গল্প ১ঃ
একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু ছেলের গল্প এটা। ইন্টার পাশ করার করে যে ভর্তি যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধ পার করে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পায় সে। কিন্তু নিজের এলাকার বাইরে হওয়ায় আর পারিবারিক আর্থিক সচ্ছলতা না থাকার কারণে ধার করে, নিজের টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া সহ যাবতীয় খরচ দেয়ার মত সামর্থ্য হচ্ছিলোনা। ভর্তির শেষ তারিখের ৩ দিন আগে, ফেসবুকের কিছু গ্রুপে তার এই সমস্যা জানায় সে কোন উপায় না পেয়ে। এরপরে সেইসব গ্রুপের একটির এডমিন ১দিন পরে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে গ্রুপের সদস্যদের জানায় যে ৮০০০ টাকা প্রয়োজন। ১ ঘন্টায় টাকার যোগাড় হয়ে যায়।
গল্প ২ঃ
রাস্তায় কোন একভাবে একজন ব্যক্তির ব্যাগ হারিয়ে যায়। যিনি ব্যাগটি পান, তার মধ্যে ২০০০০ টাকার বেশি অর্থ এবং কোন একজন ব্যক্তির অপারেশনের যাবতীয় কাগজপত্র ছিলো। যা থেকে আন্দাজ করা যায় যে এই টাকা অপারেশন বা এই সংক্রান্ত কোন কাজেই ব্যবহার করা হবে। তিনি তার ফেসবুক টাইমলাইনে বিষয়টি জানান। তার পরিচিতজনেরা শেয়ার করে বিষয়টিকে ভাইরাল করেন। ছোটবেলায় পড়া "তিন গোয়েন্দা"র "ভূত থেকে ভুতে" টাইপ অবস্থা। ৩/৪ দিন পরে যার টাকা তার সন্ধান পাওয়া যায়। যথোপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে তাকে টাকা বুঝিয়ে দেয়া হয়।
গল্প ৩ঃ
একজন ব্যক্তি তার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য ও নেগাটিভ রক্ত খুজে পাচ্ছিলেন না। ফেসবুকের একটা গ্রুপে তিনি শুধু একটা পোস্ট দিলেন রক্ত লাগবে অমুক হাসপাতালে তার স্ত্রীর জন্য। আবারো একই অবস্থা, "ভূত থেকে ভুতে"-র আধুনিক রূপ ফেসবুক "ট্যাগ" ব্যবহার করে একজন আরেকজনকে জানাতে থাকলেন, কেউ শেয়ার দিলেন নিজের টাইমলাইনে। ৩ ঘন্টায় রক্ত যোগাড় হয়ে গেলো প্রয়োজনের বেশী।
গল্প ৪ঃ
খাবার নিয়ে আলোচনা হয় এমন এক গ্রুপে কেউ একজন পোস্ট করলেন খাবারের রিভিউ। রিভিউ এর সাথে ছিলো বিলের একটা কপি। সদস্যদের কয়েকজন ভ্যাট আর সার্ভিস বিল নিয়ে কথা বলছিলেন। সেখান থেকে উঠে আসে ভ্যাট-এর পরিমাণ। এমআরপি তে ভ্যাট কেনো হবে, কোথায় কোথায় ভ্যাট হয় বা হয়না। এই আলোচনা সেখান থেকে ভ্যাট গোয়েন্দার কাছে, ভোক্তা অধিকার দপ্তরের কাছে পৌঁছায়। সেই খাবারের দোকানের জরিমানা হয়। ভুক্তভোগী ভোক্তা অধিকার দপ্তরের কাছ থেকে অভিযোগ দাখিলের সুবাদে জরিমানার কিছু অংশ ক্ষতিপুরণ হিসেবে পান। সাধারণ জনগণ খুব সাবধান হয়ে যায় এতে। কোথাও ভ্যাট নিয়ে অনিয়ম পেলেই জানিয়ে দেয় ভ্যাট গোয়েন্দার কাছে বা ভোক্তা অধিকার দপ্তরকে। নিয়ম প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ ফেসবুক থেকেই আসে।
এখন আসি, এই সকল ক্ষেত্রে সরকার বা তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান কি করতো।
গল্প ১ঃ
ছেলেটি যেতো তার এলাকার নেতাদের কাছে। ধর্না দিতেই চলে যেত দুইদিন। টাকা যদি পায়ও তাতেও আরো দুইদিন। ছেলেটার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কপাল তো আরো হতই না, সাথে অসংখ্য ডিপ্রেসড মানুষের সাথে ঘুরে নষ্ট হয়ে যেত।
গল্প ২ঃ
যিনি টাকা পেয়েছেন, তিনি সবকিছু থানায় জমা দিতেন, সাথে জিডিও করে আসতেন। মাসের পর মাস যেতো, টাকার মালিককে তো পাওয়াই যেতোনা, বরং থানার ওসি-কন্সটেবল মিলে টাকা মেরে দিতো।
গল্প ৩ঃ
বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে রক্ত ব্যবসা অনেক লাভজনক ব্যবসা। এক ব্যাগ রক্তের দাম ২৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। আর যেসব রক্ত পাওয়া যায়না সহজে সেগুলোর জন্য হাসপাতালের নার্স-এটেনডেন্টরা পানির মত টাকা না দিলে খুজে দিতে সাহায্যও করেনা। সরকারের নিজশ্ব কোন ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে, নাকি কোন প্রতিষ্ঠান আছে যারা রক্ত খুজে দেয়? কাকে বলবে এই লোক রক্তের জন্য? কোথায় যোগাযোগ করবে এই লোক?
গল্প ৪ঃ
নিজের প্রয়োজনের থানায় যেয়ে একটা জিডি করতে চাইনা আমরা। আর সরকারী একটা প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট আদায়ে সাহায্য করতে আমি দৌড়াবো কেনো? সরকার বের করে নিক। এইটা তো আমার দায়িত্ত্ব না। সরকারী চাকুরী যারা করছে তাদের দায়িত্ত্ব এইটা নিয়মিত চেক করা। কিন্তু আজ স্বপ্রনোদিত হয়ে তাদের আমরা সাহায্য করার অনুপ্রেরনা পেয়েছি বা পাচ্ছি কোথা থেকে?
দেশের জঙ্গি বা বিভিন্ন স্থানের সন্ত্রাসী হামলার যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য যদি ফেসবুক দায়ী থেকে তাহলে হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, টেলিগ্রাম, ইমো, স্মার্ট ফোন, ইমেইল সহ সব ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাই দায়ী।
বিষয়টা এমন যে, সার্চ রেজাল্টে অশ্লীল ছবি দেখানোর জন্য গুগল দায়ী। মানবিক অবক্ষয়ের জন্য টিভিও দায়ী, কারণ ভারতীয় সিরিয়াল। বোমা বহনের জন্য ব্যবহৃত হয় বাস, রিক্সা, বাইক ইত্যাদি, তাহলে সেই হিসাবে যানবাহন দায়ী। যেই প্রতিষ্ঠান যানবাহন বানায় দেশে, তারাও দায়ী, কারণ তারা না বানালে তো আর যানবাহন পেতো না সন্ত্রাসীরা। যারা স্মার্ট ফোন, টিভি আমদানী করে তারাও দায়ী, কারণ তারা না আনলে তো আর এইসব ব্যবহার করতে পারতাম না।
সবকিছুরই ভালো খারাপ আছে। ৮০ হাজার টাকার আইফোনেরও ভালো খারাপ দিক আছে। কোটি টাকা দিয়ে বিমান কিনলেও সেইটার ভালো খারাপ আছে। আমি নিজে কিভাবে এইসব ব্যবহার করছি সেইটাই ভালো খারাপ নির্ধারণ করে। ফেসবুকে সামাজিক অবক্ষয় হলে যা ভালো কাজ হচ্ছে সেইগুলোও কি খারাপের তালিকায় চলে যাবে। ফেসবুক বন্ধ করে দিলে কি লাভ হবে সেইটা জাতি জানতে চায়। আর বন্ধ করলে কিভাবে করবে? এমনভাবে করবে যাতে ভিপিএন দিয়েও ব্যবহার করা না যায়? নাকি খালি ভুংভাং, আগের মতোই। কয়টা সন্ত্রাসী হামলা ঠেকানো যাচ্ছে এইটা দিয়ে সেইটাও জানানো উচিত। ফেসবুক ছাড়া বাকি যোগাযোগ মাধ্যমের কয়টা ঠেকানো হচ্ছে এবং ওইগুলা দিয়েও যে সন্ত্রাসী হামলার প্ল্যান হচ্ছেনা, সেইটাও কনফার্ম করতে হবে সরকারকে। আর সাথে মানবিক অবক্ষয় রোধে ভারতীয় টিভি সিরিয়াল আর প্রশ্ন ফাঁস কবে বন্ধ হবে, সেইটাও জানাতে হবে সরকারকে।
আমার মনে হয় এইটুক উত্তর দিতে এই "চালাক" সরকারের খুব বেশী সময় লাগার কথা না। তাই উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
বিদ্রঃ এইখানে লেখা একটা গল্পও বানানো না, সত্যি ঘটনার ছোট্ট ধারণা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৫:০৪