ফেব্রুয়ারী মাস এলেই আমরা গোটা বাংলা ভাষাবাসীরা বাংলাভাষার জন্য উদ্ববেলিত হয়ে উঠি। সভা সেমিনারে, বক্তৃতা বিবৃতিতে মাতম তুলি! চিবিয়ে চিবিয়ে, রশিয়ে রশিয়ে “বাণী” প্রদান করি। কেউ কেউ বলেন-“আমরা বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বুকের রক্তে তখনকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিলাম”! এই কথাগুলো শুধু আমাদের মনে পরে ফেব্রুয়ারী মাস এলেই। আমাদের মুখে কথার খৈ ফোটে, কলমে আগুন ঝরে, গর্বে ফুলে ওঠে বুকের ছাতি! প্রতি বছরের মত এবারো ফেব্রুয়ারী মাস শুরু হয়েছে ভাষার বন্দনাগীতিতে। এবারো একুশের বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে হাজার হাজার বই। লেখার বৈচিত্রে ভরে গিয়েছে সংবাদপত্রের পাতা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে টকশো হয়ে ঊঠেছে আরো বেশী প্রানবন্ত। লেখক, প্রকাশক পকেট ভারী করেছেন এবং আরো করবেন।তারপর আমরা ১১ মাসের জন্য ব্যাস্ত হয়ে পরবো যার যার কাজে। পরবর্তী ফেব্রুয়ারী মাস না আসা পর্যন্ত মাতৃভাষার আবেগ প্রশ্রয় পাবেনা কোথাও।
কিন্তু যাদের নিয়ে আমাদের এই অহংকার সেই শহীদ পরিবার কেমন আছে তা নিয়ে আমরা ভাবার অবকাশ পাইনা দুদন্ড! এমন কি ফেব্রুয়ারী মাসেও।আমি সেই সব শহীদ পরিবারের খবর জানার জন্য অনেকগুলো খবরের কাগজ ঘাটাঘাটি করেও কোন হদিস পেলামনা। তবে একটি পাঠক অপ্রিয় অপ্রচলিত খবরের কাগজে ছোট্ট একটা খবরে জানতে পারি-রাজধানীর তেজকুনিপাড়ার ১৬৫/১/এ নম্বরের একটি জীর্ণশীর্ণ “শহীদ জব্বারের মায়ের বাড়ি” বাড়িতে থাকেন-শহীদ জব্বারের একমাত্র ছেলে আয় রোজগারহীন বাদল তার পরিবার সহ।শহীদ জব্বারের মা এবং তাঁর উত্তরসুরিদের মাথাগুজে থাকার জন্য ১৯৭৩ সালে সরকারী অনূদানে এটি নির্মিত হয়েছিল। বাড়ি নির্মানে বরাদ্ধ হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু মাত্র ২৫ হাজার টাকা ব্যায়ে বাড়িটি নির্মান করা হয়েছিলো যেনো তেনো ভাবে। গত ৩৫ বছরে বাড়িটির কোন সংস্কার হয়নি।গত ছয় বছর যাবত সরকারি বরাদ্ধ সামান্য ভাতায় কোন রকমের চলছে শহীদ জব্বারের পরিবার।
শহীদ জব্বারের পরিবারের সাথে নিশ্চয়ই অন্যান্য শহীদ পরিবারের দৈণ্যদশার কোন তারতম্য হবে বলে আমার মনে হয়না। আসলে শুধু ফেব্রুয়ারী মাস এলেই সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যাণনলগুলো ভাষা সৈনিক, ভাষা শহীদ পরিবার সম্পর্কে কিছুটা খোঁজ খবর নেয়ার চেস্টা করা হয়-শুধু মাত্র পত্রিকা অফিস এবং মিডিয়া হাউসগূলোর নিজস্ব কৃতিত্ব দেখানোর জন্য। অবশ্য ফেব্রুয়ারী মাসের পাওয়া মিডিয়া কভারেজের কল্যাণেও সরকারের কিম্বা দেশের ‘দানশীল’ ব্যাক্তিদের নিদেন পক্ষে লেখক-প্রকাশকদের সামান্যতম সহানূভুতি পেতে পারেনা আমাদের ভাষার জন্য জীবনদানকারী ভাষা শহীদ পরিবার! ফলে ভাষা শহীদ পরিবার অনাদর আর অবহেলায় দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছে আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া মননের সাক্ষী হয়ে!
সামান্য উদ্দ্যোগী হলেই ভাষা শহীদ পরিবারগুলোর একটি প্রজন্মকে যথাযথ সহযোগীতা করা হলে তাঁরা সবাই দৈণ্যদশা থেকে মুক্তি পেতো। জাতি হিসাবে আমরাও তাঁদের কাছে ঋণ স্বীকারের স্বস্তি অনুভব করতে পারি। ট্রিলিয়ন টাকার জাতীয় বাজেট দিয়ে আমরা প্রতি বছর রেকর্ড করে যাচ্ছি। এই রেকর্ড পরিমানের অর্থ থেকে সামান্যতম অর্থ যদি ভাষা শহীদের জন্য ব্যায় করা যেতো তাহলে আমরা বড় ধরনের একটা গ্লানি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। আর সরকারের যদি এ ব্যাপারে নিদ্রা ভংগ না হয়-তারপরও আমাদের করার থাকে অনেক কিছু।
“ভাষাপ্রেমী” আমরা প্রতি বছর প্রভাত ফেরি করে শহীদ মিনারে অর্পণের জন্য যত টাকার ফুল কিনি এক বছর তার কিছু অংশ বাঁচিয়ে শুধু সেই টাকাগুলো একত্র করে ভাষা শহীদদের পরিবারগুলোকে বন্টন করে দিলে তাদের পরিবারের দারিদ্র দশার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।