নিত্যদিনের মত দুপুর দুইটায় ঘুম থেকে উঠে ভাইগ্নারে কইলাম,
"আইজকা দিনে প্যাপার দিছে?"
ভাইগ্নাঃ "দিছে।"
"কোনে প্যাপার?"
ভাইগ্নাঃ "বড় কামরায় পালংকের উপর রাখা আছিয়ে।"
"যা গিয়া আইস্তে ধীরে টান মারি প্যাপার লই আবি। আওয়াজ কইরবিনে।"
ভাইগ্না "আইচ্ছা" বইলা চলি গেল।
এদিকে চার মিনিট যায়। দশ মিনিট পার হইয়া যায়। বিশ মিনিটের মাথা পেটের চাপ ক্রমাগত বাড়িয়া যায়।তবু ভাইগ্না পত্রিকা নিয়া আসেনা। শেষে বাধ্য হইয়া পত্রিকার আশা ছেড়ে দিয়ে বাথরুমে গেলাম। আমার আবার প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠার পর বাথরুম এবং ফ্রেশ হবার আগে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস। এবং প্রতিবার পত্রিকাটা ভাইগ্নাই এনে দেয় তার নানা ভাইর কামরা থেকে।আজকাল হল কি ছেলেটা পত্রিকা আনতে বড় দেরী করতেছে।
পাক্কা দেড় ঘন্টার পর বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি ভাইগ্না এখনো পত্রিকা এনে রেখে যায় নাই। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম। বলতে পারে নাই। আব্বার রুমে ঢুকে পত্রিকা আনার সাহস আমার নাই। দুখান নাস্তা খেয়ে ভাইগ্নার খোজে বের হলাম। সারা বাড়ী খুজে ভাইগ্নাকে খুজে পেলামনা। শেষে বাড়ীর ছোট বুয়া বললো,বড় বুয়ার জন্য পান নিয়ে আসার সময় ভাইগ্নাকে নাকি লিফট থেকে বের হতে দেখেছে।
নীচতলায় নেমে দেখি ভাইগ্না হুন্ডার উপর আয়েশী করে শুয়ে পায়ের উপর পা রেখে আরামসে পত্রিকা পড়তেছে। এমুহূর্তে আমারও করনীয় হচ্ছে,মাথা গরম করে ভাইগ্নার দু'পা ধরে ধোপার মত কয়েকটা আছাড় মারা। কিন্তু আমি সেটা করলামনা। শুধু হারিয়ে গেলাম আমার ছেলেবেলায় স্মৃতিতে।
নব্বই দশকের কথা।
সাদাকালোর মানসপট।
পুরাতন ঢাকায় আমাদের বাড়ীকে ঘিরে গল্প। বড্ড জাদরেল ছিল আমার নানা। তার ইচ্ছাতেই এ বাড়ীর সব কিছু। হুকুম ছাড়া একটা পিপড়া ঢোকার অনুমতি নাই। রক্ষনশীল পরিপার যা হয় আমাদের তাই। সব কিছু বিধি নিষেধ সাথে আরেকটা বিধিকানুন আছে এ বাড়ীতে ছোটরা পত্রিকা পড়তে পারবেনা। সে সময় আমার নানার ইনকাম সোর্স ছিল কয়েক ডজন রিক্সা আর গুটি কয়েক বেবী এবং বাস-টেম্পু ভাড়া দেওয়া। আর নবাবগঞ্জের বাজার। বড় মামা সকালে উঠে মতিঝিলে তার অফিসে যেতেন। মেজমামা নানার অফিসে বসে রিক্সা,বেবী,বাস-টেম্পু এবং বাজার ও ফার্মেসী তদারকী করতেন। নানা এবং মেজমামা খুব ভোরেই চলে যেতেন।পরে নানা সকাল সাতটার দিকে বাসায় এসে নাস্তা করে পেপার পড়ে ঘুমিয়ে যেতেন। আর আমি পেপারটা বগলদাবা করে নাস্তা নিয়ে নানার অফিসে যেতাম। যাবার আগে পেপারটা লুকিয়ে রাখতাম। মামাকে নাস্তা দিয়ে বলতাম, "নানার খবরের কাগজ পড়া হয় নাইগা। আমারে কইছে,পড়া হলি আমারে দিয়া পাঠাই দিবো।" শুনে মামা কিছু বলতোনা। আর আমি বাসায় আসার কথা বলে পেপারটা নিয়ে চলে যেতাম হাজারীবাগ পার্কে। সেখানে এক বেদীর উপর বসে খুব মনোযোগ সহকারে পেপার পড়তাম। পড়া শেষ হলে পেপারটা অফিসে মেজমামার কাছে দিয়ে বলতাম, "নানার পড়ার শ্যাষ।" বাসায় যেহেতু ছোটদের পত্রিকা পড়া নিষেধ সেহেতু নিত্যদিন এই কৌশল অবলম্বন। এভাবে একদিন। দুইদিন। একমাস। ছয়মাস। একদিন পার্কে বসে পেপার পড়তেছিলাম। হঠাত সিগারেটের বিকট গন্ধ নাকে আসলো। আমি আবার ছোটবেলা থেকে সিগারেটের ধোয়া সহ্য করতে পারিনা। তাই গন্ধের উৎস খুজার জন্য উদ্যেত হলাম। আশে পাশে তাকাতে গিয়ে দেখি মেজ মামা শেখ মুজিবের জ্বলন্ত চুরুট হাতে কঠোর অথচ শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমিতো ভয়ে আধামরা। মামা চোখের পাতা ফেলার আগে পত্রিকা ফেলে আমি উধাও। সন্ধ্যায় দুরুদুরু বুকে বাসায় ফিরলাম। নিশ্চিত ছিলাম আজকে কপালে শনি আছে। অমা বাসায় দেখি কেউ আমাকে কিছু বলতেছেনা। ভ্রুক্ষেপও করতেছেনা। কয়েকবার মেজ মামার সামনে পড়তে গিয়ে এড়িয়ে গেলাম। মামা কিছু বললোনা। আজ পর্যন্ত কিছুই বলে নাই। এমনকি ঘরের কাউকে বলে নাই।
কল্পনার দৃশ্য থেকে ফিরে দেখি হুন্ডার উপরে ভাইগ্না নাই। হুন্ডার পাশে ভাইগ্নার জুতা আর আজকের প্রথম আলো পত্রিকা পড়ে আছে।