(সম্পূর্ণ কাল্পনিক গল্প। কেউ মিল খুঁজে পেলে নিজ দায়িত্বে খুঁজবেন)
আমি রুমী। একাত্তরের বীর শহীদ রুমী নই, একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত সাহসের তের সালের একজন তরুণ। শহীদ রুমী যেমন তার সাহসের গালিচার চড়ে মৃত্যুকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে, আমি ঠিক তার উলটো। দিনরাত এখন আমি মৃত্যুভয়ে পালিয়ে বেড়াই। থাক সে কথা পরে হবে।
রাতটা যেন আজ তাড়াতাড়িই বয়ে চলে গেল। ক্যালেন্ডারের যে তিনটে পৃষ্ঠা আমার শেষ সম্বল তার দেড়টুকুই প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তবে আজকের সকালটা একটুখানি আলাদা। আমার চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেকদিন প্রভাতদেবী যখন তার অদৃশ্য মুছনি দিয়ে আয়নায় জমে থাকা ধূলোর মত আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা মেঘগুলো মুছে দিয়ে তার প্রিয়তম সূর্যের মুখে হাসি ফোটায় তখন সে দৃশ্য এ তল্লাটে একমাত্র আমিই অবলোকন করি। আমার ভুল হতে পারে না। প্রত্যেকদিন সময়ের আদালতে প্রভাত আর সূর্যের অবৈধ মিলনের মামলা যখন চলে তখন কাঠগড়ায় একমাত্র সাক্ষী এই আমি। কমলাকান্তের জবানবন্দি দেই না, প্রতিটি মুহুর্ত রংধনুর সাতরঙা পেন্সিল দিয়ে এঁকে দেই। আমি চোখ বন্ধ করেই আঁচ করতে পারছি আজকের সকালের ব্যর্থতার ইতিহাস।
যাক সকাল নিয়ে এত গবেষণা করে লাভ নেই। সারারাত কুমারী রাত্রিকে পাহারা দিয়ে খুব ক্লান্তি অনুভব করছি। প্যাকেটে একটা সিগারেটও নেই। তবে অর্ধশত প্যাকেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বারান্দায়। খুঁজলে দু’একটা মুমূর্ষ সিগারেট পাওয়াও যেতে পারে। কিন্তু এই অসুস্থ সকালের শুরুটা আরেকটা অসুস্থ সিগারেট দিয়ে শুরু করার ইচ্ছে নেই।
চার বছর আগে বড় আপা একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছিল আমার জন্মদিনে। ক্রিডেন্স নামের একটা দামি ব্র্যান্ডের এলার্ম ঘড়ি। জীবনে কোন কাজই নিয়মিত করতে না পারলেও সময়মত ঘড়ির ব্যাটারী বদলানোর কাজটা আমি করতে পেরেছিলাম। সেই ঘড়িটাও এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শতবর্ষী অবহেলিত কোন প্রাইমারী স্কুলের ভাঙ্গাচোরা শহীদ মিনারের মত। যখন সময় নিয়ে কোন চিন্তাই ছিল না তখন চাইলেই ঘড়িটা জানিয়ে দিয়ে যেত এখনও অনেক সময় আছে, চিন্তা করো না। আর আজ বালিঘড়ির প্রত্যেকটা বালি যখন আমার কাছে মূল্যবান তখন সময় জানানোর কেউ নেই।
অজ্ঞাত সময়ের পরোয়া না করেই বিবস্ত্র তোশকের উপর গা এলিয়ে দিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুম কেড়ে নিল চোখ।
দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গা যেন আমার রুটিনই হয়ে গিয়েছিল। আজও তার ব্যতিক্রম নেই, বিন্দু বিন্দু ঘামে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে অনুশীলনকালীন ঘুমের দেশ থেকে ফিরে এলাম। তবে আজকের স্বপ্নটায় আমার নাম রুমী ছিল না। একেকজন একেকটা নাম ধরে ডাকছিল বিকট স্বরে। মাঝে মাঝে সবাই একসাথে। আমি সবার ডাকই শুনতে পারছিলাম কিন্তু জবাব দিতে পারছিলাম না। খুব চেষ্টা করেও। একসময় সবাই আমার পিছনে দৌঁড়াতে শুরু করল। আমি নড়তেও পারছিলাম না। শব্দের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল।
শহুরে গরম জলে হাতমুখ ধুয়ে চললাম নুরুর দোকানে। রহস্যে ভরা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে নুরুর দোকান আরেক বিচিত্রময় রহস্যে ঠাসা। আশেপাশের দোকানগুলোর মধ্যে নুরুই সবচেয়ে ভাল চা বানায়। কিন্তু সারাদিনে তার দোকানের কাস্টমারই সবচেয়ে কম। আর প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত দুইবার পুলিশ এসে দোকান সার্চ করে যায়। এ পর্যন্ত সার্চ করে কিছু পায়নি। তবে সার্চ শেষে ঠিকই দু’কাপ করে চা খেয়ে যায় হোদকা মোটা দারোগা আর কনস্টেবলগুলো।
একটা বনরুটি , একটা কলা আর এক কাপ চায়ের বিল মিটিয়ে বের হলাম চায়ের দোকান থেকে। একবার মনে হল ডিপার্টমেন্টে যাই। শুনে আসি নতুন কোন সিদ্ধান্ত হলো কি না! দেড়মাস ধরে পরীক্ষা দুটো আটকে আছে। এই পরীক্ষা দুটোতে পাশ করতে পারলেই অন্তত শেষ কয়দিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পারব। কিন্তু বিভিন্ন দাবী নিয়ে ধর্মঘট চলছে শিক্ষকদের। যতদিন তাদের দাবী না মানা হবে ততদিন পরীক্ষা নিবেন না। তাই ঝুলে আছি বাদুরের মত।
অবশ্য আমার আরও এক বছর আগেই পাশ করে যাওয়ার কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দুবছর যেভাবে কেটেছে সেভাবে সবকিছু গেলে এক বছর আগেই প্রকৌশলী খেতাব পেতাম। একেকটা নতুন নতুন প্রজেক্ট বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনেকগুলো পুরস্কারও জিতেছিলাম। সেই পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু একবার বেতন-ভাতা কমানো নিয়ে কি একটা আন্দোলনে জড়িয়ে গেলাম। ছাত্রদের সাথে শিক্ষকদের বিশাল একটা ঝামেলা হলো। যারা যারা আন্দোলনে ছিল তাদের সবাইকে এক সেমিস্টারের জন্য করা হলো বহিস্কার। একদম আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা হলো যখন হাতে বহিস্কারের চিঠিটা। তারপর থেকে স্যাররাও আর দেখতে পারেন না। অনেক ভাল পরীক্ষা দিয়েও একই বিষয়ে ফেল করেছি দুই বার।
প্রথমেই বলেছি আমার নাম রুমী হলেও শহীদ রুমীর মত সাহসের কানাকড়িও নেই আমার। আসলে ইচ্ছা করেই সাহস করিনা। আমি যেমন পরিবার থেকে এসেছি, আর আমাকে যা যা করতে হবে এসব ভাবলেই সাহসকে আমি জানালা দিয়ে বের করে দেই। ভার্সিটির সবাই ভাবে আমি খুব বোকা, কোন সাহস নেই। কিন্তু ওরা জানে না খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে হলে সাহস দেখাতে হয় না। আর আমার ঐ তাড়াটা একটু বেশিই ছিল। বাবা-মাকে খাওয়ানোর ইচ্ছাও ছিল যে!
এখন যে অবস্থায় আছি তাতে যদি ঠিকমত পরীক্ষা হয় তাহলে অন্তত নিজের উপার্জনের একমাসের টাকা আমি বাড়িতে বাবা-মায়ের হাতে পাঠাতে পারব হয়ত। অনেক ভাল ভাল প্রজেক্ট ডিজাইন করায় কয়েকটা কোম্পানি চাকুরীর অফার দিয়েছে। কিন্তু তার জন্য পরীক্ষাটা তো হতে হবে!
রোদে দাঁড়িয়ে এসব ওসব ভাবছি। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এলো,
-এই রুমী ভাই। এত রোদে দাঁড়িয়ে কি করেন?
প্রশ্ন করেছে এক বছরের জুনিয়র সাদিদ। কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিনা।
-রোদে দাঁড়িয়ে নিজেকে ফ্রাই করি। আগে থেকেই প্র্যাক্টিজ করছি আর কি।
-কিসের প্র্যাক্টিজ?? বাবুর্চি হবেন নাকি?
এবার সত্যি মেজাজ গরম হলো। জুনিয়রদের সাথে পরীক্ষা দিচ্ছি বলে এরা মোটেও সম্মান করে না ইদা্নিং। ইয়ার-বন্ধুর মত ঠাট্টা মশকারি করে কথা বলে।
-তুমি তোমার কাজে যাও। নইলে তোমারেও ফ্রাই করে দেব। যাও।
সাদিদ মুখ তেতো করে চলে গেল। একটা বিশাল ট্রলি ব্যাগ ঘড়ঘড় করে টেনে চলে গেল। মনে হয় বাড়ি চলে যাচ্ছে। পরীক্ষা হবার কোন সম্ভাবনা নেই দেখে অবশ্য অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। যাদের একটু দম আছে কিংবা অন্য কোন উপায় নেই পরীক্ষা ছাড়া তারা কিছু আছে। আমার মত অভাজন আর কি!
ডিপার্টমেন্টে যাব না সিদ্ধান্ত নিলাম। গেলে রাকার সাথে দেখা হতে পারে। রাকা আমার প্রেমিকা ছিল। আমার এক বছরের জুনিয়র। ছিল বলছি কারণ এখন আর নেই। টানা দুই বছর চুটিয়ে প্রেম করেছি আমরা। এর মাঝে তিনবার কাজী অফিস পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছি। সেটা অবশ্য রাকা ওর বাবাকে খুব ভয় বলে। তবে সম্পর্কটার একেবারে ইতি টেনেছি আমি নিজেই। তিন মাস আগে এক বৃষ্টিবিলাসী বিকেলে।
পূর্ণেন্দ্র পত্রীর একটা কবিতায় মনে হয় পড়েছিলাম, ভালবাসলে নারীরা নাকি হয়ে যায় নরম নদী আর পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
রাকা নদী হয়েছিল ঠিকই। চোখের জলে নদীতে বান ভাসিয়েছিল। বৃষ্টির জল যেন পাত্তাই পায়নি সেদিন রাকার কাছে। তবে আমি জ্বলন্ত কাঠ হতে পারিনি। তার আগেই আরেক আগুন আমাকেই পুড়িয়ে ছাই করে দিল।
রেললাইনের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে। সেদিকেই হাঁটা দিলাম। হনহন করে হাটা।
-ক’দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করেন না?
-সেতো অনেক দিন। সাড়ে তিন বছর।
-কেন? খান না কেন? শরীরের কি হাল করেছেন জানেন?
-খারাপ কিছু হয়েছে?
-আপনাকে বলব না। আপনার গার্ডিয়ান একজনকে ডাকুন।
-আমার অভিভাবক আমি নিজেই। আপনি বলতে পারেন। আমার সহনশক্তি অনেক বেশী।
-পেপটিক আলসার ছিল এর আগে?
-জি। তবে ওষুধ খেয়েছিলাম তো নিয়মিত। আর পানিও।
-কি খেয়েছিলেন তা তো রিপোর্টই বলে দিচ্ছে। এমন কেন করেন বলেন তো!
-দেখুন, ডাক্তার। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। আমার বিকেলে একটা ল্যাব আছে।
-আপনার পাকস্থলীতে ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
এটা ছিল দুই মাস আগে ডাক্তারের সাথে আমার কথোপকথন। এর মাঝেও দুই বার গিয়েছিলাম জমানো টিউশনির টাকা থেকে ভিজিট দিয়ে। হাবিজাবি বলে শেষে বললেন ঠিকমত চিকিৎসা না করালে আপনার হাতে আর ছ’মাসও সময় নেই। সেই সময়টা আমার নিজেরই একটা সিনেমার দৃশ্যের মত মনে হল। এতকাল শুধু সিনেমাতেই এমন দেখেছি। কোন ডাক্তারই কি ছ’মাসের বেশী আল্টিমেটাম দিতে পারেন না!
অসুখের খবর কাউকে না বলার সিদ্ধান্ত নিতে আমার দুইরাত লেগেছিল। বন্ধুদের বললে এরা সাহায্যের জন্য হাত পাততে শুরু করবে এখানে ওখানে। জীবন ভিক্ষা চাই টাইপ পোস্টারিং করে আমার জন্য টাকা তুলবে। এমন ভাবাও আমার জন্য লজ্জাকর। নিজের জীবনের জন্য অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইব কেন!
আর বাবা-মাকে বললে শেষ যে বাড়িটুকু আছে সেটাও বিক্রি করে দিতে একদিন লাগবে না। কিন্তু লাভের লাভ হবে না কিছু। ওটা বেচে যা দাম পাবে সেটা দিয়ে আর কটাই বা ওষুধ কেনা যাবে। ফাকতালে বাড়িটা হারানো শুধু। জীবদ্দশায় তো কিছু দিয়ে যেতে পারলাম না বাবা-মাকে। মৃত্যুর আগে তাদের ফুটপাতে নামিয়ে দিতে চাই না।
এখন শুধু একটাই উচ্চাশা। শেষতক ইঞ্জিনিয়ারিংটা যেন পাশ করে যেতে পারি। অন্তত বাবা-মা বলতে পারবেন আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হত কিন্তু তার আগেই……
খুব ঘেমে যাচ্ছি। আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। একটা ফ্রিজওয়ালা মুদি দোকানে ঢুকে পড়লাম। পাঁচটাকার একটা কুলফি আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে খুব। দোকানে ঢুকে দেখি টোকাই মতন তিনজন দুইটা আইসক্রিম চাইছে চারটাকা দিয়ে। ওরা দুই টাকার কুলফি খাবে। তিনজনে দুইটা ভাগ করে খাবে।
ওদের কাছ থেকে চার টাকা নিয়ে আর আমার পাঁচ টাকা যোগ করে আমাদের চারজনের জন্য চারটা কুলফি নিলাম। সে কি খুশী হয়েছে একেকজন! আমিও যে কম খুশী তা কিন্তু নয়।
আমরা চার টোকাই মাঝদুপুরের পিচগলা রাস্তায় আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটা শুরু করলাম। একটা ফটোগ্রাফারের অভাব বোধ করছি। এই ছবিটা তুলে রাখলে অনেক পুরস্কারই শো-কেসে উঠত তার।
-আচ্ছা রুমী ভাই, আইসক্রিম কি দিয়া বানায়?
শহুরে রাজপথে করাল দাঁতগুলো পা মাড়িয়ে আইসক্রিম বানানোর ফর্মূলা শোনাতে লাগলাম রাজুকে। রাজু আমাদের মাঝে সবচেয়ে ছোট।