কেবলই ভোর হয়েছে…
ঘন ঘন কয়েকটা হুইসেল দিয়ে আন্তঃনগর এক্সপ্রেসের একটা ট্রেন ময়মনসিংহের গৌরিপুর জংশন স্টেশনে এসে থামলো। এখন শীতকাল, বাইরে স্পষ্ট কুয়াশার আভা। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই হু হু করে ঠান্ডা বাতাসের এক ঝাপটা মুখে এসে লাগলো। বিশ্বজিত গা’য়ের চাদর ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে মাফলার এবং কানটুপিও পরে নিলো। ইতিউতি তাকিয়ে স্টেশনের পাশের বদ্যিনাথের চায়ের দোকানে যেয়ে বসলো ও। এত বছরেও এই দোকানের কোন পরিবর্তনই হয়নি। বদ্যিনাথ সেই ঠিক আগের মতোই আছে, শুধু দশটা বছরে চেহারায় কিছুটা বয়সের আঁকিঝুঁকি লেগে গেছে। বিশাল একটা কেটলি থেকে আগুনে গরম চায়ের লিকারের সাথে গরুর খাঁটি দুধ মিশানো ঘন চা'টাকে মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গীয় অমৃত সুধা। কয়েকটা চুমুক দিতেই ওর শীত শীত ভাব কমে আসলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে বিশ্বজিত’কে দেখা গেলো মুক্তাগাছায় এসে মিষ্টির দোকান থেকে মন্ডা কিনতে। হাতে কয়েক কেজি মন্ডা কিনে বাসার দিকে যাত্রা শুরু করলো ও। বাসা এখান থেকে কয়েক ক্রোশ দূরেই হবে। হেঁটেই রওনা হলো বিশ্বজিত। দশবছর পরে গ্রামে নিজের বাড়িতে ফিরেছে আজ ও। একের পর এক ধানক্ষেতের চিকন আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরাতন অনেক স্মৃতিই আজ মনে পড়ছে ওর। দশ বছর, একশ বিশ মাস, প্রায় সাড়ে তিন হাজার দিন। দেখতে দেখতে কিভাবে যেন দিনগুলি কেটে গেল। জীবনের বহতা স্রোতের উল্টোদিকে চলতে চলতে হুট করেই কয়েকদিন আগে বিশ্বজিতের মনে হলো আর কতকাল এই ছন্নছাড়া জীবন? শিকড়ের টান উপড়ে ফেলা এত সহজ না। কিছু কিছু শিকড় বুকের এত গভীরে প্রোথিত থাকে যে এর কোন কূলকিনারাই খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিকালবেলা বিশ্বজিতের ছোটবোন বিথীকা বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য শ্বশুড়বাড়ি থেকে চলে আসলো। বিশ্বজিত বিদেশে চলে যাবার কয়েকবছর পরে বিথীকার বিয়ে হয়েছিল। সুযোগ বুঝে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বিথীকা’র কাছে একটা গোপণ বিষয় জানতে চাইলো বিশ্বজিত। মুহূর্তেই গভীর বিষাদে মুখ ঢেকে গেল বিথীকার।
-দাদা ও ভালো নেই। এতকিছুর পর কী করে ভালো থাকে বলো? তোমরা সবাই মিলে যা করেছ ওর সাথে?
-কেন রে লগ্নজিতার আবার কী হয়েছে?
-ওমা দাদা, তুমি দেখি কিছুই জানো না!
মুখ কিছু এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বিথীকা দাদা বিদেশে চলে যাবার পর থেকে নিজের বাল্যকালের সখীর হাল হকিকত গড়গড় করে বলে যেতে লাগলো। সবকিছু শোনার পর প্রায় স্তব্ধ বিশ্বজিত শুধু অস্ফুটস্বরে বললোঃ
-ও কোথায় থাকে এখন?
-নিজের বাসায় চলে এসেছে। বিধবাদের তো শ্বশুড়বাড়িতে থাকতে দেয়না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে ওকে।
লগ্নজিতা বিথীকা’র সমবয়সী। এখন বয়স আর কত হবে? চব্বিশ বা পঁচিশ? বাবা মারা যাবার পর লগ্নজিতার কপাল আরো পূড়েছে। টাকাপয়সার জন্য নিজের ভাইরা মিলে বোন’কে ঘাটের মড়ার সাথে বিয়ে দেয়। ওর ভাইদের দোষ দিয়ে আর লাভ কী? বিশ্বজিত তো নিজের বাবা মা’কেই রাজী করাতে পারলো না। অবস্থাপন্ন কায়স্থ পরিবারের একমাত্র ছেলে’কে কিছুটা নিন্মবিত্তের মেয়ের সাথে কোনভাবেই বিয়ে দিতে রাজীও হলো না। বিশ্বজিতের বাবা মা দুইজনই খুব গোঁড়াপন্থী। জিদের চোটে দেশ ছেড়েই চলে গিয়েছিল ও। ইচ্ছে করেই দেশের কারো সাথেই যোগাযোগ রাখতো না ও! নিজের না পারার ব্যর্থতায় কূঁকড়ে গেল বিশ্বজিত। লগ্নজিতার মুখামুখি দাঁড়িয়ে একবার জন্যও ও বলে যেতে পারেনি, কেন সেদিন আমৃত্যু হাত ধরে রাখার আশ্বাস দিয়েও চোরের মতো পালিয়ে চলে গিয়েছিল। “লগ্নজিতা, এই পৃথিবীতে তুমি আমার একমাত্র গ্রহ। চারিদিকে হাহাকারে ভরা অসীম মরুভূমিতে তুমিই আমার একটুকরো মরুদ্যান”। বড় বড় কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো ও।
দুই বিল্ডিং পরেই লগ্নজিতাদের বাসা। আগে কত রকম অজুহাতে এইবাসায় বিশ্বজিতের নিয়মিত আসা হতো। কিন্তু আজ এতদিন পরে কিছুটা হলেও কুন্ঠা হচ্ছে ওর। মৃদুপায়ে বাসার সামনে এসে দাঁড়াতেই বারান্দায় বসা লগ্নজিতার সাথে দেখাঃ
-দাদা, অবশেষে আসলে? এতদিন পরে? আমাকে ভুলেও যেতে পারলে না একদম?
হুট করে কী বলবে সেটা মনের মাঝে খুঁজেও পেলো না বিশ্বজিত।
জন্ম জন্মান্তরের খুব চেনা মানুষটাকেও বিশ্বজিতের ভীষণ অচেনা মনে হলো আজ। বারান্দায় মুখোমুখি এখন দাঁড়িয়ে আছে দুইজন। লগ্নজিতা মেঝের দিকে তাঁকিয়ে আছে। বিশ্বজিতের দিকে মুখ তুলেও তাকাচ্ছে না। হালকা দুই একটা কথা কিংবা প্রশ্নও মেঝের দিকে তাঁকিয়ে বলে যাচ্ছে। বিশ্বজিতের বুকের ভিতরে মুচড়ে উঠলো এক নিদারুণ অপরাধবোধ। সহজ সরল এক অবুঝ বালিকাকে একরাশ স্বপ্ন দেখিয়ে একসাথে ভালোবাসার জীবনসমুদ্র পাড়ি দিবে বলে মাঝপথে হাতটুকু ছেড়ে দেবার সেই অপরাধবোধ, যা এতটা বছর ধরে প্রতিমুহূর্তেই ওকে কূঁড়েকূঁড়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়েছে। বিশ্বজিতের আজন্ম ভালোবাসার প্রিয় মানুষ, ছটফটে হরিণের মতো নরম একটা শরীর। স্নিগ্ধ একটা মুখে ঈশ্বর কী অসীম মায়া রেখে দিয়েছেন। শত ইচ্ছে থাকলেও যে মায়া হাত দিয়ে আজ ও আবার ছুঁয়ে দেখতে পারবে না। কিশোরীর চঞ্চলতায় ভরা লগ্নজিতা এখন অনেক বদলে গেছে, আগের থেকে বেশি শান্ত। হয়তো এইজীবনে না-পাওয়ার হাহাকারগুলি নিঃশব্দে বুকের ভিতরের সবকিছু ভেঙেচুড়ে চুরমার করে দিয়ে গেছে দেখেই আজ এতটা নিশ্চুপ লগ্নজিতা। ক্ষণিকের জন্য লগ্নজিতার সাথে চোখাচোখি হতেই মনে হলো ওর চোখের মাঝে হাজারো অব্যক্ত কথা লুকিয়ে আছে বিশেষ কাউকে বলার জন্য।
-আমার ঘরে এসে বসো দাদা। তোমার সাথে আলাদা করে কিছু কথা আছে।
বারান্দার সাথে লাগোয়া একটা দরজা লগ্নজিতা খুলে ভিতরে ডাকলে বিশ্বজিত নিরবে অতি পরিচিত সেই ঘরে এসে ঢুকলো। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দরজা লাগিয়ে দিতেই মৃদু অন্ধকারে ঘর ভরে উঠলো। লগ্নজিতা নিঃশব্দে ধীরপায়ে বিশ্বজিতের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। কেবলই নামা জ্যোৎস্নার হালকা আলোতে বিশ্বজিতের বুকটা মৃদু কাঁপতে শুরু করে, অনেক পরিচিত একটা গায়ের ঘ্রাণ ওর নাকে এসে ভীড় জমালো। হঠাৎ লগ্নজিতা শক্ত করে বিশ্বজিতের দুইকাঁধ ধরে নিজের নরম ঠোঁটগুলো বিশ্বজিতের ঠোঁটের ভিতরে শক্ত করে ডাবিয়ে দিলো। স্তব্ধ বিশ্বজিত কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে, অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় পুরোপুরি অপ্রস্তুত ও। লগ্নজিতা আজ আর কোনকিছুই মানলো না। বেশ কিছুক্ষণ পরে নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে কঠিনস্বরে বললোঃ
-লজ্জা পাচ্ছো নাকি দাদা? এই ঘরে আমাকে পড়াতে এসে দরজা আড়াল করে জোর করে কতবার চুমু খেয়েছ, কতবার ইচ্ছেমতো জড়িয়ে ধরেছ, মনে আছে সেইসব?
-মনে আছে রে, কোনকিছুই ভুলিনি আমি। এইসব স্মৃতি কিছুতেই ভুলে যাওয়া যায় না।
-তখন ভাবতাম আরেকটু বড় হলেই যখন আমাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবে, তখন আমিও তোমাকে ইচ্ছেমতো চুমু দেবো। তোমার চুমুগুলির সব দেনা আমি আদরে আদরে ঠিক ঠিক শোধ করে দেবো। কিন্তু সেই সুযোগ তো আমাকে দাওনি তুমি দাদা!
-তুমি তো আমাকে সত্যিকারের ভালবাসোনি না। বাসলে কোনদিনও স্বার্থপরের মতো এভাবে আমাকে একলা ফেলে চলে যেতে পারতে না। কিন্তু আমি যে তোমাকে বাসতাম সেটার প্রমাণ আজকে ঠিকই দিলাম। আজকে যেটা করেছি, সেটা না করলে তুমি কোনদিনও বুঝতে পারতে না আমি তোমাকে কতখানি ভালোবেসেছি সারাজীবন ধরে!
কথা বলা শেষে লগ্নজিতা বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলো। গলা এতটাই আর্দ্র হয়ে উঠলো যে বেশ কয়েকবার গলাখাকারি দিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না। খুব অস্তস্তি নিয়ে বিধবা লগ্নজিতার হাত থেকে কুসংস্কারবশত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলো বিশ্বজিত। কিন্তু নিঃশব্দে বিশ্বজিতের ডানহাতটা আরো শক্ত করে লগ্নজিতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলো পরম নির্ভরতায়।
-বাসায় আজকে কেউ নেই। আমার কাছে আজকে রাতটা থেকে যাও দাদা। আমার সাথে সারারাত গল্প করার তোমার না অনেক শখ ছিল বারবার বলতে?
বিশ্বজিত চমকে উঠে দেখলো লগ্নজিতার আজ আর চোখে-মুখে কোনো লজ্জা, দ্বিধাসঙ্কোচ কিছুই নেই। কোনরকমে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিশ্বজিত ঐ বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। বাসা থেকে চলে আসার সময়ে শুনলো ভাঙ্গা গলায় লগ্নজিতা বলছেঃ
-আবারও ভয় পেলে দাদা? এত ভয় নিয়ে আমাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়েছিলে কেন?
উদ্দেশ্যহীনভাবে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলছে এখন বিশ্বজিত। মাথার উপর পূর্নিমার বড় চাঁদের আলো থাকার পর সামনের সবকিছু আজ ওর চোখে অন্ধকার লাগছে। প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত মন, কিছুই ভালো লাগছে না। হঠাৎই চলে আসার আগে শেষবারের মতো লগ্নজিতার চোখের সুতীব্র আকুতির অর্থ হুট করেই বুঝতে পারলো ও। বুকটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। থমকে দাঁড়ালো ও, মনের ভিতরে উথালপাতাল এখন ঢেউ বইছে। এতটা গভীর ভালোবাসা কিভাবে ওর চোখ এড়িয়ে গেল? ভালোবাসার এতটা কাছে এসেও প্রণয়ের তরীতে উঠতে দ্বিধা করছে ও? আবারও একই ভুল করছে না তো?
মুহুর্তেই ঘুরে দাড়ালো বিশ্বজিত। ঠিক কী হলো ও নিজেও জানে না, পাগলেও মতো ছুটে চলছে এখন ও। এখন আর নিজের উপর ওর কোন স্বাধীনতা নেই। পা দুটো যেদিক যেতে চাইছে সেদিকেই যাচ্ছে ও এখন।
কিছুক্ষণ পরেই খুব চেনা একটা বাসার আরো বেশি চেনা একটা দরজায় যেয়ে জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলো ও। দরজাটা খুলতেই ঘরে ঢুকে বিশ্বজিত ভালো করে ভিতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। সামনে দাঁড়ানো একজনকে সজোরে বুকের ভিতরে টেনে নিলো, অবাধ্য আদরের পরশে শুষে নিতে চাইলো এতদিনের পুরানো সব দেনাকে।
-দাদা তুমি আবার ফিরে এসেছো?
-হ্যাঁরে পাগলি!
-এত দেরী হলো কেন?
-নিঃসঙ্গতার মাঝে থাকতে থাকতে ভালোবাসা চিনতেও ভুলে গিয়েছিলাম। আর এই ভুল হবে না। আর কখনই তোকে ফেলে কোথাও যাবো না।
-সত্য বলছো তো দাদা?
- হ্যাঁ, দেখ তোকে ছুঁয়ে বলছি দেখে!
ঝট করে বিশ্বজিতের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইলো লগ্নজিতা। লজ্জার আবীরে লগ্নজিতার মুখ আরক্তিম হয়ে উঠলো দ্রুতই। ভেজা ভেজা চোখ মুছে ফেলে লগ্নজিতা পরম নির্ভরতায় বিশ্বজিতের বুকে মাথা ঠেকালো। আলতো করে নিজের দুই হাতে লগ্নজিতার মুখ উঁচু করে ধরলো বিশ্বজিত। লগ্নজিতার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে বিজয়ীর হাসি। চোখে খুব পরিচিত এক দৃষ্টি।
সেই দৃষ্টিতে বিশ্বজিত সহসাই যেন খুঁজে পেলো বহু বছর আগে ফেলে আসা অসম্ভব আবেগে ঢাকা ভালোবাসার এক অতলান্তিক হাতছানি।
কিছু কথাঃ এই গল্পের পুরো কৃতিত্ব ব্লগার পদাতিক ভাইয়ের। উনার এই গল্পটা পড়ার পর সেটার ফিনিস কেন যেন নতুন করে লিখতে ইচ্ছে করলো। লগ্নজিতা নামটাও উনার দেয়া। মেয়ের এই নামটা মাথার একদম ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল। কিছুতেই বাদ দিতে পারলাম না। শুধু ভালোবাসা নির্ভর গল্প আমি সাধারনত লিখি না। তবে সবকিছুরই ব্যতিক্রম থাকে। লগ্নজিতা আমার কাছে ভালোবাসার এক “অপরাজিতা নন্দিনী”!
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, এপ্রিল ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০২১ দুপুর ২:৪৮