এটা আমেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলোর বৈশিষ্ট্যও হতে পারে, আবার ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার অগণিত উচ্চাকাঙ্খার একটিও হতে পারে- কোনটা সঠিক সেটা বলতে পারছি না- তবে বিষয়টি হচ্ছে, ইউভিএ চায় তার একজন ছাত্র যখন কথা বলবে বা যখন কিছু লিখবে, তখন যেন তার কথা শুনে বা তার লেখা পড়ে বোঝা না যায় সে কি নেটিভ আমেরিকান, নাকি বাইরের কেউ। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের পুরোদস্তুর আমেরিকান বানানোর এ মহাপ্রয়াশ যত মহৎ-ই হোক না কেন, গ্র্যাডস্কুলের ঠাসা কোর্স সিডিউল আর নানান রিসার্চ গ্রুপের সাথে বেলা-অবেলার মিটিংগুলোর ভীড়ে বাড়তি একটি কোর্স যোগ হওয়াতে একটু আক্ষেপই হতে লাগল। ব্যস্ততার মাত্রা বোঝাতে উদাহরণ হিসেবে প্রায়দিনের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে- চুলোয় মাংস চড়িয়ে দিয়ে বসে আছি রান্না শেষ হবার জন্য, এদিকে ক্লাসের আগে ডিপার্টমেন্টে পৌঁছাবার শেষ বাসটি আসবে ঠিক ১৮ মিনিট পর। বাসা থেকে নেমে বাসস্ট্যান্ড যেতে লাগবে বড়জোর ২ মিনিট। তাই মাংস সেদ্ধ হোক আর না হোক, আমাকে ১৪ মিনিট পর সেটাকে নামিয়ে ২ মিনিটে খেয়ে দৌড় দিতে হবে। এরচেয়েও ভয়াবহ দিন আসছে আন্দাজ করেই মনে মনে একটু দমে গেলাম। তার ওপর যখন এনামুল এসে তার নির্দয় হাসি সহকারে বলতে লাগল- ''ভাইয়া, আপনিও চিঠি পাইছেন--হাঃ হাঃ হাঃ"- তখন মনে হতে লাগল, এই দিন দেখার জন্য বেঁচে আছি?
প্রতি সোমবার বেলা বারোটায় ক্লাস। এর অর্থ এখন থেকে আমাদের সপ্তাহ শুরু হবে ইংরেজি শিক্ষার আসরের মাধ্যমে। একখানা রুলটানা খাতা হাতে নিয়ে বিরস মনে প্রথমদিন ক্লাসে গেলাম। (এখানে উল্লেখ্য যে আমেরিকায় সব খাতাই রুলটানা হয়ে থাকে। আমি এখানে এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পুরো সাদা পেইজের খাতা কোন দোকানে পাইনি। খাতাগুলোর আকৃতিও ডিমাই সাইজের চেয়ে অনেক ছোট, আর বাম পাশের মার্জিনের বাইরে পাঞ্চমেশিন দিয়ে তিনটি ছিদ্র করা থাকে।) স্কুলের বাচ্চাদের মত রুলটানা খাতা নিয়ে ক্লাস করতে যাচ্ছি- ভাবতে মোটেও ভালো লাগছিল না। ক্লাসে ঢুকেই বুঝতে পারলাম আমি একা নই- আমার সাথে আরও বেশকিছু সৌভাগ্যবান ছাত্র-ছাত্রী আছে। গুনে দেখলাম- এই ব্যাচে আমরা সর্বসমেত দশজন। চারজন মেয়ে ও ছয়জন ছেলে। আমার সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে- তনিমা এবং এনামুল। এছাড়া ইন্ডিয়ান ছেলে আছে একজন এবং বাকি ছয়জন চায়নিজ। চায়নিজদের মাঝে তিনজন ছেলে এবং বাকি তিনজন মেয়ে। মেয়ে তিনটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম ওদের চেহারার মাঝে পার্থক্য কোথায়? ইউভিএ'তে প্রচুর চায়নিজ ও কোরিয়ান ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করে। আমেরিকায় আসার পর প্রথম প্রথম এদের সবাইকে আমার কাছে একই মানুষ মনে হতো। এখন অবশ্য আমি এদের মাঝে কোনটা ছেলে আর কোনটা মেয়ে- এইটুকু বুঝতে পারি। এছাড়াও পরিচিতদেরকে কাছে থেকে দেখলে হয়ত চিনতে পারি। ছেলেদের মাঝে তবুও কিছুটা পার্থক্য বের করা সম্ভব, কিন্তু মেয়েদের চেহারায় পার্থক্য করার ক্ষমতা আমি এখনও অর্জন করতে পারিনি।
ঠিক বারোটায় ক্লাসে প্রবেশ করলেন আমাদের ল্যাংগুয়েজ ইন্সট্রাক্টর মিস বারিটো। প্রথমে নিজের পরিচয় দিলেন এবং আমাদের সবার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনি জাতিতে ফরাসি কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত ইউভিএ'তে আছেন। আমরা বাংলাদেশের স্টুডেন্ট শুনে উনি খুব খুশি হলেন। কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের হেড মিস ম্যারির একজন ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ায় সম্ভবত বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশংসা আগে থেকেই শুনে থাকবেন, সেকারণেই আমাদেরকে নিয়ে তার এই আবেগ। পরিচয় পর্ব শেষে প্রথম 'সবক' হিসেবে উনি আমাদের সবাইকে দিয়ে 'এ' থেকে 'জেড' পর্যন্ত বলিয়ে নিলেন! আমরা সেদিন শিখলাম- স্বরবর্ণ কাকে বলে, ব্যাঞ্জনবর্ণ কাকে বলে, কত প্রকার, কয়টি ও কি কি। এরপর আমাদেরকে দিয়ে ইংরেজি ছোট ছোট তিন অক্ষরের শব্দগুলো উচ্চারণ করানো শুরু করলেন- ক্যাট, স্যাট, প্যাড ইত্যাদি। এসব শব্দ উচ্চারণ করার সময় মুখের ভেতরের বিভিন্ন অংগপ্রত্যংগ কিভাবে নড়াচড়া করবে তা প্রত্যেকের কাছে গিয়ে মিস বারিটো বিশাল হা-করে দেখাতে লাগলেন। এই লেখাটি যারা পড়ছেন তারা হয়ত একটু বিরক্ত হচ্ছেন, কিন্তু যদি একটু কল্পনা করার চেষ্টা করেন যে, একটি ক্লাসরুমে পঁচিশ থেকে সাতাশ বছর বয়েসী দশজন মানুষ (যারা প্রত্যেকেই কোন না কোন বিষয়ে পিএইচডি করছে), একজন আশিতীপর বৃদ্ধার নেতৃত্বে সমস্বরে 'এ-বি-সি-ডি' পড়ছে এবং বৃদ্ধা তাদের ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে, তবে ব্যাপারটা ইন্টরেস্টিং লাগার কথা। শুরুতে আমাদের সকলের বিরক্তি লাগলেও আস্তে আস্তে ব্যাপারটা বেশ মজা লাগতে শুরু করল। বিরক্তি মাত্রা অতিক্রম করে হাসিতে পরিণত হচ্ছে, তারপরও সবাই হাসি লুকিয়ে ভদ্রতার খাতিরে খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে 'এ-বি-সি-ডি' পড়ে যাচ্ছে। আমি হাসি আটকাতে পারিনা, তাই একবার হেসে ফেললাম। এরপর পুরো ক্লাসে হাসির রোগ ছড়িয়ে পড়তে আর সময় লাগল না। শেষমেশ মিস বারিটোও যখন হাসতে লাগলেন তখন আর কেউ কোন রাখঢাক করল না। ক্লাস শেষে আমরা যেই নিজেদের মাঝে বাংলায় কথা বলা শুরু করেছি, বারিটো একটা আদর মেশানো হুংকার দিয়ে বলে উঠলো- "এইংলিশ, এইংলিশ, এইংলিশ"। আমরা সবাই হাসি দিয়ে সেটার প্রত্তুত্তর করলাম। বারিটোকে শুরুতে কট্টর মনে হলেও, আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম ওতটা খারাপ হবেনা। কেন যেন মনে হতে লাগল, সারা সপ্তাহের পরিশ্রমের মাঝে এরকম একটা ক্লাস থাকাটা বোধহয় খুব একটা মন্দ নয়!
ইংরেজি উচ্চারণ শেখাটা আমার দৃষ্টিতে আমেরিকায় বসবাসকারী প্রত্যেকের জন্যই খুব জরুরী। আমরা অনেকেই ইংরেজিতে কথা বলে যাই অথচ আমার কথা বুঝতে শ্রোতার কতটুকু কষ্ট হচ্ছে সেটা একটুও খেয়াল করিনা। আবার কেউ যখন ইংরেজিতে কথা বলতে আসে তখন তার বলার ধরণ বুঝতে না পারলে নিজেরা আবার ঠিকই তার ওপর বিরক্ত হই। একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পেরেছি যে আমরা বাঙ্গালিরা আমাদের একটি নিজস্ব স্ট্যাইলে ইংরেজি বলে থাকি যেটাতে নেটিভরা অভ্যস্ত নয়। যেমনঃ আমি যদি বলি- 'আই ক্যান ডু দ্যাট', তবে শতকরা পঞ্চাশভাগ আমেরিকান বুঝতে পারবে না আমি 'ক্যান' বলেছি নাকি 'ক্যান্ট' বলছি। কিন্তু যদি একটু সময় নিয়ে টান দিয়ে বলি- 'আই কিয়ান ডু দ্যাট' তখন তারা সহজে বুঝতে পারে। আমেরিকান লাইফ অনেক ফাস্ট হতে পারে, ভাষার দিক দিয়ে বাংলা অনেক বেশি ফাস্ট। একারণে ইংরেজি শব্দগুলো সুন্দর করে উচ্চারণ করতে হলে আমাদেরকে একটু সময় ব্যয় করে শব্দের মাঝে যথাস্থানে মাত্রানুযায়ী টান দিয়েই উচ্চারণ করতে হবে। বুয়েটে ওয়ান-ওয়ানে পড়ার সময় একজন ম্যাডাম আমাদের ইংরেজি উচ্চারণ শেখাতেন। উনি প্রথমদিনের ক্লাসে আমাদের বলেছিলেন 'বেবী' শব্দটার সঠিক উচ্চারণ হবে 'বেইবী'। এরপর থেকে সেই ম্যাডামের নামই হয়ে যায় 'বেইবী ম্যাডাম' (ম্যাডাম আমি ক্ষমাপ্রার্থী)। উনি যা শেখানোর চেষ্টা করতেন সেটা তখন হাস্যকর মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে যে ওটার দরকার ছিল। তবে আশার কথা যে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজিতে অভ্যস্ত হতে খুব বেশি সময় লাগেনা। আমাদের বাংলা বর্ণমালা এত বেশি সমৃদ্ধ যে আমরা আসলে ইচ্ছে করলেই যে কোন শব্দ খুব সহজেই উচ্চারণ করতে পারি।
আশ্চর্যের ব্যাপার যে চায়নিজ বর্ণমালায় হাজার হাজার বর্ণ থাকা সত্ত্বেও ওরাই ইংরেজি উচ্চারণে সবচেয়ে বেশি কাঁচা। যেমনঃ ওরা 'থ' উচ্চারণ করতে পারেনা। ওরা 'আই থিঙ্ক' এর বদলে বলবে 'আই সিঙ্ক', 'থিসিস' এর বদলে বলবে 'সিসিস', 'পাথ' এর বদলে 'পাস', 'থ্যাঙ্ক ইউ' এর বদলে 'স্যাঙ্ক ইউ' ইত্যাদি। আমি অনেক চায়নীজ গ্রাজুয়েটের সাসে কাজ করেছি যারা অন্তত দু-তিন বছর যাবৎ ইউভিএ'তে পড়ছে অসচ এখনও সিক মত 'থ' উচ্চারণ শিখেনি। চায়নিজদের ইংরেজির বেহাল অবস্থার কথা অবশ্য তারা নিজেরাই স্বীকার করে থাকে। তৃতীয় বর্ষের গ্র্যাডস্টুডেন্ট মিং ম্যাও-কে আমি একদিন বলি- 'তোমার কম্পাইলার বইটা আমি কিছুদিনের জন্য নিতে চাই'। সে আমাকে বই খুলে দেখালো বইটির বাইরের কাভার একই হলেও ভেতরে পুরো বই চায়নিজ ভাষায় অনুবাদ করা। তার কাছে শুনে আরও অবাক হলাম যে সে আন্ডারগ্রাড লেভেলে কম্পিউটার সায়েন্সের সব বইয়েরই চায়নীজ অনুবাদ পড়েছে, আর একারণে এখনও ইংরেজি বই পড়তে গিয়ে তার বুঝতে কষ্ট হয়। (বাকিটুকু আসছে)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১২:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




