কেউ যখন তাচ্ছিল্যভরে জিজ্ঞেস করে 'আপনার মাস্টারি কেমন চলে?', আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু মরে তো আর আসলেই যেতে পারি না। মাটির সাথে মিশে যেতেও পারি না। পরক্ষণেই মনে শক্তি এনে বুঝিয়ে বলিঃ
.
'আসলে জানেন কি ভাই, আমরা যারা বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষকতায় এসেছি, তারা শুধু শিক্ষক নই, আমরা একেকজন প্রথম শ্রেণির গেজেটেড সরকারি ক্যাডার কর্মকর্তাও। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের মতো আমরাও নবম গ্রেডের বেতন পেয়ে চাকরিতে জয়েন করি। থানার ওসি কিংবা জেলার নির্বাচন কর্মকর্তা বা পাসপোর্ট অফিসার বা এনএসআইয়ের সহকারী পরিচালক বা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার বা সঞ্চয় অফিসের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তার চেয়েও তিনি উপরের গ্রেডের এবং ক্যাডার কর্মকর্তা, অর্থাৎ তিনি প্রত্যায়ন সত্যায়ন করতে পারেন, এন্ট্রি লেভেলেই নির্বাচনের সময় প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন।
.
অন্য সব প্রতিযোগীর মতো আমরাও দেশের সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কেউ স্বেচ্ছায় আবার কেউ হাফ বা এক মার্ক বা আরেকটু বেশি মার্কের জন্য চয়েজ লিস্টের প্রশাসন পুলিশ বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে না গিয়ে শিক্ষায় এসেছি। কিন্তু আমাদের পোস্টিং শুধু ইন্টারমিডিয়েট/ডিগ্রি/অনার্স/মাস্টার্স লেভেলের কলেজে হয় না, (কলেজটা সর্বনিম্ন পর্যায়, স্কুলে হয় না), বরং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ অধিদপ্তরগুলোতেও হয়। আমরা একেকজন সচিব হওয়ার যোগ্যতা রাখি, হয়তো বয়স আর যোগ্যতা থাকলে একদিন কেউ কেউ হয়েও যেতে পারি। আর কিছু নাহলেও ধরে নেওয়া যায় অধ্যাপক আমরা চাকরির শেষ বয়সে হবোই।
.
আজ আমরা শিক্ষক, তাই হয়তো ম্যাজিস্ট্রেটদের মতো সবসময় ইন করে শার্ট পরে ঘুরে বেড়াই না বা পুলিশের মতো ইউনিফর্ম পরে ঘুরি না, ব্যবহারের জন্য অফিসিয়াল গাড়ি পাই না; বরং সাধারণ পোশাক পরি, এমনকি হয়তো কেউ কেউ টং এর দোকানে বসে চাও খাই। এর কারণ হলো, আমরা এখন শিক্ষক। শিক্ষককে দেখে কেউ ভয় পাক এটা শিক্ষক চায় না। জনগণের সাথে দূরত্বটাও তার কাম্য নয়। শিক্ষকের কাজ শিক্ষার্থীর পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও প্রয়োজনে শিক্ষা দেওয়া।
.
সাধারণের মতো পোশাক পরলে সাধারণের সাথে খুব সহজেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়া যায়, আপন ভাবে তারা আমাদেরকে। শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, বরং এর বাইরেও সমাজ অর্থনীতি রাজনীতি সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে সবার সাথে খোলামেলা আলোচনা করা জ্ঞানের চর্চা করাটাও আমি আমার কাজ বলে মনে করি। পাশাপাশি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়াটাও শিক্ষক কর্মকর্তা হিসেবে আমার কাজ বলে মনে করি। প্রশাসন পুলিশ ক্ষমতা প্রয়োগ করে এসব রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে, আর আমরা করি বুঝিয়ে সুঝিয়ে জ্ঞান দিয়ে উদাহরণের মাধ্যমে।
.
জাতি গঠনে আমাদের ভূমিকা একেবারে কম নয়। যাকে যে ক্ষেত্রে নিয়োগের উপযুক্ত বলে মনে করেছে সরকার, তাকে সেখানেই দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ক্যাডারের কারো মর্যাদা কম দেওয়া হয়নি। তাই আপনি যখন তাচ্ছিল্যের ছলে আমাকে 'মাস্টার' বলে ডাকেন, আমার তখন আপনাকেও জ্ঞান দিতে ইচ্ছা করে, কারণ আপনার জ্ঞানের বিস্তর অভাব রয়েছে। এই যে দেখেন কত বড় সংলাপে আপনাকে ইতিমধ্যেই কতটা জ্ঞান দিয়ে দিলাম! ধন্যবাদ'।
.
তবে দিনশেষে সমাজবাস্তবতা মেনে নিতেই হয়। সমাজের কাছে শিক্ষকের চেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের দাম বেশি। কারণ একজন শিক্ষককেও নিজের নিরাপত্তার জন্য তাদের শরণাপন্ন হতেই হয়। তবে এটাও ভুলে যাবেন না, একজন শিক্ষকের হাতেই কিন্তু গড়ে ওঠে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার..
দেব দুলাল গুহ / দেবু ফরিদী
.
[সবাই যদি এই লেখাটা যার যার টাইমলাইন থেকে আমার নামে ক্রেডিট দিয়ে বা আমাকে ট্যাগ দিয়ে প্রকাশ করেন, তাহলে অনেক মানুষ লেখাটা পড়ে আমাদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে পারবে।]