somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অভিজ্ঞতাঃ বিদেশীদের বাংলাদেশ ভাবনা ও আমাদের ভাবমূর্তি

০৩ রা মে, ২০১৮ রাত ১০:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবিঃ প্রবাস জীবনের এক বছর পূর্তিতে বন্ধুদের সাথে (২০১৪)

একদিন সন্ধ্যায় ট্রামে করে ফিরছিলাম। আমরা দুই বন্ধু গল্প করছিলাম। পাশ থেকে একজন বলে উঠল, ‘আপনারা কি বাংলাদেশী?’ চেয়ে দেখি মাঝবয়স্ক এক সাদা চামড়ার ভদ্রমহিলা। মুখে চাপা হাসি। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে বললাম, ‘জ্বি। আপনি বাংলা পারেন?’ উত্তরে বললেন- ‘না, তেমন পারিনা। তবে কিছু লাইন জানি।’

একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা। ভদ্রমহিলা বললেন যে উনি জার্মান হলেও কর্মসূএে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। নিউ ইয়র্কে বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকায় ১৫ বছরের মত ছিলেন। অনেক বাঙ্গালী বন্ধুবান্ধব জুটে গেছিল তখন। উনি তাদের বিভিন্ন উৎসব, পারিবারিক দাওয়াতে যেতেন। বলতে বলতে এক লাইন বাংলা গানও গেয়ে ফেললেন।"বেলা বয়ে যায়..."-কোন গান সেটা ধরতে পারলাম না যদিও তবে এটা ধরতে পারলাম যে এই ভাত-মাছ খাওয়া মানুষগুলোকে উনি ভালোই পছন্দ করেন। সেটা প্রায় বছর তিনেক আগের কাহিনি। এরকম কোন বিদেশী যদি বলে যে সে বাংলাদেশকে চেনে কিংবা আমাদের ব্যাপারে জানে তখন কতটা ভালো লাগে সেটা যারা এরকম পরিস্থিতিতে পড়েছেন তারাই জানেন। যদিও সবাই যে ভাল কোন সূত্রে চেনে তা কিন্ত না। আমার ছোট্ট অভিজ্ঞতা থেকে সততার সাথে বলতে গেলে আমাদের আসলে এখনও বিশ্বমানচিত্রে সুস্পষ্ট ও জোরালো কোন অবস্থান নেই। ‘ইমেজ’ বলতে যেটা বোঝায় সেটা আমাদের ভালো না আবার খারাপও না। হ্যাঁ, আমাদের পরিচিতি আছে কিছু কিছু জায়গায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। সেটা হতে পারে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোন ল্যাবে কিংবা কোন কমিউনিটিতে। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট দেশটার একটা ইমেজ বা ভাবমূর্তি দাঁড় করানোর জন্য আমাদের আরো অনেকদূর পথ পাড়ি দিতে হবে, আরো অনেক কিছু করতে হবে। এটা নিয়ে নিঃসন্দেহে অনেক দ্বিমত কিংবা তর্ক হতে পারে। সেদিকে যাচ্ছিনা। আমি বরং এরকম কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলব যেখানে আমাদের দেশ নিয়ে বিদেশীদের ভাবনা জানার সুযোগ হয়েছে।

২০১৩ তে যখন প্রথম বিদেশে আসি তখন একদিন বিকেলে আশেপাশের বাঙ্গালী সবাই মিলে ফুটবল খেলতে গেলাম। খেলার মাঝেই হঠাৎ দেখলাম এক বুড়ো লোক হাতে একটা জার্সি নিয়ে এদিক সেদিক দৌঁড়াচ্ছে আর ছেলেপেলে সবার নাম ধরে ডাকছে। মাথায় বেসবল ক্যাপ। খেলা শেষে পরিচিত হলাম। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে বললেন তার নাম হার্টম্যান। পরে ছেলেপেলের কাছে শুনলাম এখানকার বাঙ্গালী কমিউনিটির এক অকৃএিম বন্ধু এই লোকটি। খুবই বন্ধুবৎসল এবং বিনোদনপ্রিয় এই ভদ্রলোক একজন রিটায়ার্ড চাকুরীজীবি। নিঃসন্তান। রাইন নদীর পাড়ে এক বাসায় একা একা থাকেন। নিজের পুরো সময়টা এর-ওর কাজে সাহায্য করে বেড়ান। নতুন কেউ আসলে বাসা খুঁজে দেয়া থেকে শুরু করে কেউ অসুস্থ্য হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবই করেন। মজার ব্যাপার হল আমাদের ঈদ-পুজো কিংবা পহেলা বৈশাখে উনি বাসায় দাওয়াত দেন সবাইকে। ফুটবল পাগল হলেও আমাদের ক্রিকেট উম্মাদনা দেখে বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি পরে উনি ক্রিকেট দেখেন। ক্লিভ শহরে অবস্হিত রাইনভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোন বাঙ্গালী ছেলেমেয়ে পাওয়া যাবেনা হয়ত যে হার্টম্যানকে চেনে না কিংবা তাঁকে পছন্দ করেনা। আমি কিছুদিন পর ওই শহর ছেলে চলে আসি যদিও তবু যোগাযোগ রয়ে গেছে এতদিন পরও। ফোন করলে প্রথমেই বলে, ‘হার্টম্যান ফ্রম বুড়িগঙ্গা। কি খবর বন্ধু মহসীন? আজকের গরম দেখেছ? শিতাগং (চিটাগং) কে ছাড়িয়ে গেছে!’ বেচারার খুব ইচ্ছা বাংলাদেশে ঘুরতে যাবার। অনেকে দাওয়াতও দিয়েছে। তবে শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য ডাক্তারের নিষেধ আছে দীর্ঘ ফ্লাইটে না চড়ার ব্যাপারে।


ছবিঃ মি. হার্টম্যান। সৌজন্য: ফেসবুক

আরেকটা ঘটনা বলা যাক। জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য বের হয়েছি। ট্রাম ধরে ৫ মিনিট যেতে হবে। দেখি স্টেশনে এক বাঙ্গালী ভাই দাঁড়িয়ে। সাথে এক আফ্রিকান। বেশ লম্বা গড়ন। পাশে গিয়ে হ্যান্ডশেক করার পর পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘কি বন্ধু ভালো আছো?’ শুনে আমি আক্ষরিক অর্থেই কয়েক মুহূর্তের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অবস্থা দেখে বাঙ্গালী ভাই হাসতে হাসতে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘সে বাংলাদেশে পড়াশোনা করেছে। আউ ইউ টি তে। ক্যামেরুনের ছেলে। নাম আবাকা।’ চমৎকার হাসিখুশি এই ছেলেটিও বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে গেছে। বাংলাদেশ নিয়ে কি কি জানো জিজ্ঞেস করলে একটু একটু বাংলায় উত্তর দেয়। বলে, ‘ভাই হরতাল ভালো লাগে। রাস্তা ঘাট ফাঁকা থাকে। আর ভালো লাগে গাজীপুর-ঢাকা বাস জার্নি।’ গাজীপুর থেকে মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতো সে বন্ধুদের সাথে। ঝুলে ঝুলে যাবার অভিজ্ঞতাও নাকি আছে। সে বলে যে, ‘তোমাদের দেশে থাকতে তো অনেক বিয়ে খেয়েছি। তোমাদের বিয়ের খাবার গুলো খুব মজা।’

খাবারের কথা আসায় এক জার্মান ছেলের কথা মনে পড়ল। বিদেশীরা তো ঝাল খাবার কম খায়। পছন্দও কম করে। অন্ততঃ আমরা তেমনই জানি। এই ছেলে তার ডর্মমেট এক বাঙ্গালীর হাতে প্রচুর ঝালযুক্ত দেশি খাবার খেয়ে এত মুগ্ধ যে সে এখন বাংলাদেশের মেয়ে বিয়ে করতে চায় যে তাকে বাংলাদেশের ঝাল রান্নাগুলো শেখাবে এবং মাঝে মাঝে রেঁধে খাওয়াবে। তার জন্য ওই বাংলাদেশী ছেলেকে এখন প্রায়ই দেশ থেকে শয়ে শয়ে মশলা আনাতে হয়। এই হচ্ছে অবস্থা!

এরকম শত আবাকা, হার্টম্যানদের হৃদয়ে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে। ভবিষ্যতেও নেবে সন্দেহ নেই। তবে একটু আগে বলেছিলাম না যে খারাপ খবর দিয়েও দেশকে চেনে অনেকে। সেরকম অভিজ্ঞতাও কিন্তু একবারে কম না। এই যেমন নতুন আসার পর গেছি ইন্টারনেট কানেকশন নিতে। কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করার সময় টার্কিশ এক ছেলে জাতীয়তা দেখে বললো, ‘আচ্ছা তোমাদের ওখানে না কিছুদিন আগে একটা বিল্ডিং ধ্বসে পড়েছে (রানা প্লাজা)? অনেক মানুষ মারা গেছে তাইনা? আমি শুকনো হেসে বললাম, ‘হুম ঠিক শুনেছ।’ এরপর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে যখন আমাদের ৮০ মিলিয়নের উপর ডলার অন্য দেশে পাচার হয়ে গেল তখন সেটা মিডিয়াতে পড়ে আমার এক আফ্রিকান কলিগ এসে কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই, তোমাদের দেশ এখন চলবে কিভাবে বলোতো? এতগুলো টাকা যে চুরি হয়ে গেল?’ তাকিয়ে দেখি তার চোখে গভীর মমতা। নিজেকে সামলে নিয়ে আমিও যথাসম্ভব নির্বিকার থাকার ভান করে বললাম, ‘কই? আমরা তো টেরই পাচ্ছিনা!’

শেষ করি আরেক ভদ্রমহিলাকে দিয়ে। উনিও জার্মান। আমাদের ভার্সিটিতে ল্যাব টেকনিশিয়ান ছিলেন। ওই ল্যাবে আমাদের একটা কোর্স ছিল দু’সপ্তাহের। তো আমার প্রোগ্রামে আগে থেকেই প্রচুর ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট ছিল। দেখলাম যে এদের সাথে ভদ্রমহিলার খুব খাতির এবং সেটা এমন পর্যায়ে যে উনি এ পর্যন্ত ৩-৪ বার ইন্ডিয়াতে ঘুরতে গেছেন। সবশেষ বার গেছেন গত বছরের নভেম্বরে এবং সামনে আবারও যাবার ইচ্ছা। তো আমি বাংলাদেশী শুনে উনি এসে পরিচিত হলেন। ভাবলেন যেহেতু ইন্ডিয়ার প্রতিবেশী নিশ্চয়ই অনেক মিল। তার কৌতূহল দেখে তাকে একবার দাওয়াত দিলাম আমাদের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। উনি অবশ্য একটু আগের জার্মান ছেলের মত এত ঝাল খেয়ে অভ্যস্থ হতে পারেননি এখনও কিন্তু আমাদের মজা করা, একসাথে সবাই মিলে এত এত পদের রান্না করে খাওয়া এসব দেখলাম পছন্দ করে ফেলেছেন। বাংলাদেশে আসার নিমন্ত্রণ দিয়ে দিলাম। সাথে বাড়তি হিসেবে বললাম বিয়েতে আসতে। পরে মনে হল এটা না বললেও হত। উনি নিজে থেকেই যেতেন দেশটাকে দেখতে। এরপর থেকে ভদ্রমহিলা আমাদের বিভিন্ন খবর-টবর নিজে থেকে দিতেন। নেট থেকে আমাদের গান শোনেন উনি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজী অনুবাদ পড়ে মতামত দেন! একদিন দেখি ঈদের সময় প্রচন্ড ভীড়ে ট্রেনের ছাদে লোকজনের ঝুঁকি নিয়ে যাওয়ার একটা ছবি উনি কোথ্থেকে যেন যোগাড় করেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এভাবে কিভাবে যাচ্ছে সবাই? আর সবার মুখেই দেখি হাসি। ব্যাপার কি?’ আমিও সুযোগ পেয়ে বলে দিলাম- ‘শোন তুমি হয়তো জানোনা আমরা কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশগুলোর মধ্যে একটা!’

আমরা চাইলেই মনে হয় একটা সত্যিকারের সুখী দেশ হতে পারব। সময় লাগবে নিশ্চয়ই। সবসময় খারাপ দিকগুলো নিয়ে পড়ে না থাকলে আর সমালোচনার দৃষ্টিতে না দেখলে সেটা দূরূহ হবে হয়ত কিন্তু অসম্ভব কি?


ছবিঃ বন শহরে আমাদের ছোট্ট কমিউনিটি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৮
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×