ছয়
কেন্দ্রীয় সরকারে সংবিধান প্রনয়ন নিয়ে অচল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গর্ভনর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ গনপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে খাজা নাজিমুদ্দিনকে অপসারন করে। এই সময়টিতে সারা পাকিস্তান ব্যাপি দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মওলানা ভাষানী পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। অনেক ঘটনা-অঘটনার মধ্যদিয়ে 1956 সালে 4 মার্চ জেনারেল ইস্কান্দার র্মীজা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। 23 শে মার্চ রাতে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পরিষদে পশ্চিমা তাবেদারী ভিত্তিক একটি নতুন সংবিধান প্রনীত হয়।
কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের নয় জননেতা এই সংবিধান ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক অনৈতিক বিবৃতি প্রদান করেন। আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গন-পরিষদে সংবিধান সস্পর্কীত এক বক্তৃতায় বলেন ‘আমি এমন সংবিধান চাই না, যা দেশের একাংশের স্বার্থের উদগ্র তাগিদে অপরাংশের স্বার্থের পরিপন্থি হয়। এতদ্ব সত্যেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী এই সংবিধানকেই পূর্বপাকিস্তানের জনগনের উপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু 1957 সালের 27 জুলাই প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে কমিউনিজমকে ‘স্বাধীন বিশ্বের জন্য হুমকি হিসাবে উল্লেখ করেন এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করেন। এদিকে বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী প্রথম প্রকাশ্যে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ কথা উল্লেখ করেন। দুই নেতার পাল্টাপাল্টি অবস্থানের সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার বাঙ্গালীদের প্রতিবাদী কন্ঠরোধ করতে ও ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করতে আইয়ুব খান নেতৃত্বে 1958 সালে সামরিক শাসন জারি করে। 1962 সালের 17ই সেপ্টেম্বর ছাত্রদের ডাকে আইয়ুব আমলের প্রথম হরতাল পালিত হয়। এই সময় ছাত্রদের নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর আহম্মদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং কাজী ফিরোজ রশিদগং। মূলতঃ তাদের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলনে স্বাধীনতা নামে এক নতুন স্লোগান উঠে যার মূলহোতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। এই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন ছাত্রনেতারা সেনাবাহিনীতে অবস্থানরত বাঙ্গালী তরুন অফিসারদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মাজেদ খানের বাসায় গোপনে এক বৈঠকে মিলিত হন। উক্ত বৈঠকে বাঙ্গালী তরুন অফিসার ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধূরী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক বক্তব্যে বলেন ‘তোমাদের আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি স্বাধীনতা হয়, তাহলে আমরা বাঙ্গালী অফিসাররা রাইফেল তোমাদের পক্ষ হয়ে ওদের দিকে ঘুরিয়ে দিব (ডঃ মোহাম্মদ হান্নানের বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-267) এদিকে 1962 সালে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের অসুস্থ্যতা এবং ভাসানীকে জেল-হাজতে বন্দি করে আইয়ুব খান নিজেই সংবিধান ঘোষনা করে, নিবাচনীর্ক টোপ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মজিবকে মুহিত করে। ভাসানীর ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়নের অধিকাংশ নেতা কর্মীদের জেল ও পলাতকে বাধ্য করে সোহরাওয়ার্দী পন্থি ছাত্রলীগকে কিছু ছাড় দিলেও (উদাহারন স্বরুপ বলা যায় সাবেক মূর্খ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের মেয়ের বিয়েতে সোহরাওয়ার্দীসহ ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাদের উপস্থিতি) অল্প কিছুদিন পরেই আইয়ুবের আসল চেহারা বেড়িয়ে আসে। হঠাৎ করেই করাচী বিমান বন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে গ্রেফতার করা হলে ছাত্র রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন নামের দুইটি সংগঠন যৌথভাবে আন্দোলনের ঘোষনা দেয়। তাদের যুগপৎ আন্দোলনে পূর্বপাকিস্তানের ‘ছাত্র আন্দোলন’ চাঙ্গা হয়ে উঠে। 1962 সালের 2রা থেকে 6 এপ্রিল আশি হাজার মৌলিক গনতন্ত্রীদের ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ‘আওয়ামী লীগ’ এবং ‘ন্যাপ’ এই নির্বাচনকে বয়কট করে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ আটদফা দাবি নিয়ে একটি ‘দাবিনামা’ প্রণয়ন করে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী এবং খুলনার সবুর খানের সাহায্য কমনা করে ব্যর্থ হয়। ফলে ছাত্রনেতারা তাদের দাবি নিয়ে তেজগাঁও বিমান বন্দরে উপস্থিত হলে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম নেতা কাজী জাফর আহম্মদ ‘মোনায়েম খানের জামার কলার চেপে ধরে এক বক্তৃতায় বলেন ‘আপনি সেই মোনায়েম খান যিনি ভাষা আন্দোলনের বিরোধীতা করে ছিলেন; আপনি সেই মোনায়েম খান যিনি রাজবন্দিদের মুক্তির বিরোধীতা করার স্পর্দা দেখিয়েছেন। পাপীকেও পাপের প্রায়শ্চিত করার সুযোগ দিতে হয়, আপনাকেও দিচ্ছি; বলুন আপনি আইয়ুবের বিরোধী এবং রাজবন্দিদের মুক্তির কথা বলবেন। পশ্চিমাদের শোষন-নিপীড়নের হাত থেকে বাঙ্গালীদের মুক্তির লক্ষ্যে 1962 সালে শেখ মজিবুর রহমান আত্মগোপনকারী কমিউনিষ্ট নেতা মনি সিংহ ও খোকা রায়ের সঙ্গে গোপন বৈঠকে শেখ মজিবুর রহমান বলেন ‘দাদা একটি কথা আমি খোলা মনে বলতে চাই; আমার বিশ্বাস গণতন্ত্র ও শ্বায়িত্তশাসনে কিন্তু পাকিস্তানীরা তা মানবে না, কাজেই স্বাধীনতা ছাড়া বাঙ্গালীদের মুক্তির উপায় নাই। ইতিমধ্যে কাস্মীর সংক্রান্ত গোলযোগের কারনে 1965 সালে পাকিস্তান-ভারতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান শাসকচক্র যুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানের যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে অধিকহারে বাঙ্গালিদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে আত্মহুতির দিকে ঠেলে দেয়। অসীম সাহস ও দক্ষতা নিয়ে তারা প্রানপণ যুদ্ধ করলে জাতিসংঘের মধ্যস্তায় ‘তাসকন্দ চুক্তির’ মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ইতিমধ্যে দেশের সাধারন জনগন স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ফলে মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘ইনার সার্কেল নামে স্বাধীনতাকামী গ্রুপের’ আহব্বানে শেখ মজিবুর রহমান আগরতলায় যান। সেখানে স্বাধীনতাকামী সামরিক ও বেসামরিক কর্মকতাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সহযোগিতা চান। আগরতলা থেকে ফিরে এসেই তিনি 1966 সালের ফ্রেরুয়ারী মাসে বাঙ্গালীর ‘মুক্তির সনদ’ হিসাবে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি প্রেস করেন। এই ছয় দফা প্রস্তাবে বলা হয়-
১. লাহোর প্রস্তাব এর ওপর ভিত্তি করে সংবিধান একটি ফেডারেল ও সংসদীয় সরকারের অস্তিত্ব নিশ্চিত করবে, যে সংসদের সদস্যরা জনসংখ্যার ভিত্তিতে গঠিত নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিনিধি হিসেবে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভোটে নির্বাচিত হবেন। আইন প্রণয়নকারী পরিষদ প্রশাসনের চেয়ে উচ্চতর বলে বিবেচিত হবে।
২. ফেডারেল সরকার শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করবে, অবশিষ্ট বিষয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।
৩. উভয় ভাগে নিজস্ব মুদ্রা ও তহবিল থাকবে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া রোধ করা গেলে অভিন্ন মুদ্রা চালু থাকতে পারে।
৪. কর ও রাজস্ব আদায় প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারভুক্ত হবে, এবং ফেডারেল সরকার সংবিধানে স্বীকৃত পদ্ধতিতে প্রাদেশিক সরকারের কাছ থেকে অর্থের যোগান পাবে।
৫. প্রাদেশিক সরকার তার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে, স্বাধীণভাবে বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারবে এবং অন্য দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক অর্থ প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হবে।
৬ . প্রাদেশিক সরকার তার নিজস্ব মিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে।
ছয় দফার স-পক্ষে ব্যাপক জনপ্রিয়তা গড়ে উঠে। বাঙ্গালীরা এটিকে তাদের ‘মুক্তিরসনদ’ হিসাবে বিবেচনা করে। 1966 সালে 7 মার্চ ছয়দফা ঘোষনাটি সারা পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়। শেখ মজিবুর রহমান 11 মার্চ ঢাকা বিমান বন্দরে সাংবাদিক সম্মেলনে ছয়দফা ব্যাখ্যা করেন। 1966 সালের 12ই মার্চ ‘রমনাগ্রিনে বেসিক ডেমোক্রেসিস সম্মেলনে আইয়ুর খান ছয়দফা দাবি অবজ্ঞা করে অস্রের ভাষায় কথা বলতে থাকেন। মুসলিম লীগ, জামায়তে ইসলামী, পিডিপিসহ ডানপন্থিরা ছয়দফা দাবিকে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির জন্য বিপদজনক বলে উল্লেখ করেন।
সাত
1966 সালের 18মার্চ মতিঝিলের হোটেল ইডেন গার্ডেনে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে ছয়দফা অনুমোদিত হলে পাকিস্তান সরকার শেখ মজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং মামলা’। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবেই বেশি পরিচিত, কারণ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল। মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামী ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি ‘স্বরচিত গ্রন্থে’ এ মামলাকে সত্য মামলা' বলে দাবী করেন।এই মামলার ফলেশ্রুতিতে পূর্ববাংলার জনমনে স্বঃ্স্ফুর্ত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী এক গন-আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এই গনঅভূস্থানের পটভূমি এবং ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।1969 সালের 5 জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ‘ঢাকসুর’ কার্যালয়ে তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা ঢাকসুর ভি.পি তোফায়েল আহম্মদের সভাপতিত্বে চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এই কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে 11দফা দাবি ঘোষনা করা হয়। 8ই জানুয়ারী সম্মিলিত বিরোধী দল সন্ধ্যায় শেখ মুজিবের বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘আটদফা’ ভিত্তিক একটি ঘোষনাপত্র প্রকাশ করে।9ই জানুয়ারী এই ঐক্যফ্রন্টের ঐক্যের ভিত্তিতে ‘Democratic Action Committee’ সংক্ষেপে ‘ডাক’ গঠন করে। 12ই জানুয়ারী ‘ডাকের পক্ষ্যে ‘প্রাদেশিক সমুন্বয় কমিটির’ সভা অনুষ্ঠিত হয়। আট দফা দাবির ভিত্তিতে 17জানুয়ারী ‘দাবি দিবস’ পালনের সিন্ধান্ত গৃহিত হয়। কিন্তু আইয়ুব সরকার এই দিন 144 দ্বারা জারি করেন। ছাত্র জনতা 144 দ্বারা ভঙ্গ করে ‘ডাকের পক্ষ থেকে বায়তুল মোকারমে, এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমাবেশের আহব্বান করা হয়। সমাবেশে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করলে 18ই জানুয়ারী শনিবার ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত করা হয়। সেই দিন ভোরে বটতলায় এক সমাবেশ থেকে স্লোগান আসে ‘শেখ মজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই। সন্ধ্যায় (জিন্নাহ হল) বর্তমান সূর্যসেন হলে ইপিআর কতৃর্ক ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করা হলে 19 জানুয়ারী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের একটি মিছিল বের হয়। পুলিশ তাতে ব্যাপক লাঠিচার্জ এবং গুলাবর্ষন করে। 20 জানুয়ারী কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে 11 দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এই সময় ছাত্র মিছিলে গুলি চালানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ‘আসাদের’ মুত্যৃ হয়। শহীদ মিনারে শোকসমাবেশে ছাত্ররা ‘আসাদের রক্ত ছুয়ে শপথ গ্রহন করে এবং 21শে জানুয়ারী পল্টন ময়দানে শহীদ ‘আসাদের’ গায়েবানা জানাজা শেষে 22 জানুয়ারী শোক মিছিল, কালো ব্যাজ ধারন, কালো পতাকা উত্তোলন কর্মসূচী ঘোষনা করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে 24 জানুয়ারী সন্ধ্যায় মশাল মিছিল এবং হরতালের আহব্বান করা হয়। এই হরতাল ও গন মিছিলে গুলি চালালে ঢাকার নবকুমার ইনষ্টিটিউটের নবম শ্রেনীর ছাত্র ‘মতিউর রহমান’ শহীদ হয়।এই সময় ক্ষিপ্তজনতা দৈনিক পাকিস্তান, মনিং নিউজ এবং পয়গাম পত্রিকা অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে 25, 26, ও 27 জানুয়ারী আইয়ুব সরকার ‘সন্ধ্যা আইন’ জারি করে।27 জানুয়ারী ঢাকায় গুলাবর্ষনের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানেও গন বিক্ষোভ শুরু হয়।1লা ফ্রেরুয়ারী আইয়ুব খান বেতারে জাতির উদেশ্যে ‘ভাষন’ প্রদান করে। কিন্তু বিরোধীদল ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এই ভাষন প্রত্যাখান করে।9 জানুয়ারী সর্বদলীয় ‘ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ পল্টল ময়দানে ‘শপথ’ দিবস পালন করে।উক্ত শপথ দিবসে 10জন সর্বদলীয় ছাত্রনেতা জীবনের বিনিময়ে হলেও 11দফা দাবি প্রতিষ্ঠার ঘোষনা করে এবং শেখ মজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির লক্ষ্যে দেশবসীর প্রতি আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহব্বান জানান। 11ই ফ্রেরুয়ারী পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে ধৃত রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হলে 12 ফ্রেরুয়ারী তাজউদ্দিন আহম্মেদ মুক্তি লাভ করেন। 14 ফ্রেরুয়ারী ‘ডাকের’ পক্ষ থেকে হরতালের আহব্বান করা হয় এবং অবাঞ্চিত বক্তব্যের কারনে নূরুল আমীন এবং ফরিদ উদ্দিন আহম্মদকে লাঞ্চিত করা হয়।15 ফ্রেরুয়ারী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট ‘জহুরুল হককে’ ক্যান্ট্রোনমেন্টের অভ্যন্তরে নিমর্ম ভাবে গুলি হত্যা করা হয়। আইয়ুব খান সরকার 25 ও 26 ফ্রেরুয়ারী ‘সন্ধ্যাআইন’ জারি করে আগরতলার মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মজিবসহ সকল বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের প্যারেলে মুক্তি দিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকের আহব্বান জানালে ছাত্র জনতা তা প্রত্যাখান করে।16 ফ্রেরুয়ারী ছাত্র জনতার বিক্ষোভে ঢাকা শহর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে এবং 17 ফ্রেরুয়ারী সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। 18ই ফ্রেরুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের রিডার শামসুজ্জোহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পাকিস্তানী সেনারা বেয়োনেট চার্জে নিমর্ম ভাবে হত্যা করে। ফলে সারা দেশব্যাপী এক উত্তাল আন্দোলনের সৃষ্টি হয়।20 ফ্রেরুয়ারী ‘সন্ধ্যা আইন’ প্রত্যাহার করা হয় এবং 21 ফ্রেরুয়ারী পল্টনে মহাসমুদ্রে ছাত্রসমাজের অগ্রণায়কদের শপথ এবং শেখ মজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে 24 ঘন্টার আল্ট্রিমেটাম দেওয়া হয়। 22 শে ফ্রেরুয়ারী নিরুপায় আইয়ুব খান শেখ মজিবসহ সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান করেন। 23শে ফ্রেরুয়ারী ‘সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম’ পরিষদ বিকেল 3টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যানে এক জনসমাবেশের আহব্বান করলে 10 লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে গনঅভূস্থানের অন্যমত ছাত্রনেতা তোফায়েল আহম্মদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভুষিত করেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে, বঙ্গবন্ধু উপাধীর জন্য তিন জনের নাম নির্বাচিত করা হলেও (সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এবং শেখ মজিবর রহমান) শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের সিন্ধান্তেই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধীতে ভূষিত করা হয়। ফলে অপমান-লাঞ্চনা নিয়ে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন।
আট
আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের অধীনে 1969 সালের 7ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষনা দেন। কিন্তু পরক্ষনেই নানা ছলচাতুরিতে নির্বাচন পিছাতে থাকেন। ইতিমধ্যে 1970 সালে 12 নভেম্বর পুর্বপাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে এক ভয়াবহ প্রকৃতিক দূর্যোগ দেখা দেয়। এই ‘সাইক্লোন’ পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে, সেই সাথে জোয়ারের কারণে প্রায় ৩,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়। প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও এটিকে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ‘হারিকেন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরও জরুরী ত্রাণকার্য পরিচালনায় গড়িমসি করে। ঘূর্ণিঝড়ের পরও যারা বেঁচে ছিল তারা মারা যায় খাবার আর পানির অভাবে। ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বীকার করে সরকার দুর্যোগের ভয়াবহতা বুঝতে না পারার কারণেই ত্রাণকার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২৪শে নভেম্বর এক সভায় মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগ তোলেন এবং অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে এক লম্বা বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যে অনুপ্রানিত হয়ে কবি শামছুর রহমান ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন-
‘শিল্পী কবি দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক
খদ্দের শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবি, সমাজ সেবিকা
নিপুন ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানী
সবায় এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনলেন
দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মওলানা ভাষানী কি বলেন----
ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা একটি দেশে গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।1970 সালের 7ই ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরন্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ 313টি আসনের মধ্যে 167টি আসন লাভ করে। প্রতিদ্বন্দি দল হিসাবে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি লাভ করে মাত্র 88টি আসন। এই নির্বাচনের ফলাফলে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায় আর তা‘হল আঞ্চলিক প্রধান্য। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ পম্চিম পাকিস্তানে এবং পিপলস্ পার্টি পূর্বপাকিস্তানে একটি আসনও লাভ করতে পারেনি। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বুঝতে বাকী থাকেনা যে, বাঙ্গালীরা আর পাকিস্তানীদের সাথে থাকবে না। এদিকে গোপনে 11ই ফ্রেরুয়ারী পাকিস্তানের শীর্ষ সেনাকর্মকতাদের বৈঠকে বাঙ্গালীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। বৈঠকে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ‘সউদ’ এর বিরোধীতা করেন এবং বিষয়টি বাঙ্গালী সামরিক কর্মকতাদের কাছে জানিয়ে দেন। বাঙ্গালী কর্মকতারা বিষয়টি শেখ মজিবুর রহমানকে জানালে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। 1971 সালের 28শে ফ্রেরুয়ারী মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডকে শেখ মুজিব বলেন ‘আওয়ামী লীগ পুরোপুরি বিছিন্ন হওয়ার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেড়ারেশন করার পক্ষপাতী। 31 জুলাই আওয়ামী লীগ গন-পরিষদ সদস্য কাজী জহিরুল কাইউম কলিকাতায় মার্কিন কূটনতিকদের জানান ‘আওয়ামী লীগের নেতারা ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন এবং পাকিস্তানের সাথে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে আগ্রহী। শেখ মজিবুর রহমান জানতেন ‘যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধী আর তিনি নিজেও চান না পাকিস্তান ভেঙ্গে যাক। শেখ মজিবুর রহমানের এই মতটি ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠান এবং তিনি শেখ মজিবের এই মন্তব্যের অনুকুলে নিজেরও একটি বিশ্লেষনধর্মী মন্তব্য জুড়ে দেন। এতে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তান শাসক চক্র যদি নির্বাচন মেনে না নেন তা‘হলে পাকিস্তান ভাঙ্গনরোধ করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স বরাবরই জানতেন ‘শেখ মুজিব পশ্চিমামুখী ও তাদের সাথে আলোচনার পক্ষপাতি। শেখ মজিবুর রহমান একই সাথে দলের সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দিনকে মাধ্যমে ভারতেরও সহযোগিতা কামনা করেন। ‘ভারত-তাজউদ্দিনের বৈঠকে’ ভারত সরকার সম্ভাব্যযুদ্ধে প্রবাসী সরকারকে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তবে তারা সাহায্যের প্রকৃতিও পরিধি সর্ম্পকে রহস্যজনক ভুমিকা রাখেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র আশংঙ্খা প্রকাশ করেন, যুদ্ধ লাগলে পাকিস্তানের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কাজেই তারা প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য কলিকাতার নিযুক্ত মার্কিন মিশনকে নির্দেশ দেন। প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহম্মদ, গনপরিষদ সদস্য জহুরুল কাইউম ও রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীর সঙ্গে মার্কিন মিশনের সঙ্গে আট দফা বৈঠক মিলিত হন। ভারত সরকার প্রথম দিকে এই আলোচনায় উৎসাহ দেখালেও পরবর্তীতে বিরোধীতা করেন। কেন তারা এই আলোচনার বিরোধীতা করেন তা রহস্যাবৃত। ইতিমধ্যে 19 শে ফ্রেরুযারী দুই কাশ্মীরি যুবক ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে লাহোরে অবতরন কর্। পাকিস্তান পিপলস্ পাটির প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো তাদেরকে জাতীয় বীর হিসাবে আখ্যায়িত করেন। অপর দিকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মজিবুর এই বিমান ছিনতাই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।