আমরা যারা অমুসলিম, তাদের কাছে রমজান মানেই বন্ধু, স্বজন বা কলিগদের সাথে একসাথে বসে হরেক আইটেমের ইফতার উপভোগ করা। এই মাসটা আমাদের কাছে বন্ধুবান্ধবদের একসাথে পাওয়ার একটা উপলক্ষ্য। মুসলিম বন্ধুরা রাত জেগে সেহেরি করে ঘুমায়, তো আমরাও জেগে থাকি তাদের সঙ্গ দিতে!
যখন ছোট ছিলাম, পাশেই মুসলিম স্বজন, যারা আত্মার আত্মীয়, তাঁদের বাড়িতে ইফতার ও ঈদের দিন দুপুরে একসাথে খাওয়ার দাওয়াত পেতাম। একইভাবে পূজায় আমরাও দাওয়াত দিতাম, বাবাকে দেখতাম কৌটা ভর্তি করে খই-নাড়ু-মোয়া নিয়ে দিয়ে আসতে। এটাই সম্প্রীতি, এটাই আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। এখানে ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।
উপরের ফ্রেজটার অপব্যাখ্যা দেয় অনেকে। লজ্জা-শরমের বালাই না করে অনেকে আজকাল বলে বসে "তাহলে আমার উৎসবে এসে তুমিও গরু খাও" বা "দাদা, গরু খাওয়ার দাওয়াত রইলো"! উৎসব সবার-- এর মানে এই নয় যে নিজের ধর্ম নষ্ট করে অন্যের উৎসবে যোগ দেওয়া বা যেটা খাওয়া আমার ধর্ম বা পরিবার থেকে নিষেধ আছে, তা খাওয়া বা করা। আমি গরু খাই না জেনে আপনি আমাকে ঈদের দাওয়াত দিলে আমার জন্য আলাদা করে মুরগি বা খাসি রান্না করবেন। আবার আমি পূজায় আপনাকে দাওয়াত দিলে দেব-দেবীর প্রসাদ আপনাকে জোর করে খাওয়াব না, আপনাকে দেবো আলাদা পাত্র থেকে। আর শুকর তো কোনোদিন খাইনি, তাই জোর করে খাওয়ানোর প্রশ্নই আসে না।
গরু কেন খাওয়া নিষেধ? ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ বাদ দিলে আমি যেটা বুঝি, ব্যক্তিগতভাবে আমি মায়ের দুধ খেয়েছি মোটে ১৩ দিন, তারপর থেকেই গাভীর দুধ, কৌটার হরলিক্স-ল্যাক্টোজেন ইত্যাদি খেয়ে বড় হয়েছি। তাই জন্মদাত্রী মায়ের মতো গরু(গাভী)-ও আমার কাছে মা। মায়ের মাংস আমি খাই না। ফুল স্টপ। অনেক হিন্দু হয়তো খেতে পারে নানা ধান্দায়, আমি খাই না। আমি আশা করবো আপনি আমার বন্ধু-সুহৃদ হলে আমার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান প্রদর্শন করবেন।
বড় হয়ে ঢাকায় গেলে নটরডেম কলেজ, বাকৃবি ও ঢাবিতে ইফতার পার্টি করেছি অনেক। বিশেষত ঢাকা থেকে ঈদের আগে বাড়ি ফিরলে শেষ রোজা বা তার আগের দিন স্কুলের বন্ধুরা মিলে ইফতার করতাম, এখনও করি। এটা একটা ঐতিহ্য। এই উছিলায় বছরে অন্তত একদিন সবার সাথে দেখা হয়, আড্ডা হয়। টাকা সবাই দেই, কিন্তু একসাথে বসে খাই। বাকৃবিতে পড়াকালীন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে ইফতারের দিনগুলো মনে পড়ে। ঢাবিতে পড়াকালীন টিএসসি ও কার্জনে কত শত ইফতার যে করেছি! ইফতার করেছি স্টারেও। ইফতার শেষে অনেকে দেখি ছবি তুলে প্যাকেটগুলো যেখানে-সেখানে ফেলে চলে যায়। আমরা এ কাজ করিনি কোনোদিন। টিএসসির মাঠ, ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সামনের মাঠ বা সিঁড়ি আর শহীদুল্লাহ হলের পুকুরের সিঁড়ি আমার ফেভারিট ইফতার স্পট। মনে পড়ে সিএ ভবনের ছয় তলায় পল্লব ভাইয়ের গামলায় মাখানো ইফতারির কথাও। খুব মিস করি ঢাকাকে, ঢাবিকে। ৮ বছর হলো ঢাকার বাইরে।
রোজা রাখার ধর্মীয় দিকের পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত দিকও আছে। যদি আপনি সত্যিকারের সিয়াম সাধনা করেন, তাহলে এই রোজাই আপনার জন্য একটা প্রপার ডায়েট হতে পারে। আপনার মেদ কমতে পারে, স্বাস্থ্য উন্নত হতে পারে। হতে পারে মানে হবে। পাশাপাশি আপনি গরিবের কষ্টও উপলব্ধি করতে পারবেন, যারা পর্যাপ্ত ভালো খাবার পায় না। এই শিক্ষা থেকে আপনার মাঝে সৎপথে চলার, গরিবের উপকার করার ও দুর্নীতি-অতিরিক্ত লোভ না করার ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত হতে পারে, যা জগতের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু সকাল আর দুপুর না খেয়ে সেই পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি খাবার সন্ধ্যা, রাত আর ভোরে খেলে স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, মেদ আরও বাড়তে পারে।
আপনাদের আছে রোজা আর হিন্দুদের আছে উপোস। উপোসেও মেদ করে, শরীর থেকে অনেক বিষ বেরিয়ে যায়। কালীপূজার উপোসই দেখেছি সবচেয়ে বেশি সময়ব্যাপী থাকতে হয়। আমার মাকে দেখি আগের রাত ১০ টায় খেয়ে পরের দিন পেরিয়ে গভীর রাত ৩টায় পূজা শেষে জল মুখে দিতে। এই বয়সে এমন নির্জলা উপোস করতে নিষেধ করলেও মা শোনে না। বলে, "ছোট থেকেই করে আসছি, চিন্তা করিস না মায়ের কৃপায় আমার কিছু হবে না"।
এই যে "...আমার কিছু হবে না" বিশ্বাস, এটাই স্রষ্টায় আস্থা আর এটাই ধর্ম। ধর্ম মানেই বিশ্বাস। যে বিশ্বাস নিয়ে আজ থেকে আমার বন্ধুবান্ধব রোজা রাখা শুরু করলেন, আমি প্রার্থনা করি তাদের সেই বিশ্বাস পূর্ণতা পাক, দোয়াগুলো কবুল হোক আর মনের শুভ ইচ্ছাগুলো পূরণ হোক। কিন্তু আপনার উৎসব যেন অন্যের জন্য কষ্টের কারণ না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, দেশে অনেক অমুসলিম আছে, আছে অনেক অসুস্থ, শিশু, প্রতিবন্ধী, গরিব খেটে খাওয়া মানুষ যারা রোজা রাখে না বা রাখতে পারে না। তাদের জন্য হলেও খাবারের দোকানগুলো খোলা রাখবেন প্লিজ। সবার তো আর বাড়িতে মা বা স্ত্রীর হাতের খাবার কপালে জোটে না! আমাদের পূজায় যেমন মাদক আর ডিজের অত্যাচারে শব্দদূষণকে আমি প্রতিবার রুখে দাঁড়াই, আমি চাই আমার বন্ধুরাও কতিপয় স্বার্থান্বেষীকে রুখে দিবেন যারা মানুষকে না খাইয়ে রেখে কষ্ট দিয়ে উগ্রতা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে শুধু নিজেদের কথা ভেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার ও বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে একপন্থী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে।
সবাইকে জানাই রামাদান মোবারক।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০২৫ সকাল ৭:৩৩