২০০৩ সালের দিকে অভ্র নামে কম্পিউটারে বাংলা লেখার একটা সফটওয়্যার বাজারে আসে। একজন ভিন্ন পেশার মানুষ এবং তার কিছু বন্ধুদের নিয়ে এই দুরহ কাজটি সম্পাদন করেন আমাদের মত মানুষদের জন্য যাদের জন্য কম্পিউটারে বাংলা লেখা খুব কষ্টকর ছিলো। পরবর্তীতে যখন অ্যানড্রয়েড ব্যবহার শুরু হয়, তখন রিদ্মিক নামে একটা সফটওয়্যার ব্যবহার করা শুরু করেন অনেকেই। দুটো সফটওয়্যারই ফোনেটিক বাংলা লেখার জন্য তৈরি। গত ১০ বছরে আমার ধারনা মতে ১০০ জনে মাত্র ১ জনকে বাংলা লেখার জন্য অন্য সফটওয়্যার ব্যবহার করতে দেখেছি। বাদবাকি সবাই এই সফটওয়্যার দুটোই তাদের ডিভাইস অনুযায়ী ব্যবহার করে থাকেন।
এবারে আমি আমার নিজের কথা বলি। আমি প্রথমে কম্পিউটার কিনে খুব ঝামেলায় ছিলাম বাংলা লেখা নিয়ে। caps lock আর shift চেপে বিজয় কিবোর্ড দিয়ে বাংলা লেখা এতটাই কষ্টকর ছিলো যে আমি খুব জরুরি হলে নীলক্ষেতে যেয়ে কাজ করায় আনতাম। হঠাত একদিন আমার এক শুভাখাঙ্খি বাসায় বেড়াতে এসে আমার এই দুরবস্থা দেখে আমাকে বলে অভ্র ব্যবহার করতে। ভাবলাম দেখি চেষ্টা করে।ব্যবহার শুরু করে আমার পুরো সফটওয়্যারের কাজ শিখতে লেগেছে মাত্র ১দিন। এরপরে আমার কাজে দ্রুততা আনতে লেগেছে খুব বেশি হলে ১৫ দিন। এখন যেটাই করিনা কেন, এইটা দিয়েই করি। বেশ অনেকদিন ব্যবহারের পরে শুনলাম এই সফটওয়্যার-এ নাকি বিজয় কিবোর্ড দেয়া আছে, যেটা কপিরাইট আইনে দোষ। ওইটা বাদ দিয়ে যে আপডেট আসলো সেটায় সম্ভবত একটা ভাল বাংলা শব্দভান্ডার যুক্ত করা হয়েছিলো। যেটা ফোনেটিক দিয়ে ধারে কাছে কিছু লিখলেই সঠিক শব্দ সাজেশন দেয়া শুরু করে। সর্বশেষ আপডেটটা তো আরো ভাল কারন এইটা আপনার লেখার ধাঁচ মনে রেখে(artificial intelligence) আপনার নিজস্ব বানান অনুযায়ী শব্দ বসাতে সাহায্য করে।
এরপরে কালক্রমে অ্যানড্রয়েড সেট কিনলাম। প্রথমেই বাংলা লেখার জন্য কিবোর্ড খুজতে গিয়ে দুই একটা ট্রায়াল দিয়ে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়, তখন পাই রিদ্মিক। দেখলাম পুরাই অভ্র-এর অ্যানড্রয়েড ভার্শন। ওমনি ডাউনলোড, তারপরে ব্যবহার, এর চাইতে আনন্দ মনে হয় প্লে স্টোর থেকে আর কোন সফটওয়্যার ডাউনলোড করে পাইনাই।
এবার আসি অন্য একটা প্রসঙ্গে। আগেই একবার লিখেছি, অভ্র একটা দোষ করেছে বিজয় লে-আউট ব্যবহার করে। এই ব্যপারে কিছু বলার আগে কয়েকটা কথা বলি। মোস্তফা জাব্বার নিঃসন্দেহে একজন পথিকৃৎ তার বিজয় সফটওয়্যার এর জন্য। কিন্তু তার হিংসাত্মক একটা মনোভাব আছে। অহংকারের জন্য তার সাথে একমাত্র তুলনা চলে স্টিভ জবস এর। দুইজন-ই চরম অহংকারি এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত উনি শান্তি পাননা। অভ্র নিয়ে উনি তার উদ্ভাবককে কিছু না জানিয়েই মামলা করে দিয়েছিলেন তাকে হেয় করার জন্য। পরে জনরোষে প্রাপ্য সম্মান দিয়েছেন(বলা উচিত বাধ্য হয়েছেন)। কিন্তু বিজয় কি তার আগের জায়গা ফিরে পেয়েছে? ২০০টাকা খরচ করে একটা ঝামেলা কয়জন কিনেছে? ২০০৪ এর পরে যারাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছে তারা কম বেশী ফোনেটিকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেখানে বিজয়ের মত complex সফটওয়্যার কেন ব্যবহার করবে মানুষ, এইটা মোস্তফা জাব্বার সাহেবের মাথায় মনে হয় ঢুকছেনা। বাজে ইন্টারফেস থেকে শুরু করে নুন্যতম ৪মাসের নিয়মিত ব্যবহার ছাড়া বিজয় কিবোর্ড দিয়ে কেউ কাজ করতে পারবেনা। যেখানে অভ্র-এর জন্য লাগে মাত্র ১৫ দিন।
নতুন কিছু গ্রহন করতে পারার মানসিকতা সবার থাকেনা। ফ্লাইওভার বানানোর সময় অনেকেই বলেছে কেন দরকার। এখন মেট্রোরেল বানানোর সময় সবাই বলছে কেন দরকার। কম্পিউটার অফিসে কেনা আগে ছিল অপচয়। কিন্তু দিনে দিনে নতুনকে মানুষ গ্রহন করেই নিয়েছে। নিতে হয়েছে। সব সফটওয়্যার কোম্পানি দিন দিন চেষ্টা করছে একজন আরেকজনের চাইতে আগাতে। একবার ভাবেন, অ্যানড্রয়েড ফ্রী, কিন্তু অ্যাপেল এর জন্য টাকা লাগে। তারপরেও কি কোনটার উন্নতি থেমে আছে? মানুষ তো দুইটাই কিনছে সমান তালে। আজ অ্যানড্রয়েড-এ এইটা পেলাম কাল অ্যাপেল ওইটাই দিয়ে দিচ্ছে। অ্যাপেল নতুন কিছু দিলে অ্যানড্রয়েড সেইটা দেয়ার জন্য কাজ করছে। এমন করেই তো উন্নতি হচ্ছে সবকিছুর।
মোস্তফা জব্বার সাহেব মনে করা শুরু করেছেন তিনি একমাত্র লোক যার ভাষা নিয়ে কাজ করার অধিকার আছে। আজকে পর্যন্ত শুনিনি, কারো কোন ভাষার লে-আউটের উপরে অধিকার আছে। তিনি একটা কথা বুঝতেই পারছেনা না যে ২৬টা কি(Key) দিয়ে ৫০টা অক্ষর লেখার জন্য তার তৈরি লে-আউট আর জনপ্রিয় নয়। বরং ফোনেটিক কিবোর্ড সবচেয়ে সুবিধাজনক। তিনি তার কিছু রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে সবাইকে দমিয়ে রাখতে চাচ্ছেন। তার চিন্তাধারা একসময়ের জন্য জনপ্রিয় ছিল, এখন সেটা নেই। আজকে বাংলাদেশে অনেক অনেক ডেভেলপার এসে পরেছে যারা অন্তত তার চেয়ে উন্নত চিন্তার অধিকারি। তার মাথায় এখন পুরাতন ধ্যান ধারনা আছে,আর সেইটার আলোকে বানানো হয়েছে এইবারের বিজয়ের অ্যানড্রয়েড ভার্সন। তার উচিত ছিল প্রতিযোগিতায় আসা। তার উচিত ছিলো সবার আগেই তার প্রোডাক্টের অ্যানড্রয়েড বা আইওএস ভার্সন বের করে আপলোড করা। আপনার যদি কিছু কপিরাইট থেকেই থাকে তাহলে সেটা হওয়া উচিত প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ-এর, লে আউট-এর না। যদি লে আউট কে কপিরাইট করার কথা হয়,তাহলে যে ইংলিশ কিবোর্ড দিয়ে উনি কোডিং করে থাকেন সেইটাও করা উচিত না।
উনাকে গালাগালি করার মত মানসিকতা আমার নাই। শুধু এইটুকু বলব উনাকে আজকে অনেক ছেলেপেলেই অ্যানড্রয়েড এর অনেক অ্যাপ বানায়, কিন্তু বিক্রি করেনা। তারা ফ্রি দিচ্ছি অনেক কিছু। এমনকি আইওএস এর জন্য-ও তাই। কম্পিউটার গেম বানাচ্ছে অনেকে, যেটার ডিস্ট্রিবিউশন হচ্ছে ফ্রি। তারপরেও ২/১টা যা কিনতে হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মানের না হলেও ওইরকম মানে আসার চেষ্টা যে আছে বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু আনন্দ কম্পিউটার এর তৈরি এই বিজয় বাংলা কিবোর্ড পথিকৃৎ হতে পারে তবে এখনের দুনিয়ার জন্য না। অ্যানড্রয়েড আসার আগে সিম্বিয়ান অনেক জনপ্রিয় ছিল কিন্তু অ্যানড্রয়েড সিম্বিয়ানকে টেক্কা দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। এখন এর প্রতিযোগিতা আইওএস এর সাথে। পাশের দেশ ভারতেও এমন অনেক কিবোর্ড এর ডিজাইন হয়েছে, তবে জব্বার সাহেবের মত ছ্যাচরামি কেউ করেনাই। মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি কইরা আওয়ামী লীগ যেমন ভাত পাইতেসেনা, আপনিও পাবেন না। আপনাকে কেই মারবেনা, তবে আপনি মরার সময় আপনাকে ফুল বা সম্মান দিতে অন্তত কোন দেশের ৯৫% ভাগ প্রযুক্তিপ্রেমী যাবেনা। কারন আপনি চরম বাজে, হিংসুটে, অহঙ্কারী, ব্যবসায়ী এবং সংকীর্ণ মানসিকতার লোক।
আমি বলব একুশে পদক দেয়ার যদি কোন ইচ্ছা থাকে অভ্র টিম কেই দেয়া হোক কারন দেশের সব স্মার্টফোন ব্যবহারকারী এবং বর্তমান প্রজন্মের কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা অভ্র দিয়ে সাচ্ছ্যন্দে বাংলা লিখতে পারছে।