিন বের হবার মূল কারণ ছিল আনছারদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখা।
চাদরের একপ্রান্ত মাথায় বাঁধা অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ও মিম্বরে আরোহন করেন। এদিনের পর তিনি আর মিম্বরে আর কোনদিন আরোহন করেন নি। মসজিদের মিম্বরে বসে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেনঃ
إِنِّىْ أَبْرَأُ إِلَى اللهِ أَنْ يَكُونَ لِى مِنْكُمْ خَلِيْلٌ فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَدِ اتَّخَذَنِىْ خَلِيْلاً كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ خَلِيْلاً وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا مِنْ أُمَّتِىْ خَلِيْلاً لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيْلاً، لَكِنَّهُ أَخِيْ وَ صَاحِبِيْ، إنَّ مِنْ أَمَنِّ النَّاسِ عَلَيَّ فِيْ صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُوْ بَكْرٍ وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوْا يَتَّخِذُوْنَ قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيْهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُوْرَ مَسَاجِدَ، إنِّيْ أنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ-
(১) ‘আমি আল্লাহর নিকট দায়মুক্ত এজন্য যে, তিনি আমাকে তোমাদের মধ্যে কাউকে ‘বন্ধু’ (خليل) হিসাবে গ্রহণ করার অনুমতি দেননি। কেননা আল্লাহ আমাকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। যেভাবে তিনি ইবরাহীমকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে যদি আমি আমার উম্মতের মধ্যে কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহলে আবুবকরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম। বরং তিনি আমার ভাই ও সাথী। লোকদের মধ্যে নিজের মাল-সম্পদ ও সাহচর্য দ্বারা আমার প্রতি সর্বাধিক সহমর্মিতা দেখিয়েছেন আবুবকর। মনে রেখ, তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা তাদের নবী ও নেককার লোকদের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছিল। তোমরা যেন এরূপ করো না’। আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি’।
(২) আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ইতিপূর্বে তিনি রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেন, لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ ‘ইহুদী-নাছারাদের উপরে আল্লাহ্ লা‘নত হৌক! তারা তাদের নবীগণের কবরসমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে’।
(৩) তিনি আরও বলেন, لاَ تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ ‘তোমরা আমার কবরকে মূর্তি বানিয়ে ফেলো না, যাকে পূজা করা হয়’।
(৪) এরপর মসজিদের ভাষণে তিনি বলেন, اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ ‘ঐ কওমের উপরে আল্লাহর প্রচন্ড ক্রোধ রয়েছে, যারা নবীগণের কবরসমূহকে সিজদাহর স্থানে পরিণত করেছে। তিনি বলেন, إِنِّيْ أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ، اَللََّهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ قَالَ اللََّهُمَّ اشْهَدْ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ- ‘আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি’। দেখো, আমি কি তোমাদেরকে পৌঁছে দিলাম’? হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক’। হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক’। প্রত্যেক কথাই তিনি তিনবার করে বলেন’।
(৫) এরপর তিনি আনছারদের উচ্চ মর্যাদা বিষয়ে অছিয়ত করে তিনি বলেনঃ أُوْصِيْكُمْ بِالأَنْصَارِ، فَإِنَّهُمْ كَرِشِى وَعَيْبَتِى، وَقَدْ قَضَوُا الَّذِى عَلَيْهِمْ، وَبَقِىَ الَّذِى لَهُمْ، فَاقْبَلُوْا مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَتَجَاوَزُوْا عَنْ مُسِيْئِهِمْ- ‘আমি তোমাদেরকে আনছারদের বিষয়ে অছিয়ত করে যাচ্ছি। তারা আমার বিশ্বস্ত ও অন্তরঙ্গ। তারা তাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেছে। কিন্তু তাদের প্রাপ্য বাকী রয়েছে। অতএব তোমরা তাদের উত্তমগুলি গ্রহণ কর এবং মন্দগুলি ক্ষমা করে দিয়ো’।
(৬) এরপর তিনি বললেনঃ إِنَّ عَبْدًا خَيَّرَهُ اللهُ بَيْنَ أَنْ يُؤْتِيَهُ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا مَا شَاءَ، وَبَيْنَ مَا عِنْدَهُ، فَاخْتَارَ مَا عِنْدَهُ ‘একজন বান্দাকে আল্লাহ এখতিয়ার দিয়েছেন যে, সে চাইলে দুনিয়ার জাঁকজমক সবকিছু তাকে দেওয়া হবে অথবা আল্লাহর নিকটে যা আছে তা সে গ্রহণ করবে। অতঃপর সে বান্দা সেটাকেই পছন্দ করেছে, যা আল্লাহর নিকটে রয়েছে’। এইকথার তাৎপর্য বুঝতে পেরে আবুবকর (রাদিয়ালাহু আনহু) কেঁদে উঠে বললেন, فَدَيْنَاكَ بِآبَائِنَا وَأُمَّهَاتِنَا ‘আমাদের পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হৌক’/ অন্য আরেকটা বর্ণনায় এসেছে, وَأَنْفُسِنَا وَأَمْوَالِنَا ‘আমাদের জীবন ও সম্পদ’। উপস্থিত সবাই এতে আশ্চর্য হয়ে গেল কিন্তু কেউ বুঝতে পারলো না। কিন্তু মহানবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওফাতের পর সবাই সেদিন তার কান্নার অর্থ বুঝতে পেরে বলল, وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ هُوَ أَعْلَمُنَا ‘আবুবকরই ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি’।
এই পর্ব এখানেই শেষ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওফাতের ঘটনাগুলি নিয়ে অনেক অজানা বিষয় আছে দেখে বেশ বিস্তারিত ভাবেই লিখেছি। এই লেখার যেখানে যেখানে দরকার সেখানেই প্রয়োজনীয় সূত্র উল্লেখ করেছি। বাদ বাকি অংশগুলি মূলত দুইটা বই থেকে বঙ্গানুবাদ করে লেখা হয়েছেঃ
১) Sirat Ibn Hisham: Biography of the Prophet (SAW) by Ibn Hisham
২) The Life of Muhammad (SAW) by Ibn Ishaq (Author), A. Guillaume (Translator)
[সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওফাতকালীন ঘটনাসমূহ নিয়ে ব্লগে বিভিন্ন অসর্ম্পূণ এবং বানোয়াট কিছু লেখা দেখতে পাওয়া যায়। না জেনে কিংবা ইচ্ছেকৃত ভাবে ইসলাম ধর্ম’কে হেয় করার জন্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নবী এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওফাতের সময়কালে বিভিন্ন ঘটনাগুলি বিকৃতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন পোস্টে মন্তব্য এবং প্রতিমন্তব্য দেবার সময় মনে হয়েছে এই বিষয়ে একটা বিস্তারিত পোস্ট দরকার। এরপর শ্রদ্ধেয় ব্লগার এবং সুপ্রিয় হাসান কালবৈশাখি ভাই আমাকে অনুরোধ করেন এই বিষয়ে লেখার জন্য। কিছুদিন আগে শুরু করলেও প্রয়োজনীয় সব তথ্য এবং উপাত্ত যোগাড় করতে যেয়ে দেরী হবার জন্য আমি লজ্জিত]।
লেখার জন্য প্রয়োজনীয় সহী সূত্র সমূহঃ
সূত্র ১ - দারেমী হাদীস নাম্বারঃ ২২৭, ফিক্বহুস সীরাহ পৃষ্ঠা ৪৫৬।
সূত্র ২ - মুসলিম হাদীস নাম্বারঃ ১২১৮, মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ২৫৫৫।
সূত্র ৩ - ত্বাবারাণী, আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ৫৭১; সিলসিলা ছহীহাহ হাদীস নাম্বারঃ ৩২৩৩।
সূত্র ৪ - মুসলিম, মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ২৫৫৫।
সূত্র ৫ - সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৬০৫।
সূত্র ৬ - আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪৬০; আল-বিদায়াহ ৫/২১৫।
সূত্র ৭ - তিরমিযী হাদীস নাম্বারঃ ৩০৪৪।
সূত্র ৮ - আবুদাঊদ, মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ২৬৭১।
সূত্র ৯ - মুসলিম শরীফ, মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ২৬১৮।
সূত্র ১০ - বুখারী হাদীস নাম্বারঃ ১৭৪১ ‘মিনায় ভাষণ’ অনুচ্ছেদ; মুত্তাফাক্ব আলাইহি মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ২৬৫৯।
সূত্র ১১ - তিরমিযী হাদীস নাম্বারঃ ২১৫৯; ইবনু মাজাহ হাদীস নাম্বারঃ ২৭৭১ ‘হজ্জ’ অধ্যায়; মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ২৬৭০।
সূত্র ১২ - মুসলিম হাদীস নাম্বারঃ ৪২৪৯, মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ১৭৬৪।
সূত্র ১৩ - মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ৫৯৫৮; বুখারী হাদীস নাম্বারঃ ১৩৪৪; মুসলিম হাদীস নাম্বারঃ ২২৯৬।
সূত্র ১৪ - মুসলিম হাদীস নাম্বারঃ ৯৮৪, মিশকাত হাদীস নাম্বারঃ ১৭৬৬ ‘জানায়েয’ অধ্যায়।
সূত্র ১৫ - Click This Link
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:৫৬