somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ বাবার কাছে শেখা প্রেম

১৩ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্বচ্ছ পলিথিনের একটা ব্যাগে চার ধরণের চারটা আইসক্রিম হাতে দাঁড়িয়ে আছে মুহিত। তার হাত-পা যেভাবে কাঁপছে তাতে যে কেউ দ্বিধায় পড়ে যাবে সাড়ে সাত রিকটার স্কেলে ভূমিকম্প হচ্ছে কি না! অন্যকেউ অবাক হলেও মুহিত হচ্ছে না, হওয়ার কথাও নয়। মিনিট পাঁচেক আগে সে মৌমীর বাবার হাতে কষে এক চড় খেয়েছে।
মৌমী মুহিতের প্রেমিকা, একই কলেজ থেকে এইবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ঈদের দিন মৌমী আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল মুহিতের কাছ থেকে। মুহিত আড়াই’শ টাকা দিয়ে চারটা আইসক্রিম কিনেছে তার সালামির সব টাকা দিয়ে। এরপর আইসক্রিমগুলো মৌমীকে দেয়ার জন্য ওদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, দোতলার বেলকুনিতে উঁকিও মারছিল ঘন ঘন। এই করতে গিয়েই বিপত্তি। হঠাৎ বাহির থেকে মৌমীর বাবা এসে হাতেনাতে ধরে ফেলল মুহিতকে। চড়-থাপ্পর-দাবাড়, একেবারে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ ছিল না!

এখন এই আইসক্রিমগুলো নিয়ে কি করা যায় তাই ভাবছে মুহিত। বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে না, তাহলে আম্মু সন্দেহ করবে।বকাও দিতে পারে এত টাকা খরচ করার জন্য। একা একা সে একটার বেশি আইসক্রিম খেতেও পারবে না। একবার ভাবল ফেলেই দিবে। শাপে বর হয়ে মুহিত ওর বাবার ডাক পেল। আস্তে করে হাত পিছনে নিয়ে আড়াইশ টাকার আইসক্রিম জলাঞ্জলি দিয়ে বাবার দিকে এগোলো মুহিত।

মোটরসাইকেল চালু রেখেই মুহিতের বাবা জিজ্ঞেস করলেন-
- চল যাই। যাবি?
- কোথায় যাচ্ছ?
- তোর দাদীর কাছে যাই। ওঠ।

এক মুহুর্ত দ্বন্দে ভুগল মুহিত। ঈদের দিন দাদুবাড়ি যেতে তার ভাল লাগে না। মুহিতের দাদু বেঁচে নেই। দাদী একা ওর ছোট চা্চার সাথে থাকে। মুহিতের বাবা অনেক চেষ্টা করেছেন তার মাকে তাদের কাছে শহরে নিয়ে আসতে। কিন্তু ওনার এক কথা- তোর বাবার কবর ছেড়ে আমি শহরে যাব না। মরলে এখানেই মরব।

- চল, তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। দেরি করব না।

মুহিত মোটরসাইকেলে উঠে পড়ল। ওর বাবা ওর কাছে কখনও আবদার করেনি। সবসময় চোখ রাঙিয়ে আদেশ করত। আজ বাবার আবদার মেনে নেয়ার সুযোগ হারালো না সে। মধ্যবিত্ত বাবার মধ্যবিত্ত মোটরসাইকেলে মুহিত স্বস্তিতে বসে পড়ল। রুপার পালকের মত কিছু একটা যেন কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সব বিব্রতকর ঘটনার স্মৃতি তার মাথা থেকে-শরীর থেকে এক নিমিষেই মুছে ফেলেছে। শিরশিরে বাতাসটা মুহিতের ভাল লাগছিল। হঠাৎ করে ঈদের দিন বাবার সাথে দাদীর কাছে যাওয়ার পুরো ব্যাপারটাই মুহিতের ভাল লাগা শুরু হলো।

বাবার চুলের দিকে চোখ পড়ল মুহিতের। গতরাতে কলপ দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পাকা চুল নিয়ে মায়ের সামনে যেতে লজ্জা হয় বোধহয়। আশেপাশের ফাকা মাঠ থেকে বাতাস আসছে, মুহিতের বাবার চুলগুলো উড়ছে। বয়স যেন অনেক কমে গেছে তার। দারুণ সুবাসের কি যেন একটা আতরও মেখেছে তার বাবা। মায়ের কাছে সব ছেলে সবসময়ই খোকাবাবু হয়ে থাকতে চায় বুঝি!

পকেটে রাখা ফোনটা কেপে উঠল দু’বার। মৌমী মেসেজ দিয়েছে নিশ্চয়ই। পকেটের ফোন পকেটেই থাক আজ। বাবা-ছেলের মাঝে আজ কেন যেন অন্য কাউকে টেনে আনতে ইচ্ছে করছে না মুহিতের। এমনি দিন তো এমন হয় না! মৌমীর সাথে ডেটিং থাকলে সে বাবার সকল নিষেধ না মানেই বাইরে বের হয়। বাড়িতে কি হয়ে গেল, কে কি খেল- কিচ্ছু যায় আসে না। আজ মন ঘুরে গেল এভাবে! বাবার পাঞ্জাবিতে মাখা আদরের কারসাজি নয় তো! নিজের মনেই হেসে ফেলল মুহিত।

রঙ চটে যাওয়া মোটরসাইকেলটার সামনের হ্যান্ডেলে কালো কাপড়ের একটা ব্যাগ বেধে রাখা। মাঝে মাঝে তেলের ট্যাংকির সাথে ধাক্কা খেয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দ করছিল। এতক্ষণ পর মুহিতের নজরে পড়ল ব্যাগটা।

- ব্যাগে কি বাবা?
- এই তোর আম্মু দিল কিছু খাবার। তোর দাদীর জন্য।
- দাদী কি আইসক্রিম খায় বাবা?
- কি? গাধা কোথাকার! এই বয়সে কেউ আইসক্রিম খায়!

মুহিতের আসলেই নিজেকে গাধা গাধা মনে হচ্ছে। এই প্রশ্ন নিজের বাবাকে কেউ করে! আসলে সালামির টাকা দিয়ে কেনা এতগুলো আইসক্রিম নষ্ট করার ক্ষতটা এখনও জ্বলছে মুহিতের।

- ঐ যে পাশের বিলটা? ওটার অর্ধেকটা আমাদের। ওইখানে ২৮ শতক জমিও আছে আমাদের।
মুহিতের বাবা মুহিতকে গ্রামে নিয়ে আসলেই এই কাজটা করেন। নিজের কেনা জমিগুলো মুহিতকে চেনান। মুহিতের ভালো লাগেনা। তার বাবার জমির উপরে তার কোন লোভ নেই। সে যা করবে নিজে থেকেই করবে। কিন্তু বাবা যেন বুঝেই না। আজও জমি চেনাচ্ছেন মুহিতকে। মুহিত খুব আগ্রহী শ্রোতার ভান করে সব কথায় ‘হুম হুম’ করে গেল। আজ কেন যেন সে বুঝল, নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত অর্থে কেনা জমিগুলো ছেলেকে দেখিয়ে খুব মজা পান মুহিতের বাবা। নিজেকে হয়ত তার সুখী সুখী মনে হয়।

বাবাকে সুখী করার জন্য সামান্য শ্রোতা হতে আজ কোন কার্পণ্য করল না মুহিত।
- জমিগুলা এত নিচু কেন?
- কই নিচু? ফসল তো ঠিকই হয়। বর্ষাকালে এক-আধটু পানি তো জমবেই।

নিজের জমির কোন দোষ শুনতে নারাজ তিনি। নিজ সম্পত্তির সাথে পরিচয় পর্বে ছেলের অংশগ্রহণ ভালো লাগছে মুহিতের বাবার। ছেলেটা তার অতটা খারাপ না। একদিন ঠিকই বাপ-মা’র দায়িত্ব নেবে।

পাকারাস্তার শেষ মাথায় যে শিকড় ছড়ানো শতবর্ষী বটগাছটা, ওটার বা পাশের মেঠোপথটা দিয়ে কিছুদূর এগোলেই মুহিতের দাদুবাড়ি। ঈদের দিন হওয়ায় আজ বটগাছটার নিচে অনেকগুলো ছোকড়া ছেলে গল্পগুজব করছে। দু’একজনকে মুহিত চেনে। চলন্ত মোটরসাইকেল থেকেই ‘ভাল আছ?’ জিজ্ঞেস করে বিনয়ের একটা হাসি দিল মুহিত।

বাড়ি পৌঁছে দেখে দাদী বারান্দায় বসে আছে। ছোট চাচা বোধহয় বাড়িতে নেই। ঈদের দিন, নিশ্চয়ই নতুন বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছে।

- দাদী ভালো আছেন?
- আছি কোনরকম। এই বয়সে আর ভাল থাকা! বস চেয়ারটা টেনে।

মুহিত তার বুড়ো দাদীর পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। মুহিতের বাবা ব্যাগটা খুলে এনে বারান্দায় টেবিলের ওপর রাখলেন।

মুহিতকে বললেন, ব্যাগটা খুলতো। টিফিনবাটির জিনিসগুলো প্লেটে করে নিয়ে আয়।

মুহিত টিফিনবাটি থেকে মোরগ পোলাও, কোরমা, টিকিয়া বের করে একটা প্লেটে সাজিয়ে আনল। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারল না, তার দাদীর তো মিষ্টি, গরুর গোশত এসব খাওয়া নিষেধ। তাহলে বাবা কোরমা, টিকিয়া এনেছে যে!

- বাবা নাও।
- এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। গ্লাস ভাল করে ধুয়ে আনিস।

গ্লাস নিয়ে এসে মুহিত তার চেয়ারে বসে পড়ল। তার বাবা দাদীর সামনে একটা টুল পেতে বসেছেন। হাতে প্লেটটা নিয়ে হাতে তুলে খাওয়াচ্ছেন তার মাকে। এমন দৃশ্য কি আগে দেখেছে মুহিত! হঠাৎ মনে হলো তারা তিনজন ছাড়াও চতুর্থ একজন, স্বয়ং স্রষ্টাও যেন বসেছেন তাদের সাথে। মুহিতের সাথে তিনিও অপলক চেয়ে আছেন মা-ছেলের দিকে।

- এটাতে তো মিষ্টি! ডায়াবেটিস জানিস না? তবু কোরমা খাওয়াচ্ছিস কেন? আর টিকিয়া তো মনে হয় গরুর গোশতের? তুই তো আমাকে একদিনেই মেরে ফেলবি!
মুহিতের দাদী রাগের ভান করল ছেলের উপর।
- আরে একদিন খেলে কিছু হবে না। ঈদের দিন কোন কিছুর মানা নেই।

মুহিতের বাবা তার দিকেও একটা গোশতের টুকরা এগিয়ে ধরেছেন। কিঞ্চিত ইতস্তত করে প্রায় গোগ্রাসেই বাবার হাত থেকে টুকরাটা ছিনিয়ে নিল মুহিত। এমন স্বর্গনাটিকায় যৎসামান্য হলেও একটা পাঠ না করলে কিসের জীবন!

মুহিতের চোখের কোণায় অজ্ঞাত ফড়িংযের মত একফোটা জল কখন যে এসে জমেছে টেরই পায়নি সে। একেই বুঝি ভালবাসা বলে, একেই বুঝি প্রেম বলে! নিজের প্রেমে আজকের ব্যর্থতার ইতিহাস তার ডায়েরিতে লেখা থাকবে নতুন দিগন্তের লাল আভা ছড়ানো কোন প্রেম শেখার ইতিহাস হয়ে।

- বাবা আমি একটু আসছি। ঘুরে আসি।

মা-ছেলেকে একা সময় দিয়ে মুহিত মনের ঘড়ির কাটায় হাঁটতে শুরু করল, মেঠোপথের ঘাস ছুঁয়ে।

১১/০৮/১৩
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×