পলিমারিক চেইন রিএ্যাকশন বা পি সি আর-এর কাজ হল কোন একটা স্পেসিফিক ডি এন এ সিকোয়েন্সকে অ্যাম্পলিফাই করা। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা কোড লুকিয়ে থাকে একেকটা সিকোয়েন্সে। সিকোয়েন্স অ্যাম্পলিফাই করলে ভাল বোঝা যায়।মাঝে মাঝে জীবনের সাথে অনেক মিল পাই পি সি আর-এর।জীবনের একেকটা পর্যায়ের একেকটা সময়কালকে অ্যাম্পলিফাই করলে স্মৃতির পাতায় উঠে আসে একেক সময়ে একেক মানুষের ভূমিকা।পরিস্থিতি ও সময়ের সাথে সাথে কারেক্টার চেন্জ হয়ে যায়। লাইফের কোন এক সময়ে যাকে কিংবা যাদেরকে ছাড়া চলতোই না একটা সময় পর দেখা যায় তার বা তাদের কোন খবর নাই।কে কোথায় কিভাবে আছে জানিও না। প্রতিযোগীতার পৃথিবীতে টিকে থাকতে নিজের মাঝে স্বার্থ্পরতার প্রলেপ মেখে পাথর করে ফেলি নিজেকে।তবুও স্মৃতি ঘাঁটলে ভাবি নিশ্চয়ই সেই মানুষগুলো ভাল আছে।ভাবি যে জীবনটা্তে এমন অনেক মানুষ ছিল যাদের সাথে আবার দেখা হবে।পুরোন সময়ের মত হয়ত আবার কিছু সময় পার করা হবে নতুন আঙ্গিকে।কিন্তু স্রষ্টার বেরসিকতায় অনেক হিসেব মিলেনা! মনে হয় অনেককিছু বাকি রয়ে গেল।
খুব ইচ্ছা করে এক বুড়ির সাথে দেখা করতে।আমাদের বাসায় ছোটবেলায় সে দুধ দিত।হিন্দু এক বুড়ি।খুব রসিক ছিল।অনেক মজা করত বাসায় এসে।মাঝে মাঝে আমাদের জন্য মজার মজার সব খাবার বানিয়ে আনতো।আর পূজা-পার্বণ হলেতো কথাই নাই।এটা-সেটা খাবার,প্রসাদ এনে আমাদের রান্নাঘর ভরিয়ে ফেলত।আমাদের বাসায় দুধ দেয়া ছাড়াও আম্মুর এটাওটা কাজও করে দিত মাঝে-মাঝে।চা-বিস্কুট ছাড়া অন্যকিছু কখনো চাইতনা।আম্মু ঈদ এলে বুড়িকে কাপড় দিত।সেই ক্লাশ ফোর কি ফাইভ থেকে শুরু করে ভার্সিটি উঠার পর পর্যন্ত দেখতাম বুড়িকে। ঝড়-ঝাপটা,বৃষ্টি-বাদল যাই হোক না কেন বুড়ি ভিজতে ভিজতে ঠিকই এসে হাজির হত।শেষের দিকে বুড়ির গরু ছিলনা।দুধ দিতে পারতোনা। এমনিতে আসতো।একবার ভার্সিটি বন্ধে বাসায় গিয়ে শুনি বুড়ি প্রচন্ড অসুস্থ।আম্মুকে বলে ঠিক করলাম একদিন দেখতে যাব।ওমা! কার কাছ থেকে খবর পাইছে আমি বাসায় আসছি।শুনে এই শরীর নিয়ে সে হাজির।কথাও বলতে পারছিল না ঠিকমত।বলা বাহুল্য বুড়ির বাড়ি ছিল আমাদের কলোনী থেকে তিন-চার মাইল দূরে।রিকশায় করে আসার সামর্য্ন ছিলনা বলে পায়ে হেঁটে আসত।বাসায় এসে কাশতে কাশতে শেষ।আমাকে দেখে বলত ‘ভাল আছিস বাউ(বাপ)’।আমি লজ্জা পেয়ে যেতাম।মানুষের এত নিখাদ ভালবাসা পাবার যোগ্য মনে হতোনা নিজেকে।শুধু বলতাম ‘বুড়ি কি খবর ভাল আছ’। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম কখনো অনেক টাকা-পয়সা হলে বুড়ির হাতে দিব।বুড়ি তখন কি করে দেখব। আমরা যখন দিনাজপুর ছেড়ে চলে আসি তখন বুড়ি প্রচন্ড কেঁদেছিল। কত ইচ্ছা ছিল সময় করে কোন একদিন দিনাজপুরে গিয়ে বুড়ির বাড়ি যেয়ে তাকে চমকে দিব।হিসাব মিললো না।দেশ ছেড়ে বাইরে আসার পর একদিন ছোটবোনের কাছে শুনলাম বুড়ি মারা গেছে।তাও আমাদের বাসার সবাই শুনেছে তিন মাস পর।
আর আজকে শুনলাম আরেকজনের কথা।মিলন ভাই।চির সবুজ এক লোক।আমাদের চেয়ে কয়েক বছরের সিনিয়র।আমাকে ডাকতো ‘জন্টি’।ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট খেলতাম প্রচুর।শুকনা-পাতলা ছিলাম বলে ফিল্ডিংয়ে উল্টা-পাল্টা ডাইভ দিয়ে ক্যাচ ধরে ফেলতাম।মিলন ভাই আদর করে তখন থেকেই ডাকা শুর করেছিল সাউথ আফ্রিকার কিংবদন্তী ফিল্ডার জন্টি রোডসের নামে।একটা সময়ের কথা আজ এত মনে পড়ছে।২০০৭ সালের দিকের কথা।ভার্সিটি কেবল ভর্তি হইছি।ক্লাশ শুরু হতে কিছুদিন বাকি।আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে ছাদে আসতাম রাত বারোটার দিকে।মিলন ভাইও আসত।মিলন ভাইয়ের একটা একটেল সিম ছিল।রাত বারোটার পর তখন প্রথম ২ মিনিট কথা বললে পরের আধঘন্টা ফ্রি ছিল।মিলন ভাইকে দিয়ে তার সিমে রিচার্জ করাতাম।এরপর শুরু হত আমাদের বাঁদরামি।উল্টা-পাল্টা নাম্বার ডায়াল করে মানুষের সাথে ফাজলামি।মেয়ে পাইলেতো কথাই নাই।মিলন ভাই তার এক বান্ধবীর সাথে কথা বলত।আর আমরা অপেক্ষায় থাকতাম কখন কথা শেষ হয় সেটার।তার সাথে ডিল ছিল যে আকাশের চাঁদ মাথার উপর থকে যখন পুব আকাশের দিকে সরে যাবে তখন সিম আমাদের দিতে হবে।এরপর চাঁদ ডুবানোর দায়িত্ব আমাদের! টুয়েন্টি নাইন খেলতে বসলে ২৫ থকে কল দেয়া শুরু করতে্ন।২৬,২৭ এমনকি ২৮,২৯ ও ডেকে বসতেন নাঝে মাঝে।আমরা বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে বলতাম ‘ভাই আপনার সাথে মাগনা খেলা যাবেনা।আপনি খেলার পরিবেশ নষ্ট করেন উলটা-পাল্টা ডেকে।বাজিতে খেলব।’মিলন ভাই তাতেও খুশি।এরপর বাজি হারলে বলতাম ‘ভাই হারছেন এখন বিকেলে খাওয়াইতে হবে।’ কিসের কি! বিকালে আর মিলন ভাইকে পায় কে!ওনার একটা সিটিসেল ফোল্ডিং মোবাইল ছিল।রাফ ইউজ করার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিল সেই মোবাইল।ক্রিকেটের ক্যাচ খেলা থেকে শুরু করে ঢিল হিসেবে গাছের আম পাড়া সবই করা হত ওই মোবাইল দিয়ে।এত মজার একটা মানুষ অথচ তিনি কিন্ত আবার প্রচন্ড ধার্মিক ছিলেন।কোন গোড়ামি ছিলনা।ভার্সিটি উঠার পর নতুন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বিজি হয়ে গেছিলাম।মিলন ভাইও চাকরী করতেন।যোগাযোগ কমে গেছিল।শুধু ঈদের ছুটিতে বাসায় গেলে দেখা হত।মাঝেমাঝে হঠাৎ মধ্যরাতে অজানা নাম্বার থেকে কল করে বলত ‘ভাই আপনি কি সলিম উদ্দিন? আমার নাম্বারে ফ্লেক্সি করতে পারবেন ২০ টাকা’ প্রথমে ভয়েস চিনতে না পারলেও পরে কথা বলার ধরণ দেখে চিনতাম।চিনার পরপরই ওনার সেই চিরচেনা ডাক।‘জন্টি কি খবর,আছিস কেমন?’ জার্মানীতে আসার জন্য আমার ফ্লাইট কনফার্ম তখন।অনেকদিন মিলন ভাইয়ের কোন খবর নাই।আমার কাছে যে নাম্বার আছে সেটা বন্ধ।চলে আসার দুই-তিন দিন আগে কোত্থেকে নাম্বার পেয়ে ফোন করে শান্ত গলায় বলল ’জন্টি, ফ্লাইট কবে?’ সেবার দেখা করে আসতে পারিনি কিন্তু কথা ছিল ফিরে দেখা করব।আজ শুনলাম মিলন ভাইও না ফেরার দেশে চলে গেছেন।প্রায় মাস খানেক আগে গুরুতর এক রোড এক্সিডেন্ট করেছিলেন শুনেছিলাম।এরপর থেকে আই সি ইউ তে।একমাস লড়াই করে অবশেষে......
জীবনটাকে যদি একটা চলমান নাটক ধরা যায় যেখানে আমার নাটকের আমিই প্রধান কারেক্টার।তাহলে আর বাকি সবাই সাইড কারেক্টার।একইভাবে তাদের নিজেদের নাটকে তারা কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিএ।সেখানে আমি পার্শ্ব চরিত্র।আমার নাটকের আগের পর্বগুলোতে তাদের অংশটুকু তারা ভালভাবেই করেছেন কিন্তু আফসোস হচ্ছে যে তাদের নাটকে আমার রোল আমি ঠিকমত করতে পারলাম না।আমারতো আরো অনেকটুকু রোল প্লে করা বাকি ছিল। যাই হোক নাটক চলছে;আমার নাটক।কিন্তু এভাবে একের পর এক পার্ব্র চরিএ হারায়ে গেলে আমার নাটক চলবে কিভাবে!
(পরম করুণাময় আমার প্রত্যেকটা প্রয়াত প্রিয় মানুষকে যেন চির শান্তিতে রাখেন।আমিন)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৪ বিকাল ৪:২৩