somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মদপর্ব

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সামনে কিছু নেই, শূন্যতা আছে। নতমুখ জল থির হয়ে আছে। বাঁধানো ঘাটের টানে অস্থির মন। মনের ছায়ায় ঝরে গেছে দিন, মদের কুসুম। যে-পাতা সন্ধ্যা জ্বেলেছে ধীরে—তার সবুজ ঘ্রাণে লোকালয় একাকার। নতমুখি নদ ভাসান অস্বীকার করে। হাতের ভাঙনে স্মৃতিচিহ্ন রোদ—রোদ আসে খুব ভোরে। সামনে কিছু নেই শূন্যতা আছে, সামনে আমি আছি নিজের কাছে।


উপুড় ভাবনায় ক্ষয় হয় নিশা। নিশা রাত্রির যমজ। রোদের রেকাবে সাজানো সকাল। ক্ষয়িষ্ণু রাত স্মৃতিতে থাকে না। কাচের জানলায় ধূলির নকশা। আঙুলে ভেঙে দিই প্রকৃতির খাপ, উপুড় শরীরে ক্ষয় করি পাপ।


ভোররাতে নিঃশব্দে আসে ট্রেন; থামে কুয়াশার কোল চিরে। ভিড় নেই, যাত্রিদল শ্মশানের ছাই। শাদা নিঃশ্বাসে স্বপ্ন পুড়ে দূরে। এই ভেবে ঘাসের ছায়ায় থাকি—ঘাস ছিঁড়ে চরাচর বিবর্ণ জোনাকি।


আমি দেখলাম তাদের সৌকর্য, দেখলাম তাদের ভাবালুতা নির্লিপ্ত সুর। আমি তাদের উন্মোচিত দেখলাম। তারা গোর খুঁড়ে নিঃসঙ্গ। তারা গোর খুঁড়ে ভোরের শরীরে। ভোরের শরীর ভৈরবী স্বপ্ন। আমি সপ্তবন্ধ গানের কারুকাজ দেখলাম। তারা মূলত কাকে সমাহিত করবে?


আমি দেখছি তুমি এবং আমি। তুমি তাদেরই একজন, দেখছি একজন তুমি ঈশ্বর। আমি আমার নিজের ভিতর। তুমি পার্থিব আলোশেষ। তুমি ধীরসুর রক্তলগ্ন সন্ধ্যাবশেষ। তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক হয় নি। আমি বিপরীত প্রস্থান। এখন দাঁড়িয়ে হারিয়ে গিয়েছি বেশ।


সে ফেনায়িত ঢেউ। একটি আঙুল ছুঁয়ে দেয় ফেনা। তার উষ্ণ পাঁজর। সে ছিলো চিহ্নের শহর। তার নুন প্রতীক্ষারত প্রান্তর—জীবন্ত অধীর। সমুদ্র হবে ভেবে আঙুল অস্থির। সে ফেনায়িত ঢেউ; সে এসেছিলো কেউ।


জানলাম সন্তরণ উত্তাল। তাকে ঠেলে দিলাম স্রোতে। সে জানলো না। তার ডুবে যাওয়া সুন্দর। প্রাণান্তকর নদকেলি শেষে ডুবে যাওয়া। সে ডুবে গেলো। ভেসে উঠলো দেহহীন। ভেসে উঠলো তার নখ। ভেসে উঠলো তার চুল আর অলক।


কানাকুয়াপাখিটি দেয়ালের ভুল। কবেকার চুনকাম! কামরাঙা গাছটির সবুজচুল ধারাবাহী ছত্রাক। বাহিরে দেয়ালের ভাঙাকাচে কানাকুয়া, খড়িমাটি দুআঙুলে দেয়ালে শোয়া।


তারা তখনও দাঁড়িয়ে। ঝড় তাদের বিভেদ করে গেলো শুধু। কুড়িয়ে নিলো। আর এই ভুল চিরদিন চির অমর, এই ভুলেই এই গাঁয়ে ছুটে আসে ঝড়।

১০
বাতিদান ঘুমিয়ে আছে। ঝিরিঝিরি ভেসে গেছে স্মৃতি। যেখানে আমরা অপেক্ষার ঘর—যেখানে আমরা অপঠিত অক্ষর—সেইখানে কেঁপে উঠে খড় অকারণ। কারণ আছে ভাবিনি। একটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছি। আমরা দূরত্বের বিষয়।

১১
যদি আমরা তার মৃতশব্দ ধরে রাখি—যদি তার কাগজের হাতে নদী না ছোঁয়াই—যদি তার পারিজাতে রক্ত না লাগাই—সে থাকবে পাথরের প্রাণ, সে থাকবে গাছের বল্কল, সে কাছে আসবে আর ছুঁয়ে দেবে, ছুঁয়ে দেবে সোমত্ত আকাশ। তার বিবসন ত্বকে সবুজফড়িং। সে এসে তারপর চলে যাবে।

১২
আর ইহাই নিঃশ্বাস রূপে নামে। নিঃশ্বাস ধীরে নামে শতদল। হরিণের অতলান্তচোখে নামে চঞ্চল। যমজহাঁসের সন্তরণে মৃত্যু হয়ে নামে। আমাদের ঢেকে দেয় ধোঁয়ার চাদরে। সমতট শহরে আমরা থাকি। আমাদের বাড়িঘর ভাসে সাম্পান; আমাদের মাথার ভিতর জং ধরা আযান।

১৩
আমরা তার পাখি উড়তে দেখি। কামরাঙাগাছে বসে মাছরাঙাপাখি। স্মরণীয় পথ থমকে থাকে। এটা সবসময় সত্য। তার পাখি আসাযাওয়া নিরন্তর। সে বুক চেপে রাখে বুকপকেটে। হরিৎ হাওয়ায় দুলে তার বাসনা।

১৪
কোনোদিন এই দিন—এই হাওয়া এই কাঠবিড়ালি বিদ্যুৎ—আমি দেখবো ইন্দ্রজাল। মাকড়সাটি করবে সন্তরণ এঘর-ওঘর। আমার কাঁধে সুরম্য পাতাবাহার। হাতের ভাঁজে ডুমুরের ফুল। উরুতে শীতকাল। কোনোদিন আসবো না আর। একদিন থাকবে না আমার সকাল। রাতে জেগে খেয়ে নেবো ঘুম। নখচিরে জাগাবো রক্ত নিঝুম।

১৫
অনেক দেরি হয়ে গেলো। পূর্ণ হলো না ঘুম। তাড়াতাড়ি করো। তাড়াতাড়ি পোড়ো। তাড়াতাড়ি উড়ো। আমরা আর ফিরে পাবো না। ফিরে পাবো না নিশ্চিত বন। এই নাও যাকিছু গোপন।

১৬
এখানে সে এনেছে সকলি। বাতাস কুড়িয়ে এনেছে। এনেছে তন্দ্রাহত সুখের বকুল। পিঁপড়ার সারিপথে এনেছে। কোথাকার গুহাদ্বারে গিয়ে ফিরেছে। পৃথিবীকে একবার শূন্য করেছে সে—পূর্ণ করেছে শেষে। আমরা নেই তখন। তারাও নেই তখন—দূরে বনষ্পতির ঝাড় নিঝুম শালবন।
১৭
ইদানীং তারা জেনেছে সূর্যের চুম্বন। গহ্বরে নৃত্য আছে জেনেছে। কখনও মুকবধির পশু। সূর্য আর গুহাপুরাণ একাকার। এই শহর ঘনায়মান বনের আকার।

১৮
ঘুমের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে তারা আসে। সম্ভাব্য সকল সুরে ডানার গন্ধ। ব›ধ দরোজার ফাঁকে সূর্য। লাজলজ্জাহীন আলো সুন্দরবেশ। কাঠবিড়ালির গানে প্রলম্বিতপথ। পথের রেখায় ভাঁটফুল কাঁপে। পথের ওপারে খড়ের বাগান। বাগানে বাদামি গান। গান শেষে কিছু নেই ঝর্ণার ছল। ঘুম ভেঙে চোখের কোলে রাতের কাজল।

১৯
রোদের বারান্দায় শীতকাল। তাদের দুজনে নগ্ন ভাসান। শীতের গায়ে ব্যাপক চাদর। চাদরের ভাঁজে চারকোল আছে। চারকোল আঁকে স্মৃতিরূপ রেখা। এই বিষ এই অমৃত প্রত্নগন্ধ সুর—রোদের বারান্দায় ক্রমশ দুপুর।

২০
একটি মুখ দৃষ্ট হলো নদে। নদের তলায় কাদাগন্ধ সুধা। এই মুখ কেউ দেখে নি কখনও আগে। একটি মাছ সাঁতরে এসে নিয়ে যায় মুখ। এই মুখ মাছের চোখেই হবে সুখ।

২১
যখন তারা এটা ধরলো—কিছুই দেখা গেলো না। আমরা চোখবুজে দেখলাম ধানক্ষেত অনেকক্ষণ। এটা কী? এটা বিস্মৃতি।

২২
আমরা দেখার চেষ্টা করলাম। আমরা দেখলাম দৃশ্য। দৃশ্যান্তরে নিভে গেলো আলো। আলো কী, আলো কি চেতনা? আলো বুঝি আগুন। আলো অন্ধকারের সহোদর বোন।

২৩
দুইটি শিয়াল বিপরীত রাস্তায় ঘুরে। সন্ধ্যারাত ফুরিয়ে গেলে তারা যাবে, তারা যাবে। গন্তব্যের ঘ্রাণে বিবশ স্মৃতি। জ্বলজ্বলে চোখ আছে নিখুঁত সন্ত। এইপারে বন আর ওইপারে পাড়া, শিয়ালেরা ঘুরে ঘুরে দেয় পাহারা।

২৪
আমাদের স্তিমিত চোখের সামনে সূর্যাস্ত। সূর্যাস্তের সুর অনেক মলিন ম্রিয়মান। আকাশকে নীরবে দংশন করে ফিরি। বাতি জ্বালি সূর্যের আকার। এটাও এক ধরনের পুজো। আরতি শেষ হয় না কখনও—সূর্যাস্তে শুরু হয় কেবল।

২৫
ফুলের বোঁটা ভালো লাগে। আরও কোমল নতজানু কাঁটা। শীতের কোলে বাষ্প জোছনা ধোঁয়া—আমার ফুল বলতে তাকেই কেবল ছোঁয়া।

২৬
কাল রাতে হাওয়া আমাকে জাগালো। একটি গাছ এবং একটি পাখি আমি জেগে উঠলাম। বাতাস আমাকে ঘিরে ধরলো। বাতাসের আঙুলে আমি পাতা ও পালক খুলে দিলাম। আমার পাতা ও পালক প্রাণ পেলো। আমার জাগরণ আনন্দ হলো।

২৭
তারা একে একে বিবসন হলো। সামনের রাস্তায় দাঁড়ালো পাথরের পাশে। অনেকক্ষণ দাঁড়ালো এবং ভেংচি কাটলো। তারপর পাথর হয়ে গেলো একটি কাঠবিড়ালিপাখি। উড়ে এলো। পাথরের গায়ে গায়ে লাফিয়ে বেড়ালো। আর পাথর ভাস্কর্য হলো।

২৮
সাঁতার শেষে পাথরে বসলাম আমি। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। বাষ্পের রং দেখে পাথর ছেড়ে উঠলাম। বাষ্প আমাকে নিলো না। সহসা শীতকাল এলে তাকে নিলো। বাষ্প পুনর্বার রং পাল্টালো শাদা। বাষ্প হারালো তার কোমল। বরফ আর পাথর দোটানায় ফেলে দিলো। আমি চোখবুজে হলাম সঘন চক্রমন।


২৯
আমি স্ববর্ণ ধারণ করলাম ধীরে। তার স্তন চুষে নিলাম যা আছে অমরতা। অস্ফূট হাতে তার দেহে ঢাললাম উষ্ণ-নদ। এবং তার পদমূলে শুয়ে শিশু হয়ে গেলাম।

৩০
আমি গাছের কম্পনে হাত রাখলাম। গাছ দাবানল জানে। গাছের ডালে ছিলো কাঠবিড়ালি। তার সোনালি ডানায় গল্পের সুখ। তাকে কাঁধে নিয়ে উড়ে গেলাম ঢেউয়ে। গাছ হাসলো নিঝুম গাছবনে। গাছ দাবানল জানে।


(রচনাকাল : ১ আগস্ট ২০০৮, সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ - রাত ১১টা ৫৯)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১০:৩৬
৪৭টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×