
যে বিকেলে গোধূলি বেলার লাল রঙে মিলেমিশে সোনাবৌয়ের প্রতিমার মতো রঙ সতীদাহের আগুনে পুড়ে কালচে কাঠ হয়ে গেল ,-তখনো খোল-করতাল-কাসর বাজছিলো উন্মাদের মতো, মৃত্যুযন্ত্রণা শব্দের তীব্রতায় ঢেকে দেবে বলে----
©
অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার অধীন নড়াইল সাবডিভিশনের লোহাগড়া-লক্ষ্মীপাশা-মল্লিকপুরে, তিনশো আটষট্টি ঘর গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ পরিবার একত্রে বাস করতেন। সারাদিন শাস্ত্র মেনে পূজোআর্চার সাথে হাজার রকম ধর্মীয় বিধান মানতে বাধ্য করা হতো সকলকে। মাঝেমধ্যেই খোল করতালের জান্তব আওয়াজের মধ্যে সতীদাহের আগুনে কালচে হয়ে উঠতো মল্লিকপুরের বাতাস। নিজেদের প্রয়োজনে একঘর করে ধোপা, নাপিত ও কাহারদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে।
ধোপা কাপড় কাচবে। নাপিত চুল দাড়ি কাটবে-। কাহাড় বিয়ে-পূজায় ঢোল বাজাবে আর বলিদেওয়া মৃত পশুর ছাল ছাড়াবে।
©
তিন মাসের বাচ্চা কমলা সুন্দরী র সাথে আটাত্তর বছরের বৃদ্ধ অবনীভূষণ মুকুজ্জের বিয়ে হয়ে গেল। পেতলের কাঁধাউচু খঞ্চেপোশ রেকাবির মধ্যে কাঁথায় মেয়েকে শুইয়ে মাথায় করে সাতপাক ঘুরলেন পাশের বাড়ির রমনীখুড়ো। বিয়ের মন্ত্রপাঠের মধ্যেই তিন মাসের কমলা কাঁথায় হিসি করে দিয়েছে। কী অলুক্ষণে মেয়েরে বাবা! এই শুভ মুহূর্তে কেউ হিসি করে ! এ তো সমাজের কালা নিয়মের মুখে 'মুত্রাঘাত' !
মালাবদল হল অবনী খুড়োর সাথে নতুন জামাইয়ের। শ্বশুরের থেকে জামাই মাত্র ঊনচল্লিশ বছরের বড়। বিয়ের পরদিন সব পাওনাগন্ডা বুঝে নতুন বর অবনী মুকুজ্জে বাপের ঘরে কনে রেখে চললেন পরবর্তী বিবাহ আসরে। বয়স একটু বেশিই, তবু মেয়ে তো কুলীন বর পেলো ! এমন ভাগ্য কজনের জোটে---ভগবান !!
©
ফুটফুটে বাচ্চা বড় হচ্ছে। সবে হাঁটতে শিখেছে এক পা-- দু পা!মুখে বুলি ফুটেছে দু একটা করে।তেরো মাস বয়সে আদর করে টলমলে পায়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে নতুন গজানো মুক্তোদাঁতে। এরই মধ্যে বাইশ ক্রোশ দুর থেকে খবর এলো দেহ রেখেছেন অবনীভূষণ মুকুজ্জে। সদ্য বিধবা কমলাকে সতী হতে হবে। সব যেন প্রস্তুত থাকে! কান্নার রোল ওঠে বাড়িজুড়ে। অবুঝ কমলা তখন একমনে উঠোনে বসে ধুলোমাটি মেখেই যাচ্ছে।
©
সন্ধ্যার পর পরই কমলাকে ঝোলা ব্যাগে পুরে, লুকিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বনগাঁর দুরসম্পর্কের দিদির বাড়িতে। এদিকে পরদিন সতীদাহের তোড়জোড় শুরু হবে। কিন্তু অবুঝ সতী উধাও। এই ভয়ঙ্কর পাপের ফলস্বরূপ কমলার মা-বাবাকে মোটা গাছের সাথে বেঁধে অকথ্য অত্যাচার হলেও খুঁজে পাওয়া গেলনা---সতীকে। একটা সময় বিরক্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিলো ধর্মীয় পুজারীরা। বেঁচে রইল কমলা। আট বছর পর, বনগাঁর দিদির বাড়ি থেকে কমলা ফেরৎ এলো নিজের বাবার বাড়িতে। ততদিনে রাজা রামমোহনের মহান চেষ্টায় সতীদাহ রোধ হয়েছে দেশ জুড়ে। তবুও কোনো কোনো জায়গায় আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দু একটা সতীর দেহ তবু জ্বলছে কোথাও কোথাও।
©
বাবা,- নাপিত ডেকে মেয়ের মাথার ঘন চুল,- এবরো খেবড়ো করে প্রায় নেড়া করে কাটিয়ে দিলেন, যাতে গ্রামের যুবক ছেলেদের কুনজর না পড়ে যুবতী কমলাসুন্দরীর দিকে । মাটির বারান্দায় ছোট গর্ত খুঁচে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তাতে ঘি লেপে তার মধ্যে নিরামিষ ডাল-ভাত দেওয়া হতো। বিধবা মেয়ের জন্য কোনো থালা বরাদ্দ নয়। একাদশীতে সারাদিনে কোনো আগুনের তৈরী খাবার খাওয়া যাবেনা। সারাদিনে বরাদ্দ সাতটা বাতাসা আর দু'ঘটি জল। মা কেঁদে মরে গেলেও নিয়মের অন্যথা হবার যো নেই। কর্তা বাড়ি থেকে বেরনোর সময় ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতেন তাকে।
মনে পড়ে মুকুন্দরামে'র সেই কবিতা--
"ওই আমানি খাবার গর্ত দ্যাখো বিদ্যমান ".....
আমানি খাবার (পান্তাভাত আর জল )ওই মাটির গর্ত থেকে পেঁপের ডাঁটি'র সাহায্যে সুড়ুৎ করে টেনে খেতে হতো।
©
ওই ঘন মেঘের মতো কালো চুল এবরো খেবড়ো করে কাটতে এসে যুবক অমল শীল প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। কমলালেবুর কোয়ার মতো বড়োবড়ো দুচোখ বেয়ে নীরবজলে ভেসে যাচ্ছিল কমলাসুন্দরী'র দু'গাল। বাবার কড়া নির্দেশ ছিলো নিয়ম করে দু'মাস অন্তর এভাবেই চুল কেটে দিতে হবে। চলছিলোও তাই।
এমন ই এক শ্রাবনের অঝোর ধারার মধ্যে ঐ অমল নাপিতের হাত ধরে চিরদিনের জন্য বদ্ধ খাঁচা ভেঙে পালিয়ে যায় রক্ষণশীল ব্রাক্ষ্মন পরিবারের অষ্টাদশী বিধবা কন্যা।
©
মুক্তি-মুক্তি---মুক্তির বেপরোয়া ঝোড়ো বাতাসে সওয়ার হয়ে বেহিসেবী দুলতে দুলতে শিয়ালদা -হাওড়া হয়ে সোজা মধ্যপ্রদেশের এক নির্জন পাহাড় ঘেরা ছোট্ট জনপদে পৌছয় তারা। এখানে কেউ কাউকে চেনে না। কবিরাজিটা টুকটাক জানা ছিলো, তার সাথে নিখুঁত ক্ষুর চালিয়ে ফোড়া-পাইলস্-অশ্বের অপারেশন। ধীরে ধীরে নামি চাঁদসি ডাক্তার অমলেন্দু সেন। নাম পদবীর প্রয়োজনীয় ছোট্ট বদল। তারপর উড়ে যাওয়া দুই স্বাধীন পাখি নিয়ম করে নিজেদের দুই বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে মাঝেমধ্যেই,- কিন্তু ঠিকানা জানায়নি কোনদিনই। অমল-কমল এর সুখের সংসার ভরে উঠেছে অদৃশ্য আশীষে। তিন ছেলেমেয়ের ভরা সংসার সামলে ডাক্তার স্বামীর কম্পাউন্ডারী সামলেছে কমলা।দুই ছেলের একজন দাঁতের ডাক্তার একজন--সরকারী চাকুরে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে ভালো পাত্রে। আর কোনোদিন ওই ঘন মেঘকালো চুল কাটতে দেয়নি অমলেন্দু। এখন সেই কাঁচাপাকা চুল উড়ে মাঝেমধ্যেই হাঁটু ছুঁয়ে যায় কমলার ।
দু'জনের খুব ইচ্ছে করে, মল্লিকপুরের ব্রাক্ষ্মণ পাড়ার জন্মভিটেতে কদিন ছুঁয়ে যায় অতীতের হাসিকান্না-! প্রেতাত্মার মতো এতদিন পরেও জাত্যাভিমান--সমাজক্রোধ আড়াল থেকে ভয় দেখায় দুজনকেই---
এজন্মে আর কোনোদিনই ছোঁয়া হবেনা জন্মভূমির মাটি-----
পরজন্মে, যদি আবার ফিরিয়ে আনো বিধি--/--ওই মধুমতী তীরেই আমায় ছুঁইয়ে দিও হৃদি.......
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




