গত বছরের মাঝামাঝি সময়ের কথা। সামার টার্মের শেষ পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। বাস থেকে নেমে ইন্সটিটিউটের দিকে এগোচ্ছি।পেছন থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে ফিরে দেখি সোয়েনিয়া। একটা বিশাল ব্যাকপেক নিয়ে কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতে আসতেছে। জিজ্ঞেস করলাম-
‘কি ব্যাপার। কই যাচ্ছো।’
‘এক্মাম শেষে বাসায় যাব।যাবার ট্রেন অলরেডি বুকিং দেয়া হয়ে গেছে।এক্সামের আধ ঘন্টা পরেই ট্রেন। এজন্য একেবারে বাক্স-পেটরা নিয়ে চলে আসছি।‘
শুনে হাসলাম।জিজ্ঞাসা করল হাসছি কেন। বললাম, 'না এমনি।' এরপর নিজেই বলল, ‘আসলে অনেকদিন পরে যাচ্ছি দেখে একটু এক্সাইটেড।’
‘বাসা কতদূর তো্মার, মানে কতক্ষন লাগে যেতে’
‘এইতো আই.সি.ই-তে (এখানকার হাইস্পীড ট্রেন) যেতে ঘন্টা দেড়েকের মত।’
‘ও আচ্ছা, আচ্ছা।’
‘আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি তখন কেন হাসছিলে তুমি।’
‘কেন?’
‘তুমি কি আমার বাড়ী যাবার ব্যাপারটার সাথে তো্মারটার তুলনা করেছ?’
এবার একটু হেসে বললাম, ‘না,না। আমার অভ্যেস আছে। এর আগে ব্যাচেলর-এ যখন দেশে ছিলাম তখনও ভার্সিটির ডর্মে থাকতাম।তখনও অনেকদিন পর বাসায় যেতাম।’
‘তোমার প্লান কি তাহলে সামারে।’
কথার জবাব দিতে গিয়ে দেখি এক্মাম হলে চলে আসছি। সেদিন কি যেন হল হঠাৎ। পরীক্ষার মাঝে বারবার মনে হচ্ছিল কলমটা যেন বিমান হয়ে গেছে আর পরীক্ষার খাতাটা রানওয়ে।খাতা ধরে উড়ে যেতে চাচ্ছে কলমটা।না, উড়ে যায়নি ওটা শেষমেষ। পরীক্ষা শেষ হওয়া অবধি সেটাকে হাতেই দেখেছি।আমার ক্লাশমেটকে অবশ্য দেখিনি পরীক্ষা শেষে।
ওইদিন বাসায় এসে ভাবলাম সোয়েনিয়াকে বলা কথাটা মনে হয় ঠিক না। দেশে থাকতেও বাবা-মা’কে ছেড়ে দূরে থাকতাম সত্যি কিন্তু তাই বলে এতদিন! বাবা-মা, ভাই-বোন নাই, পরিচিতজন নাই, চেনা পরিবেশ নাই। পরিচিত সেই খাবার-দাবার গুলোও তো দেখিনা সেই কতদিন।
কতদিন, হুম?
যে কোন কারণেই হোক সবাইকে ছেড়ে আসার সেই শেষদিনগুলোর কথা ভাবতে ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে। আইয়ুব বাচ্চুর সাবিত্রী রায় নামের গানের একটা লাইনের মত। ‘ঘোর লাগা সেই সময়ের কাছে স্বর্গ নয় কিছু।’ হুম,ঘোরই তো! সবকিছু কেমন খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য। কিছুদিনের মধ্যেইতো ফিরে আসতেছি।বিশ্বাস করুন, মা’কে,আত্মীয়-স্বজনদেরকেও সেভাবেই বুঝিয়েছিলাম। ‘স্টুডেন্ট হিসেবে যাচ্ছি।চাইলেই যখন ইচ্ছা ঘুরে যেতে পারবো।দেখো ৬ মাসের মধ্যে একবার এসে ঘুরে যাব।’ ফ্লাইট যেদিন তার ঠিক ৩ দিন আগে ঢাকা চলে আসলাম। ওই সময় দেশের কি উত্তাল পরিস্থিতি! আস্তিক-নাস্তিক ক্যাচাল আর হেফাজতে ইসলামীর ঢাকা অবরোধের কারণে আব্বা বললো আগেভাগে ঢাকা চলে যেতে। না জানি সামনে কখন কি হয়। মা চেয়েছিল সাথে আসতে।বাবা রাজি হননি। সন্ধ্যায় মা গরুর মাংস আর ভুনা খিচুড়ি রান্না করলো। আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার কিনা! রাতের ট্রেনে চলে আসার সময় অভিনয়টা খারাপ হয়নি একেবারে।
‘আব্বু, মাকে ফোন করিস।ঠিকমত পৌঁছাইছিস কিনা জানাইস।’
‘কি সব বলোনা। ফোন করবোনা এটা আবার কি কথা! তোমাকেনা বললাম আমাকে ভুনাখিচুড়িটা রান্না শিখায়ে দিতে, ভুলে গেছো`? আচ্ছা ঠিক আছে।গিয়ে প্রথমেই ফোন করে এই খিচুড়ী রান্নাটা শিখে নিব।তুমি এক কাজ কইরো।এগুলো একটা কাগজে লিখে রাইখোতো।বিদেশ থেকে ফোন করতে অনেক টাকা লাগে। বেশিক্ষন কথা বলা যাবেনা। তুমি কাগজে লিখে রাখলে তাড়াতাড়ি বলে দিতে পারবা।’
এরকম আরো কত কথা।‘আচ্ছা মা, তুমি কি বুঝছো কিছু তখন? দেখছো আমি কত চালাক!’
বাবা আসবেন আমার ফ্লাইটের আগের দিন রাতে। তাই রাতের ট্রেন ধরে চলে আসলাম একা একা।
আসু দেশত্যাগী এক বেচারার কাছ থেকে ওই তিনদিন মোবাইল অপারেটররাও যে যা পারে বাগিয়ে নিয়েছিল। সারাক্ষন এর-ওর ফোন।সবার আবেগের ধকল সামলাতে না পেরে জ্বর-ই চলে আসল।ফ্লাইট ছিল রাত ১০.৪৫-এ। বাবা, নানু আর খালাতো ভাই মিলে গেলাম এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে গিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে।এবার প্রতিপক্ষ নানু।একটু পর পর কথা বলতে বলতে চোখের পানি মোছেন। আমিও অভিনেতার ভূমিকায় অবিচল।একদিকে মা, এবং গ্রামের বাড়ী থেকে বৃদ্ধা দাদী একটু পর পর ফোন করতেছে আর আরেকদিকে নানু... হঠাৎ মনে হচ্ছিল আর সম্ভব না। গলা কেঁপে উঠছে মনে হচ্ছে। তখনি নেটওয়ার্ক প্রব্লেমের দোহাই দিয়ে লাইন কেটে দেয়া।
এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। এয়ারপোর্টে কিছু বড়ভাই, বন্ধু কেন যেন চলে এল। একজন আবার নিয়ে আসলো একটা পতাকা। বললো, ‘নে ।দেশের বাইরে গিয়ে এই ঢাকা-কে যখন মিস করবি, ধোঁয়া আর গ্যাঞ্জামকে যখন মিস করবি তখন এই বস্তুটার দিকে তাকালে আর এটার গন্ধ নিলে শান্তি পাবি।’ শুনে হাসলাম।বোর্ডিংয়ের বেলায় সবার থেকে একেবারে বিদায় নেবার সময় জীবনের অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটল। বাবা জীবনে প্রথমবারের মত বুকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রচন্ড রাগী এবং ইন্ট্রোভার্ট বাবার সাথে কথাই বলা হত খুব কম। অথচ... না, আমি কিন্তু আমার মুখোশ খুলিনি। অভিনয় চলেছে তখনো। আর সবশেষে, প্লেনে উঠার পর যখন ক্রুরা বলছিল, ‘সবাই প্লিজ সেলফোনগুলো অফ করে দিন’- ঠিক তখন বাবার ফোন।
‘বাবা খাওয়াদাওয়া করিস ঠিকমত’
তড়িঘড়ি করে বললাম, ‘ঠিক আছে আব্বু। ফোন সুইচঅফ করে দিতে হবে। আমি গিয়েই ফোন করব।খোদা হাফেজ।’ শেষ কথা, শেষ অভিনয়। বাস্তব জীবনের প্রথম অভিনয় খারাপ করিনি একেবারে।সত্যি বলতে কি অনেককিছুই জীবনে প্রথম ছিল সেসময়। প্রথম প্লেনে উঠা। চেনা শহরটাকে এত উঁচু থেকে দেখা! ট্রানজিট ছিল তুরস্কের ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে।ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। ইস্তানবুলে এসে সম্ভবত প্রথম খেয়াল করলাম আমি অন্য কোন ভুবনে চলে এসছি। কি অদ্ভুত! কি অদ্ভুত! এটাই কি সেই ভুবন যার জন্য এতকিছু। না, ঘোর কাটেনি তখনো। কেটেছে অনেক পরে।কিভাবে? আসব সে প্রসঙ্গে। বিদেশ আসার প্রস্তুতিকালীন সময়ে ঢাকার খিলখেত নিকুঞ্জে ছিলাম কিছুদিন। নিকুঞ্জের খুব কাছেই এয়ারপোর্ট। সন্ধ্যার দিকে প্রায়ই এয়ারপোর্টের সীমানার কাছাকাছি থাকা একটা দেয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম। বিমান উঠানামা দেখতাম। তখন আর এখনকার সময়ের মধ্যে সম্ভবত এই একটা কাজেই সবচেয়ে বড় মিল!তখন মানে কখন আসলে। প্রায়ই অনেকে জিজ্ঞেস করে কতদিন হল।এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ল।জব-এ এক কলিগ’র সাথে কোন একটা খটমটে বিষয় নিযে কথা হচ্ছিল একদিন। ছেলেতা স্মার্ট বেশ।আমাকে বিষয়টা বুঝানোর মাঝে হঠাৎ বলে বসলো, ‘আচ্ছা, তুমি কি কোন কারণে ডিস্টার্বড?’ আমি হেসে বললাম ‘কেন?’
‘মনে হচ্ছে তুমি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছনা।’
আমি বললাম, ‘হুঁ, আমি আসলে প্রায় গত ৭৩০ দিন ধরেই ডিস্টার্বড।’
মানুষের ব্রেইন জিনিসটা কি অদ্ভুত , তাইনা! পড়াশুনা রাত-দিন চেষ্টা করলেও মনে থাকতে চায়না অথচ কত বছর আগের কত হাবিজাবি জিনিষ ঠিকই মনে আছে। এই যেমন এতক্ষন কত তুচ্ছ ছোটখাটো ঘটনা মনে করে বলে দিলাম । পড়াশোনাটা যদি এভাবে মনে থাকতো! আমার এক বাল্যবন্ধু একটা কথা বলতো, কোন একটা সিস্টেমকে সবচেয়ে ভালভাবে বুঝতে হলে নাকি সেটার বাইরে থেকে দেখতে হয়। সিস্টেমের ভেতর থেকে নাকি বুঝাটা কঠিন। ইদানীং মনে হচ্ছে কথাটা সত্যি। নাহলে কি আকাশ কালো করে মেঘ জমলে ঝুম বৃষ্টিসহ বজ্রপাত শুনতে ইচ্ছা করে! কিংবা ভরা পূর্ণিমাতে বাইরে বেরোলে কেন মনে হয় ইশ, এখন যদি একটু কারেন্ট চলে যেত! বাস/ট্রেনে সামান্য ভিড় হলে কেন মনে হয় আরে কি ব্যাপার দরজা/জানালা খুলে দিচ্ছেনা কেন। ঝুলাঝুলি করে যাবার জায়গাগুলো নষ্ট হচ্ছে শুধুশুধু। ঈদ,পূজা,ফাল্গুন, বইমেলা উফফফফফ... আর ওই-যে সেদিন ইংল্যান্ডের সাথে খেলায় রুবেল হোসেন ওদের শেষ উইকেট উপড়ে ফেলার পর কেন মনে হল এখুনি একটা মিছিল বের হবে বুঝি।বুঝেছি বন্ধু, হুম সিস্টেমটা মনে হয় বুঝেছি এইবার।একটু আগে ঘোরের কথা বলছিলাম না ? সেই ঘোরটাও কেটেছিল সিস্টেমটা বুঝার পরই।
এলোমেলো কথার শেষ টানা উচিৎ। এখানে আসার আগে স্বাভাবিকভাবেই জীবনে কখনো তুষার দেখা হয়নি। একদিন রাতে বাসায় ফিরছি।শীতে এখানে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যায় অবশ্য। হঠাৎ দেখি সাদা তুলার মত কিছু একটা পড়ছে গায়ে। সোডিয়াম বাতির আলোয় প্রথমে না বুঝলেও পরে ঠিকই বুঝলাম এটাই সেই তুষার।বুঝলাম এবার ভাল শীত পড়বে সামনের দিনগুলোয়। সাথে সাথেই কেন যেন মনে হল ইশ,ডর্মের সামনের লনটায় একটু আগুন জ্বালাত যদি কেউ ।একটু যদি আগুন পোহানো যেত।৭৩০ দিনের জমে থাকা বরফপিন্ডটা একটু গলাতে পারতাম তাহলে!
পাদটীকা:
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ কোটিরও বেশী বাংলাদেশী প্রবাসে আছেন। সংখ্যাটা যদি এক কোটিও হয় তবু জেনে রাখবেন ২ কোটি চোখ গভীর
মমতা দিযে দেশটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাঁদের চোখের আলোয় দেশ আলোকিত না হয়ে পারে?