বাংলাদেশে সাহিত্যচর্চাকে আজকাল ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা শুরু হয়েছে। শুনতে অবাক লাগলেও আজকাল একটা বইয়ের জনপ্রিয় হওয়ার জন্য বইয়ের লেখার গুণগতমানের চাইতে বাণিজ্যিক বিষয়গুলো অনেক বেশি ভূমিকা রাখে। আলোচিত বেশ কয়েকটা বইয়ের মারাত্মক সব রিভিউকে বিশ্বাস করে বই কিনে পড়তে যেয়ে সচেতন অনেক পাঠক-পাঠিকা ব্যাপকভাবে হোঁচট খেয়েছেন। বিভিন্ন সাহিত্য গ্রুপগুলিতে এদের মন্তব্য বা পোস্ট পড়লেই এদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। এরা অনেকেই নিজেদের টাকা নষ্ট হবার জন্য ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।
.
পাঠক হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা আরো করুণ। গতবছর প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার আলোচিত একটা বই পড়তে যেয়ে দেখি পুরো বইটি অন্য দুজন লেখক লেখিকার কাছ থেকে কাট-কপি-পেস্ট করা। একজন বাংলাদেশের বিখ্যাত হুমায়ূন আহমেদ এবং অপরজন কলকাতার নামকরা একজন লেখিকা। এই নামকরা লেখক দিব্যি এই দুজনের বই থেকে অর্ধেক/অর্ধেক লেখা নিয়ে নিজের নামের বই প্রকাশ করে ফেলেছেন। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে এই বইয়ের রিভিউগুলো এতটাই মিথ্যাচারের পরিপূর্ণ ছিল যে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ হুমায়ুন আহমেদের সেই ব্যাপক আলোচিত বইটা পড়েননি এমন পাঠকের সংখ্যা খুবই কম থাকার কথা। কলিকাতার সেই বইটাও খুব নামকরা। কিন্তু সচেতনভাবেই অনেক রিভিউয়ারা এই বইয়ের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা পর ফেনা তুলে ফেলেছিল।
.
ঠিক তখন থেকেই বইয়ের কিছু রিভিউয়ের উপর আমার বিশ্বাস পুরোপুরি উঠে গিয়েছিলো। ভালোমতো খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আজকাল বইয়ের রিভিউয়ের সাথে বাণিজ্যিক বিষয় জড়িত হয়ে পড়েছে, যাদের বলা হয় পেইড রিভিউয়ার। এদের কাজ হচ্ছে যত জঘন্যই হোক, যত চুরি করা বই হোক, যত বাজে তার লেখার ধরনই হোক, রিভিউ করতে যেয়ে সেই বইটিকে আসমানে তুলে দিতে হবে। বইয়ের মারকিং দিতে হবে ৫ মধ্যে ৪.৯৫ বা এর কাছাকাছি। ৫ই দিয়ে দিতো কিন্তু পাব্লিক আবার কী বলবে ভেবে দেয় না হয়তো!
.
বই পড়ার পর পাঠকদের বইয়ের রিভিউ দেয়া খারাপ কিছু না। সমস্যা হচ্ছে যখন পেইড রিভিউ দেয়া হয়। এসব রিভিউ মাটিতে শুয়ে থাকা উচিত বইকেও সাত আসমানে তুলে দেয়। ফলে পাঠক যখন বইটা পড়া শেষ করে নিচে তাকায়, আর সিঁড়ি দেখতে পায় না। সপ্ত আসমান থেকে ধুপ করে নিচে পড়ে যায়। তখন রিভিউয়ার এবং লেখক দুজনের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে। পেইড রিভিউয়ার বিষয়টা অত্যন্ত নোংরা জিনিস, একজন সাহিত্যের মানুষ হয়ে লেখকরা এত নোংরা বাণিজ্যিক একটা বিষয়ে কীভাবে জড়িয়ে যান সেটা আসলেই বিস্ময়ের ব্যাপার। এটা এখন সুস্পষ্ট যে, অনেকেই এখন শুধুমাত্র টাকার জন্য লেখেন, সুষ্ঠু সাহিত্য চর্চার জন্য লিখেন না। বাণিজ্যিক লেখালেখির সারমর্ম খুবই নগণ্য।
.
একজন সচেতন পাঠকের রিভিউতে পছন্দ-অপছন্দ, দোষ ত্রুটি সবকিছুই উঠে আসা উচিত। কিন্তু আজকাল বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই দেখা যায় তিলকে তাল বানিয়ে ১০ এর মধ্যে ৯.৭৫ মার্ক দিয়ে বই রিভিউ ছাপায়। এরা কী ধরনের রিভিউ করে এখান থেকেই বুঝা যায়? সম্ভবত রিভিউতে মারকিংয়ের নাম্বারের সাথে পেইড আমাউন্ট সমানুপাতিক।
.
আজকাল অনেক পাঠক পাঠিকাই আছেন যারা বই কেনার আগে বইয়ের পজিটিভ রিভিউ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকেন। অন্যের দেয়া পজিটিভ রিভিউ দেখে খুশিতে বাকবাকুম হয়েছে বইটা কিনে নিয়ে আসেন। আপনার কীভাবে ধারণা হলো আপনার রুচি এবং যিনি রিভিউ লিখেছেন তার রুচি হুবহু একই রকম হবে? তার পছন্দ আপনার পছন্দের সাথে মিলে যাবে? দুজন পাঠকের রুচি কখনো এক হতে পারে না। আরেকজনের পছন্দে আপনি বই কিনবেন কেন? আরেকজনের রিভিউ পড়ে যারা বই কেনে তারা আসলে বুঝতেই পারে না কোনটা ভালো বই, কোনটা খারাপ বই। যারা এই কাজ করে, তারা বইটা পড়েও বুঝতে পারে না, আসলে ভালো লাগলো, না খারাপ লাগলো।
.
আমি এইসব পাঠক-পাঠিকাদের কাছে একান্ত অনুরোধ করবো, এসব রিভিউ পুরোপুরি বিশ্বাস না করে যদি সম্ভব হয়, বইটা হাতে নিয়ে কয়েক পাতা উল্টে পড়ে দেখবেন। আজকাল অনলাইন বুকশপগুলিতেও বইয়ের কয়েকটা পাতা পড়ার সুযোগ থাকে। দরকার পড়লে কয়েকটা পাতা পড়ে দেখুন। লেখকের লেখার টোন বুঝার জন্য এক বা দুই পাতাই যথেষ্ট। বেশিরভাগ রিভিউ এখন আসে পেইড প্রমোশন থেকে। তারা আপনার বিশ্বাসকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
.
দিনশেষে আপনি একটা বাজে বই কিনে নিয়ে আসলে আপনার দুই ধরনের ক্ষতি হবে। এক হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি, দুই হচ্ছে আরেকটি ভালো বই না পড়তে পারার ক্ষতি। যে টাকা দিয়ে আপনি একটা বাজে বই কিনে নিয়ে এসেছেন, সেটা না কিনে আপনি হয়তো দুর্দান্ত কোন একটা বই কিনতে পারতেন, যেটা পড়লে আপনার খুব ভালো লাগতো। পেইড রিভিউ প্রমোশন বিষয়টা খুবই নোংরা এবং আপত্তিজনক। যারা এভাবে পেইড রিভিউ পড়ে বই পড়ে ঠকেছেন তারাই জানেন বিষয়টা কত বেশি বিব্রতকর এবং লজ্জাজনক।
.
আমি এটা মানছি যে বইয়ের প্রচার প্রসারে রিভিউ গুরুত্বপূর্ণভূমিকা রাখে। বিশেষ করে নতুন লেখকদের বই অনেকটাই নির্ভর করেই রিভিউয়ের ওপর এবং সেই সাথে যিনি রিভিউ দিচ্ছেন তার রিভিউ দেয়ার ক্ষমতার উপর। সাধারণত কোন পাঠক অপরিচিত লেখক বা লেখিকার বই না জেনে কিনতে চায় না। পাঠকদের দোষও দেয়া যায় না এক্ষেত্রে। তারা তখন সেই বইয়ের রিভিউয়ের অপেক্ষায় থাকেন, তারপর পজিটিভ রিভিউ হলে বইটি কিনেন, নয়তো সেই বইয়ের নাম মাথা থেকে ঝেরে ফেলেন। সবচেয়ে বেশি এই বিষয়টা নতুন বা দুই একজন বইয়ের লেখকদের ক্ষেত্রে চরম মাত্রায় দেখা যায়।
.
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটা বই কেনার ক্ষেত্রে আপনি কেন অন্যের ওপর নির্ভর করবেন? হ্যাঁ সে ভালো আলোচনা অথবা রিভিউ দিতে পারে বলেই কি তার মতামত সবসময় গ্রহণযোগ্য হবে? ‘নিজের টাকা দিয়ে কিনবো, নিজের রিস্কে নিজে নেবো। অন্যের কথায় আমি কেন বই কিনবো?’এই থিওরীতে বই কিনুন। অযথাই বই কেনার সময়ে ঠকে যাওয়ার পরিমান অনেকাংশেই কমে যাবে। তাই রিভিউ দেখেই বই না কিনে কিনে আগে বইটা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিন। যদি মনে হয় আপ্নার রুচির সাথে মিলে যায় তখনই বইটা কিনুন।
.
একটা বই অবশ্যই সোশাল মিডিয়ায় প্রচারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বইয়ের ভালো দিকগুলো, জনরা ইত্যাদি তুলে ধরতে হবে পাঠকদের সামনে। বিনা স্পয়লারের রিভিউ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা দুটোই করতে হবে। এতে নতুন পাঠকরা বইটি সম্পর্কে অন্ততঃ কিছু জিনিস ধারণা করতে পারবেন।
.
একজন রিভিউ খারাপ দিলেই সেই বই নেতিবাচক হয়ে যাবে সেটা মনে করার কোন কারন নেই। এক বই সবার ভালো নাও লাগতে পারে। সবার রুচি কোনদিন এক হতে পারে না। কিন্তু
আজকাল বেশিরভাগ নিরপেক্ষ রিভিউ করেন না। বইটা খারাপ লাগলেও, সেটা অনেকেই প্রকাশ করতে চান না বইয়ের লেখকের বিরাগভাজন হবেন চিন্তা করে। প্রতিটি মানুষের লেখা পড়ার পছন্দের ভিন্নতা আছে বলেই সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জনরার লেখা দিয়ে বিশ্ব সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। যারা রিভিউ লেখেন তাদেরও কিছু বিষয় মাথায় রেখে লেখা উচিত, তার কাছে ভালো লাগেনি বলে যে আর কারো কাছে ভালো লাগবে না, এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করাও ঠিক নয়।
.
অনেস্ট রিভিউ দিতে গেলেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় অনেক। তারপরেও আমি সবাইকে অনুরোধ করবো সত্য প্রকাশে দ্বিধা করবেন না। অনেস্ট রিভিউ খুব খুব দরকার। বিশেষ করে সাধারণ পাঠকদের জন্য যাদের কাছে বই কিনতেখাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যায়। এরা কয়েকটা আলোচিত বই কিনে এনে যখন দেখে অখাদ্য কুখাদ্য, তখন বই পড়ার রুচিই এদের নষ্ট হয়ে যায়।
.
নিজের মত প্রকাশ করতে ভয় পাবেন না, বাংলা ভাষার জন্য এবং বাংলা সাহিত্যের জন্য হলেও সত্যকে প্রকাশ্যে তুলে ধরুন। এভাবে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা সাহিত্যকে নোংরা হতে দেবেন না।
.
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইলো
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, মার্চ ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০২২ বিকাল ৪:১৪