somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া- আমার ইউনিভার্সিটি

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমেরিকায় যখন পৌঁছি, তখন গভীর রাত। বাংলাদেশে থাকতেই গুগল আর্থের সাহায্যে নিখুঁত ক্যালকুলেশন করে কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের কাছাকাছির মধ্যে অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছিলাম। পৌঁছার পর তাই সে রাতেই ইচ্ছে করছিল একবার ইউনিভার্সিটি থেকে ঘুরে আসি। বাকিদের বলার পর কেউ তেমন কোন আগ্রহ দেখালো না। 'কাছেই যখন, তখন একবার ঘুরে আসলে কেমন হয়?', 'গভীর রাতেই তো বুয়েটের শহীদ মিনারের ওখানে সবচেয়ে বেশি জনসমাগম হতো, এখানেও নিশ্চয় এমন কিছু হবে', 'অন্তত রাস্তায় গিয়ে এককাপ চা তো খাওয়া যেতেও পারে- আমেরিকায় চা ওয়ালা মামু আছে নাকি দেখি'- এসব কোন যুক্তিতেই কোন কাজ হলনা। টানা দুদিন না-খেয়ে, না-ঘুমিয়ে সবাই ইউভিএ-এর চেয়ে বিছানাটাকেই বোধহয় বেশি মিস করছিলাম। ঘুমোতে যাবার আগে ঠিক হলো- কালকে ঘুম থেকে উঠেই 'ইউভিএ'।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর একে একে সবাই আসা শুরু করল। প্রথমে তনিমা, তারপর জোয়েল, তারপর টিম, এবং সবার শেষে তানিয়া আপা আসলেন। বিছানা, লাগেজ, রান্নাঘর সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে আছে। ফ্রিজ খালি, খাবার-দাবার কিছুই নেই। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে তানিয়া আপা ডিক্লেয়ার করলেন, 'তোমরা এক্ষুণি আমার সাথে দোকানে চলো- অনেক কিছু কিনতে হবে'। আমরা শর্ত দিলাম, আসার সময় ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যেতেই হবে। খুব সহজ শর্ত, তাই সবাই রাজি। খুশি মনে হৈ চৈ করতে করতে আমরা পাঁচ বাঙ্গালী তানিয়া আপার গাড়িতে চড়ে রওনা দিলাম। উনি জিজ্ঞাসা করলেন- তোমরা কোথায় যেতে চাও- স্যামস ক্লাব, ওয়ালমার্ট নাকি ক্রোগারস? নাম শুনে আমরা আর কি বুঝব, বললাম- জিনিসপত্রের দাম যেখানে কম, সেখানে নিয়ে যান। আপা হাসতে হাসতে বললেন, শুরুতে তিনিও এমনটা চিন্তা করতেন, আস্তে আস্তে নাকি ২০-৩০ ডলারও কিছু মনে হবেনা। জিনিসপত্রের দাম ৭০ দিয়ে গুন করতে নিষেধ করে দিলেন। ঢাকা থেকে মুনির একটা বাংলা গানের সিডি নিয়ে এসেছিল। গায়িকার নাম অনিন্দিতা দাস। শুনলাম গায়িকা তানিয়া আপার উল্লেখযোগ্য বান্ধবী এবং আমাদের বুয়েটেরই একজন প্রাক্তন ছাত্রী। গায়িকা বর্তমানে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকেন এবং এটাই তার প্রথম সিডি। গানের কথাগুলি খুব সুন্দর। গান শুনেতে শুনতে আর দীর্ঘ-প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে ছবির মত সুন্দর শহরটাকে দেখতে দেখতে আমরা একসময় স্যামস ক্লাবে পৌঁছালাম।

স্যামস ক্লাব দেখে আমার হতভম্ব অবস্থা। একটা দোকান কি করে এত বড় হতে পারে আমার ধারণা ছিলনা। আগে থেকে না জানলে আমি নিশ্চিত ভাবে এটাকে চিটাগাং পোর্টের মত কিছু মনে করতাম। বাংলাদেশে যেমন আগোরা কিংবা বিডিআর সপ গুলি আছে সেগুলোরই বড় সংস্করণ হচ্ছে স্যামস ক্লাব। বিশাল বিশাল একেকটা র‌্যাকে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা আছে। র‌্যাকগুলি এত্ত বড় যে, ইচ্ছে করলে ওখানটায় ওরা টয়োটা কার সাইজের গাড়িও একটার ওপর একটা সাজিয়ে রাখতে পারবে। খাট-পালঙ্ক থেকে শুরু করে খাবার-দাবার, তরি-তরকারি, কাগজ-পত্র, পোশাক-আশাক, প্রসাধন সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদি সহ একটা মানুষের ইহজীবনে যা কিছু লাগতে পারে তার সবকিছু পাওয়া যায় এখানে। আমার একসময় মনে হচ্ছিল, এখানে যত জিনিস আমি দেখছি শুধু সেটুকু যদি গোটা ঢাকা শহরের মানুষকে সুষমভাবে বন্টন করা হয়, তবে একেক জনের ভাগে প্রতিটা জিনিস অন্তত পাঁচ কপি করে থাকবে। প্রত্যেকে একটা করে শপিংকার্ট নিয়ে কেনাকাটায় ঝাপিয়ে পড়লাম।

যা দেখছি তাতেই অবাক হচ্ছি সবাই। মনে হচ্ছে সবকিছু কিনে ফেলি। সারি সারি র‌্যাকে থরে থরে জিনিস সাজানো। প্রতিটা জিনিসের ওপরে র‌্যাকের গায়ে জিনিসের দাম লেখা আছে। কিছু কিছু জিনিসের দাম দেখে আমরা অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি। যেমন, সবচেয়ে সস্তা একটা জিন্সের প্যান্টের দাম লেখা আছে ৪৯ ডলার, তার মানে ৩৪৩০ টাকা! আমরা সবাই এই একই জিনিস ঢাকার নিউমার্কেট থেকে ২৫০ টাকায় কিনেছি। একটা সানগ্লাসের দাম লেখা ৪২ ডলার। এনামুল তার দরাজ গলায় বলল, ভাইয়া এই জিনিসতো ঢাকায় ৪২ টাকায় বিক্রি হয় দেখছি। সিডি-ডিভিডির দাম দেখে আমেরিকার প্রতি আমাদের করুণাই হলো। স্পাইডারম্যানের চারপর্বের ডিভিডির দাম লিখে রেখেছে ২৮ ডলার। আমি গত কয় বছরে টোটাল ২৮ ডলারের সিডি কিনেছি সেটা কাউন্ট করে বের করতে পারলাম না। জিনিস দেখেই কিনতে ইচ্ছে করছে, আর দাম দেখেই আঁতকে উঠছি। তানিয়া আপা এবার বললেন, এসব রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা আছে সেগুলি আগে কিনি। দাম নিয়ে চিন্তা তিনি পুরোপুরি বন্ধ করতে বললেন।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বলতে এতদিন আমার ধারণা ছিল- একটা কম্পিউটার, একটা ইন্টারনেট লাইন, কিছু বই/কাগজ-পত্র আর একটা মোবাইল ফোন। কিন্তু, তানিয়া আপা যখন আমাদেরকে স্যামসক্লাবের আলু-পেঁয়াজের সেকশনে নিয়ে আসলেন, তখন বুঝলাম জীবনের আরো অনেক দিক আছে। আমাদের খেয়াল হলো, স্যামসক্লাবের এই সুবিশাল আলু-পেঁয়াজ দিয়ে আমাদেরকেই আগামী কয়েক বছর তরকারি রাঁধতে হবে, সেটাকে খেতে হবে এবং বেঁচেও থাকতে হবে। তিনটা কাজই আমাদের জন্যে কঠিন হলেও আপাতত কেনাকাটার সময় আর ওসব নিয়ে টেনশন করতে চাইনা। আমরা শপিং কার্ট ভর্তি করে মহা উৎসবে সওদা-পাতি কেনাকাটা করতে লাগলাম।

বাংলাদেশে যা পাওয়া যায় এখানে প্রায় সবকিছুই আছে, তবে সবকিছুই মনে হয় সাইজে অন্তত ছয়গুন বড়। একেকটা আলু-পেয়াজের যা সাইজ তাতে মনে হতে লাগল দেশ থেকে আনা রান্নার রেসিপি গুলো সব আবার নতুন করে লিখতে হবে। যেমন, দুই মুঠ ডাল রান্নার জন্য আম্মা লিখে দিয়েছেন দুটা পেঁয়াজ কেটে দিতে; এখন মনে হচ্ছে এই পেঁয়াজের যে সাইজ তাতে দুটা পেঁয়াজ ২ মুঠ ডালের মধ্যে দিলে রান্নার পর ডালের বদলে সেটা পেঁয়াজের স্যুপে পরিণত হতে বাধ্য। কাঁচা মরিচের সাইজে আমরা সত্যিই মুগ্ধ। এগুলি অবশ্য ঠিক কাঁচামরিচ না- এগুলি ক্যাপসিকাম। আমাদের রামপুরার নিজেদের বাড়ির ছাদে আব্বার লাগানো ক্যাপসিকামের গাছের বদৌলতে আমি জিনিসটা চিনি। কিন্তু, এটার সাইজও এক্কেবারে পেঁপের মত! আমরা এসব বিশাল বিশাল সাইজের সবজি দিয়ে আমাদের সবকটা শপিং কার্ট ভর্তি করে ফেললাম।

মজার মজার আরো কিছু আইটেম দেখলাম। কেক-পেস্ট্রির সেকশনে এসে একেবারে লোভ লেগে গেল। আমার মতে আমেরিকা একটা জিনিসে নির্দ্বিধায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার যোগ্য, এবং সেটা হচ্ছে- কেক। এদের কেক এত নরম আর এত মজা হয় যে, কেউ একবার খাওয়া শুরু করলে তাকে আর থামানো যাবেনা। আমার খুব ইচ্ছে করছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে আমি এক পিস করে হলেও এই কেক খাওয়াই। না খেলে কখনও কেউ বুঝতে পারবে না আমি কেন এটা নিয়ে এত কথা বলছি। সেদিন ছিল এনামুলের জন্মদিন। আমরা তাই ওর জন্য একটা কেক কিনে নিলাম। সেই কেক প্রায় বিশ দিন আমাদের ফ্রিজে ছিল। আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে খেতাম। কেকটার এক্সপাইরি ডেট ওভার হয়ে যাবার পরও আমরা সেটাকে ফেলিনি। শেষমেশ আমাদের ইন্ডিয়ান এক সহপাঠি, বিদ্যাভূষণ সেটাকে খুব মজা করে খেয়েছে। এই লেখা লিখবার মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ঠিক নিশ্চিত না- বিদ্যাভূষণের পেটের কি অবস্থা।

কি কিনছি, কেন কিনছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপরও বেশ মজা লাগছিল। শপিংকার্ট নিয়ে দোকানের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতেই বেশ ভালো লাগছিল। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম, এখানে সবাই আমাদেরকে দেখেই দন্ত বিকশিত করে 'হাই-হেলো' করছে। অচেনা অজানা সবাই দেখা মাত্রই খুব বেশি খুশি হয়ে উঠছে। আমাদের শপিংকার্টের সামনে কেউ চলে আসলেই সাথে সাথে খুবই আন্তরিকতার সাথে 'সরি, সরি' করছে। আমি ভাবতে লাগলাম, ব্যাপারটা কি? তানিয়া আপা কি মাত্র এক বছরে এত বেশি বিখ্যাত হয়ে গেলেন যে, শপিং করতে আসা সবাই তাকে চিনে ফেলছে, আর সেজন্যই আমাদের এত সম্মান দেখাচ্ছে? আপাকে জিজ্ঞাসা করাতে উনি হাসতে হাসতে বললেন, এটাই নাকি এদেশের কার্টেসি। কারো সাথে দেখা হলেই, সে যত অপরিচিতই হোক না কেন, এরা হাসি মুখে কথা বলে। ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লাগল। আমাদের দেশে আমরা পরিচিত লোকজনের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে চিন্তা করি কি করে না চেনার ভান করে থাকা যায়, আর এরা উল্টো অপরিচিত লোকদের দেখে কুশল বিনিময় করছে! দেশটার উন্নতির পেছনে যে সকল কারণ আছে তার একটা বোধ হয় আমার কাছে পরিষ্কার হতে লাগল।

অনেককিছু কেনার পর আমরা সবাই হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আর পা চলছিল না, বেলাও অনেক হয়েছে। আমরা টাকা পয়সা দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। আমরা তিনজনে মিলে প্রায় চারশ ডলারের মত বাজার করলাম। তনিমা ওর টাকা আলাদা দিল। তানিয়া আপাও নিজস্ব যা কিনেছেন সেটার দাম আলাদা পরিশোধ করলেন। খেয়াল করলাম, এরা বিল যত হয়েছে ঠিক তত টাকাই রাখল। যেমন, যদি কারো বিল হয় ৩৯৯.৯৯ ডলার, তবে ৪০০ ডলার দিলে তারা তাকে ১ সেন্টও ফেরত দেবে। আমাদের দেশ হলে আমরা কেউ ওই ১ সেন্ট আশাও করতাম না। হয়ত ওদের মুদ্রার দাম বেশি বলেই ওরা এক সেন্টকেও মূল্য দেয়। আবার এমনটাও হতে পারে, ওরা এক সেন্টকেও মূল্য দেয় বলেই ওদের মুদ্রার মূল্যটা আজ এত বেশি।

ফেরার পথে ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার কথাটা মনে করিয়ে দিলাম। তখন প্রায় ছয়টা বাজলেও মনে হচ্ছিল দুপুর দুটা কিংবা বড় জোর তিনটা। শুনলাম আমেরিকায় নাকি রাত আটটায় সূর্য ডোবে। এখনও তাই হাতে অনেক সময়। স্যামস ক্লাব থেকে ড্রাইভ করে প্রায় মিনিট বিশেকের পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ইউনিভার্সিটি এলাকায় প্রবেশ করলাম। গোটা শারলোটসভিল শহরের সবকিছুই আসলে ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রীক। পথে ঘাটে সর্বত্রই ইউনিভার্সিটির একটা ছোঁয়া আছেই। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়া শুরু করল বড় বড় করে টাঙ্গানো 'ওয়েলকাম নিউ স্টুডেন্ট' লেখা ব্যানার। বুঝলাম, নতুন ছাত্রদেরকে গ্রাউন্ডসে স্বাগতম জানানোর প্রস্তুতি এরা ভালোভাবেই নিয়েছে। এখানে ক্যাম্পাসকে এরা 'গ্রাউন্ডস' বলে। গ্রাউন্ডসের সবগুলো বিল্ডিংই কোন না কোন বিখ্যাত ব্যাক্তির নামে নাম করা। যেমন, থরটন হল, ক্যাবেল হল, ব্রুকস হল, ব্রায়ান হল ইত্যাদি। আমি অবশ্য এদের কাউকেই চিনতে পারলাম না। উইকিপিডিয়া পড়ে শুধু এইটুকু জানি যে, ইউভিএ ইউনিভার্সিটিটি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের নিজের হাতে গড়া। শুরুতে যে বিল্ডিংটি ইউনিভার্সিটির মূল ভবন ছিল, সেটাকে বলা হয় 'রোটুন্ডা'। এই রোটুন্ডার নকশা নাকি থমাস জেফারসন নিজে করেছিলেন। লেখার শুরুতে যে ছবি, সেটা রোটুন্ডার। রোটুন্ডার সামনে যে সবুজ লন আছে, সেটা নাকি তার নিজের তৈরি। সবাই বলে, রোটুন্ডার বারান্দায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে নাকি সমুদ্র দেখা যায়। তবে এটা সত্যি সত্যি কেউ দেখেছে কিনা আমি জানিনা। আমাকে যে ছেলেটা এই তথ্য দেয়, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি কি নিজে দেখেছ? সে আমাকে জানায়, তার প্রেমিকাকে নিয়ে সে একবার সেখানে গিয়েছিল। তার প্রেমিকা নাকি স্পষ্ট দেখেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি দেখনি কেন তাহলে? সে বলল, আমি তো তখন 'ওকে' দেখছিলাম।

কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট যে বিল্ডিংয়ে তার নাম ওলসন হল। এটি অপেক্ষাকৃত নতুন বিল্ডিং হলেও, এখানকার প্রতিটি বিল্ডিংয়ের মত এটার ডিজাইনেও রোটুন্ডাকে ফলো করা হয়েছে। ইউভিএর প্রতিটি বিল্ডিংই আসলে এই একই ধাঁচে তৈরি। আমি প্রথম দেখায় অবাক হচ্ছিলাম যে, মাত্র একতলা একেকটা বিল্ডিংয়ে একেকটা ডিপার্টমেন্ট কি করে থাকতে পারে? পরে জানতে পেরেছি, বিল্ডিংগুলো সব আসলে চার তলা। এর মাঝে আমরা শুধু ওপরের অংশ দেখতে পাই, মাটির নিচেও বেশ কিছু তলা আছে। রোটুন্ডার সাথে মিল রাখতে গিয়েই বুঝি এমনটা করতে হয়েছে। ছুটির দিন হলেও ওলসন হল সবসময়ই খোলা থাকে। আমরা সবাই রুদ্ধশ্বাসে একে একে মূল দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লাম।

ডিপার্টমেন্টটা চতুর্ভূজ আকৃতির এবং সিমেট্রিক। একদম মাঝে কিছু রুম, তাদের চারপাশ দিয়ে করিডোর, আবার করিডোরের অন্যপাশে চারদিক ঘিরে আরো কিছু রুম। বন্ধের দিন বিধায় বেশিরভাগ রুমই বন্ধ। আমরা করিডরের চারপাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে দেয়ালে টাঙ্গানো বড় বড় বাঁধাই করা পোস্টার গুলো দেখতে লাগলাম। একটা পোস্টার দেখে আমাদের গর্বে বুক ভরে উঠল- সেটার কথায় পরে আসছি। বাকি পোস্টারগুলোও ইন্টারেস্টিং। প্রতিটি প্রফেসর যে সকল প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন বা করেছেন তার সারাংশ নিয়ে কিছু পোস্টার টাঙ্গানো। আবার একখানে দেখলাম একটা বোর্ডে বিখ্যাত বিখ্যাত সায়েন্টিস্টদের সাথে লেখা গবেষণাপত্রগুলো আলপিন দিয়ে সারিবদ্ধভাবে ঝোলানো। এছাড়াও বিভিন্ন সালের সকল গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের ছবি টাঙ্গানো আছে দেয়ালে। ২০০৭ সালের ফল সেমিস্টারের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তানিয়া আপার ছবি দেখতে পেলাম। তার ভূতের মত ছবিটা নিয়ে আমরা হাসাহাসি করছিলাম আর তিনি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, কেন তার ছবি সেদিন খারাপ উঠেছিল। মর্তুজা ভাইয়ের ছবিও দেখলাম। উনি অবশ্য এখন আর ইউভিএতে নেই, মাস্টার্স শেষ করে এখন উনি মাইক্রোসফটে চাকরি করছেন। আমরা একে অপরকে বিখ্যাত কবিতার সুরে বললাম, 'দেখিস- একদিন আমরাও'।

ঘুরতে ঘুরতে আমরা ডিপার্টমেন্টের টী-রুমে পৌঁছালাম। এখানে সবার জন্য চা-কফি, স্ন্যাক্সের সবরকম ব্যবস্থা আছে। যার দরকার সে খাওয়ার পর একটা নির্ধারিত বক্সে দাম দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কেউ যদি টাকা না দেয়, কারো কিছু করার নেই। তারপরও সবাই টাকা দেবে। এখানে সবাই জেন্টলম্যান, পুরো ব্যাপারটাই বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে বছরের পর বছর ধরে চলছে। আমি শুনেছি এখানে ছাত্রদের বিশ্বস্ততার ওপর এত বেশি আস্থা যে, পরীক্ষার হলে কখনও কোন গার্ড থাকেনা। ছাত্ররা চাইলে পরীক্ষার খাতা বাসায় নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আবার সময় শেষ হবার আগে খাতা জমা দিতে পারে। একজন ছাত্র নিজের আত্মসম্মান থেকেই কখনও অন্যকিছু করবেনা, এটাই নাকি স্বাভাবিক। আমি অবাক হব, নাকি মুগ্ধ হব, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

করিডর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই আগের জায়গায় এসে দাঁড়ালাম যেখানটায় আমাদেরকে মুগ্ধ করা সেই পোস্টারটি টাঙ্গানো। এবছর সারাবিশ্ব থেকে যে পঁচিশজন ছাত্র-ছাত্রী এই ডিপার্টমেন্টে পিএইচডি করতে আসছে তাদের প্রত্যেকের নাম এই বোর্ডে টাঙ্গানো। না, নিজের নাম দেখে আমরা কেউ মুগ্ধ হইনি- মুগ্ধ হয়েছি বোর্ডটাতে টাঙ্গানো বিশ্বের মানচিত্রটি দেখে। গোটা বিশ্বের যেসকল শহর থেকে এবার কেউ না কেউ এই ডিপার্টমেন্টে পিএইচডি করতে আসছে, সেই সেই শহরের ওপর সুন্দর করে এক একটা আলপিন বসানো। আমেরিকা, চায়না, ভারত, ইরান, ব্রাজিল, তাইওয়ানের মত আমাদের ছোট্ট বাংলাদেশের মাঝে আরও ছোট্ট ঢাকা শহরের ওপর একটা সুন্দর আলপিন বসানো। খুব সামান্য একটা ব্যাপার- কিন্তু এই সামান্য জিনিস আমাদের সবার মন জয় করে নিল। অনেক দূর থেকে আমরা এসেছি অজানা এক শহরের অচেনা এক পরিবেশে। নিজদেশ ছেড়ে অন্য দেশের অন্য এক প্রতিষ্ঠানকে আপন মনে করা তাই এতটা সহজ না। ইউভিএ সেটা জানে, আর জানে বলেই খুব সহজভাবে বুঝিয়ে দিল এই ইউনিভার্সিটি কোন দেশের বা কোন জাতির একার নয়, এটা আমাদের সবার। মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম, ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া- আমার ইউনিভার্সিটি।











সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৫২
২৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×