somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প: আফসানা

১৮ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১২:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আফসানা অনেক দিন ধরেই বলছে ফুচকা খাবে।
ফুচকা ওর প্রিয় খাবার। রোদ ঝলমলে কোনো একদিন আমার সাথে বসে মচমচে ফুচকা খাওয়ার খুব সাধ। মাঝে মাঝে বান্ধবীদের সঙ্গে ফুচকা খায়, তবু আমার সঙ্গে খাওয়ার সাধ জেগেছে। আমাকে বলার পর আমি অমত করতে পারি না।
কয়েক দিন একটানা বৃষ্টির পর আজ রোদ উঠেছে। ফুচকা খাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। সে আমাকে বলে শহিদ মিনারে হাজির হতে। ওর হল থেকে কাটা পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে একা একা আসতে ওর ভয় হয়। আমি সাথে থাকলে নিরাপদ বোধ করবে। যথা সময়ে হাজির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। শহিদ মিনার চত্বরে ছাত্ররা প্রতিদিন আড্ডায় মেতে ওঠে। রাত গভীর হওয়া পর্যন্ত আড্ডা চলে। এক দল যায়, অন্য দল আসে; পালাক্রমে আড্ডা চলতে থাকে। আজ চত্বর ফাঁকা, হয়তো বৃষ্টির কারণে। তিন-চারজন ছাত্রের একটা দল চত্বরের অদূরে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে অস্থায়ী আড্ডা দিচ্ছে। আমি একা একা চত্বরের পাশে পায়চারি করছি। বার দু-এক ফোনে তাড়া দিই আফসানাকে জলদি বের হতে। আসছি বলে আমাকে অপেক্ষা করাতে থাকে। সে প্রায়ই আমাকে বলে, সে নাকি সাজগোজ করে না। তা হলে এখন এত দেরি হওয়ার মানে কী? ওর কোনটা যে সত্যি আর কোনটা মিথ্যা, বুঝে উঠতে পারি না। প্রায় আধা ঘণ্টা পর ও আসে। দেঁতো হাসি দিয়ে বলে, কখন এলি? আমি বলি, আধা ঘণ্টা হতে চলল। সে বিশ্বাস করতে পারে না। অবিশ্বাস নিয়ে আমাকে বলে, ‘সত্যি?’ একবারের কথা বিশ্বাসযোগ্য না হলে, দুবার বললে সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে? আমি এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াই না।


কাটা পাহাড়ের রাস্তা ধরে জিরো পয়েন্টের দিকে মৃদৃ পায়ে আমরা হাঁটতে থাকি। আফসানা আমার পেছনে অবস্থান করে। কোনো কোনো পথচারীর দৃষ্টি আমাদের দিকে নিবদ্ধ হতে দেখা যায়। আমি ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে উঠি। লজ্জামিশ্রিত ভয়ে কান গরম হয়ে ওঠে, মুখে কোনো কথা সরে না।

মাঝে দু-একবার হুঁ-হাঁ করে আফসানার কথার দায়সারা গোছের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার মুখে কথা নেই দেখে সে হয়তো আশ্চর্য বোধ করে। ‘কথা বলছিস না কেন?’ আফসানার কণ্ঠে প্রশ্ন ধ্বনিত হয়। জবাব দিই না। ওর প্রশ্নে আমি আরও লাল হয়ে উঠি। রাস্তাটা এমনিতেই অনেক দীর্ঘ; পরিস্থিতির চাপে রাস্তাটা আরও দীর্ঘ হয়ে ওঠে। আমরা জিরো পয়েন্ট অতিক্রম করি। মউর দোয়ানের পাশের দোকানে, যেখানে নাকি মজাদার ফুচকা বানানো হয়, আমরা প্রবেশ করি। টেবিলে টেবিলে যুবক-যুবতীর দল ফুচকা খাওয়ায় ব্যস্ত। গল্পের ছলে ফুচকার প্লেট খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা একটা খালি টেবিলে বসি। ফুচকার অর্ডার করে অপেক্ষা করতে থাকি। ভয়টা ক্রমে দানা বেঁধে বিস্তার লাভ করতে থাকে। এই বুঝি পরিচিত কেউ দেখে ফেলল। দুজন মিলে এক প্লেট ফুচকা খাই। আফসানা বলে, আজকের ফুচকা ভালো লাগছে না। ওর কথা শুনে আমার মন খারাপ হয়। উপহার যত সামান্যই হোক, দাতার সম্মুখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে হয়। এই সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধ নেই ওর? আছে। পরে ফোনে কথা বলার সময় সে জানায়, ভালো লাগার কথা বললে যদি আমি আরও এক প্লেটের অর্ডার করি, এই আশংকায় সে ভালো লাগার কথা বলেনি। মেয়েটার কর্মকাণ্ড অদ্ভুত। আপাত দৃষ্টিতে তার ব্যবহার আঘাত মনে হলেও পেছনে রহস্য লুকিয়ে থাকে। আমার পকেটের দৈন্যদশার দিকে খেয়াল করে সুস্বাদু ফুচকা বিস্বাদ বলে আখ্যায়িত করে।

ফুচকা খেতে খেতে আমরা টুকটাক আলাপ করি। ওর মুখাবয়ব বারবার দেখতে থাকি। হালকা ফর্সা, মায়াবী চেহারা। সে নিজেকে কালো বলে দাবি করে। আমি জানি, এ দাবির পেছনে লুকিয়ে আছে প্রশংসিত হওয়ার লোভ। মানুষ অন্যের প্রশংসা পেতে নিজের দোষ প্রকাশ করে।

***
আফসানার সাথে আমার প্রতিদিনই চ্যাটিং হয়, ফোনে কথা হয়। এক রাতে সে জানায়, পাকিস্তানের এক লোক তাকে ইনবক্স করেছে। পাকিস্তানি তার ছবি দেখতে চায়। বিষয়টা জানার পর আমার খারাপ লাগতে শুরু করে। আফসানার প্রতি অভিমান তৈরি হয়, কিন্তু তাকে বুঝতে দিই না। আরেক দিন সে জানায়, লোকটার সাথে চ্যাটিং করতে করতে মেসেঞ্জারে কল করে হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত ভাষায় তাদের আলাপও নাকি হয়েছে। পাকিস্তানির সাথে কথা বলে তার ভালো লেগেছে। দুইজনের কেউই ভালো ইংলিশ বলতে পারে না। বিষয়টা আঁচ করতে পেরে একসাথে উভয়ে হেসে উঠে। পাকিস্তানি লোক আফসানার কণ্ঠের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়। আমি দগ্ধ হতে থাকি অভিমানের আগুনে।

***
ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি দু বছর হতে চলল। আফসানা আমার ক্লাসমেট। এক বছর কেটে যায়, আমরা পরস্পরকে চিনে উঠতে পারি না। তাকে দেখে আমার তেমন ভালোও লাগে না। দিন দিন চ্যাটিং করে আমরা পরিচিত হয়ে উঠি। ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করি। যেদিন নাম্বার পাই, সেদিন আমার ভেতর অজ্ঞাত উত্তেজনা তৈরি হয়। দু'দিন কেটে যায়, কল করার সাহস হয়ে ওঠে না। দু'দিন পর আফসানা কল করে আমাকে। মোবাইল হাতের নাগালে না থাকায় রিসিভ করতে পারিনি। সাহস করে ওর নাম্বার ডায়াল করি এবং উত্তেজনায় কাঁপতে থাকি। আফসানা রিসিভ করে। এলোমেলো কয়েকটা কথা বলেই প্রথম আলাপন সমাপ্ত করি। চ্যাটিং প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে কলের মাত্রাও বাড়ে। আমি তাকে খুব কম কল করি, প্রায়ই সে ফোন করে। একটানা ঘণ্টা-দেড়েক কথা চলে, যতক্ষণ ফোনে টাকা থাকে। আফসানার মিষ্টি কণ্ঠের ফাঁদে কখন যে ফেঁসে গেছি, বলতে পারি না। ওর সাথে প্রতিদিন কথা না বললে আমার ভালো লাগে না। সারাক্ষণ ওর কথা মনে পড়ে। চেষ্টা করি দূরত্ব তৈরি করতে, কিন্তু ব্যর্থ হই। অনাড়ম্বরভাবে আফসানাকে জানাই, ওকে আমি ভালোবাসি। সে আমাকে পাগল আখ্যা দেয়, বলে, আমরা একে অপরের বন্ধু, এর বেশি কিছু নই। আফসানার উত্তরে আমি আহত হই। ধাক্কাটা সামলিয়ে ওর প্রতি নির্মোহ হওয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যেই একদিন পাকিস্তানি লোকের প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। আমি চরম আহত বোধ করি। অনেক বছর ধরে কাঁদি না। ওর কথা শুনে কাঁদতে ইচ্ছে করে। পাথুরে হৃদয় খান খান হয়ে যায়। নৈকট্যই মানুষকে নিকটে রাখতে পারে না, দূরেও ঠেলে দেয়। আফসানা আমার এত কাছে, অথচ কত দূরত্ব আমাদের মাঝে!

পাকিস্তানি ছেলেটাকে ক্রমশ শত্রু ভাবতে থাকি। আফসানাকে বলি ব্লক করে দিতে। আফসানা জিজ্ঞেস করে, কেন ব্লক করব? আমি প্রথমে কারণ দর্শাই না। ওর জোরাজুরিতে এক সময় বলি, পাকিস্তানি ছেলের সাথে তোর যোগাযোগের ব্যাপারটা আমার ভালো ঠেকছে না। প্রতিনিয়ত কলিজায় বিঁধছে। এর পর সে তাকে ব্লক করে দেয়। আমি প্রশান্তি লাভ করি।
আমি কি আফসানাকে এখনও ভালোবাসি? না হলে এমন করলাম কেন? অন্যের সাথে ওর সম্পর্ক মেনে নিতে আমার কষ্ট হয় কেন? জানি না, জগতের সবকিছু জানা সম্ভব না। এই ব্যাপারটাও অজ্ঞাতই থাক।

আফসানা আমাকে প্রত্যাখ্যান করে বলে, মা-বাবার পছন্দে আমি বিয়ে করব। তারা আমাকে যার সঙ্গে উপযুক্ত মনে করেন, তার সঙ্গেই জীবন কাটাব। তাছাড়া আমার কিছু রোগ আছে। হাঁপানি, এলার্জি, একটুতেই সর্দি লেগে যাওয়া— এসব। মা-বাবা কাউকে আমার জীবনসঙ্গী নির্বাচন করলে আমার এসব সমস্যার দিকে লক্ষ করেই করবেন।
আমি ওর এসব সমস্যার কথা জানি। জেনেশুনেই তাকে চাই, বলেছিও তাকে। কিন্তু সে বলে, আমি চাই তোর সুন্দর বউ হোক। তুই সুখী হ। আমার জন্য তোর জীবনে অন্ধকার নেমে না আসুক। তুই আমার প্রেমিক না হতে পারিস, তুই আমার বন্ধু। বন্ধু হয়ে বন্ধুর জন্য এতটুকু কল্যাণচিন্তা করতেই পারি। তাছাড়া আমাদের বিয়ের সময় আসতে আরও অনেক দেরি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দিয়ে আমরা বিয়ে করব। তখনও যদি আমাকে তোর ভালো লাগে, আমার মা-বাবা তোকে আমার উপযুক্ত মনে করে, আমার আপত্তি থাকবে না। এর অন্যথা আমি করব না, করতে পারব না। তাদের ইজ্জত আমি নষ্ট হতে দেব না।
আফসানার এমন স্পষ্ট বক্তব্যের পর আমার কিছু বলার থাকে না। আমার কল্যাণচিন্তা, মা-বাবার সম্মানের চিন্তা আমি ফেলে দিতে পারি না।

এখন ওর সাথে আমার কেবলই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। জানি না, ভবিষ্যতের ললাটে আমাদের কী লেখা আছে। জীবন চলতে থাকুক আপন গতিতে। এক সময় আমরা উভয়ে জানতে পারব আমাদের ভাগ্যলিখন।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×