somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনর্ঘ্য

২৮ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৫:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফজরের নামায শেষ করে মসজিদ থেকে ফিরতে ফিরতে শীতে কাঁপুনি ধরে গেল মোস্তফা সাহেবের। গায়ে দুটো সোয়েটার চাপিয়েছে। একটা সোয়েটার স্ত্রী মনোয়ারা বানিয়ে দিয়েছিল বছর তিনেক আগে, শেখ সাহেবকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী করা হয় তখন। তারিখটা ঠিক খেয়াল নেই, জানুয়ারির আগে পিছে হবে একটা। তবে মনে আছে সেদিন তাঁর বড় ছেলের মেজ মেয়েটা দোতলার সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামার সময় কার্পেটে পা আটকে উলটে গিয়ে দাঁত ভেঙ্গেছিল সামনের দুটো। কপাল ভাল যে বেশি কিছু হয়নি। দুধ দাঁত, ভাংলে আবার গজাবে। তবে ছেলের বৌ রুহামা ভয়ে ফিট হয়ে গিয়েছিল মেয়েকে সিঁড়ির মাথা থেকে ওভাবে ধড়াম করে আছাড় খেতে দেখে। পোয়াতি ছয় মাসের। আবার বাচ্চা নিচ্ছে, তার বেহুঁশ হওয়া দেখে মনোয়ারা সহ মোস্তফা সাহেব, বড় ছেলে ইমরান – সবাই আঁতকে উঠেছিল। রুহামার তুলা রাশি। একটুতেই ভয় পাওয়ার অভ্যাস আছে। প্রথম বাচ্চা হওয়ার আগে ঘরে সাপ দেখে এমন ভয় পেয়েছিল যে বাচ্চাটা মাত্র এক সপ্তাহ বেঁচেছিল জন্মের পর। তারপর অবশ্য সবাই সাবধান হয়ে গিয়েছিল। একটা ছেলে, একটা মেয়ে হবার পর সবাই ভেবেছিল ছোট পরিবার সুখী পরিবার বানিয়ে রাখবে। কিন্তু তিন বছরের মাথায় আবার বাচ্চা নিচ্ছে এখন। কেউ অবশ্য এটা নিয়ে কিছু বললে ইমরান নিজেই ঠাট্টা করে বলে, ‘আগের দুইটা পাকিস্তানী আমলের বাচ্চা। ফ্রেশ বাংলাদেশের বাচ্চা লাগে না একটা?’
মোস্তফা সাহেব বিরক্ত হন ছেলের এই ধরণের রসিকতায়। সরাসরি ছেলেকে কিছু বলেন না। কিন্তু রুমে এসে মনোয়ারার সামনে গজ গজ করতে থাকেন, ‘ইমরানটাকে কী দেখে মেজিস্ট্রেট বানিয়েছে খোদাই জানে। রসিকতারও তো একটা চাল ঢাল আছে। এটা কী ধরণের রসিকতা যে বাংলাদেশের ফ্রেশ বাচ্চা লাগবে? আগের দুটো বাচ্চা কী তাহলে ফেলনা? অপয়া?’
মনোয়ারা স্বামীর সুরে সুর মেলান, ‘বাদ দাও, ঘরের বড় ছেলে। হুট হাট কিছু একটা শুনিয়ে দিয়ে ঘরে অশান্তি আনার দরকার নাই। আমাকে যা বলার বলিও। আমি না হয় রুহামাকে বলবো ইমরানকে বুঝিয়ে বলার জন্য সময় করে।’
‘তোমার বৌমা তো আরেক কাঠি সরেষ। তার অত্যাচারে বাসা বাড়িতে শান্তিমতো হাঁচি কাঁশিও দেয়া যায় না! সে যাবে তোমার ছেলেকে বোঝাতে? তোমার ছেলে বাহিরে তো কিছু ফলাতে পারে না। মেজিস্ট্রেটগিরি ঘরের মধ্যে বৌটার ওপরে ফলায়। পোয়াতি মেয়েটাকে দিয়ে এখনো মশারি টানানো, শার্ট ইস্ত্রি করে দেয়ার মত থার্ড ক্লাস ক্যাটাগরির কাজ করায়। এটা কি তোমার চোখে পড়ে নাই একবারও?’
মনোয়ারা চুপ হয়ে যান। মোস্তফা সাহেব ফৌজদারি আদালতের বিচারক ছিলেন দীর্ঘদিন। যুদ্ধের পর অবসরে গেছেন। বড় ছেলের নানাবিধ কার্যকলাপে ইদানীং সারাক্ষণই বিরক্ত হয়ে থাকেন।
ছোট মেয়ে জামাই সহ অস্ট্রেলিয়ার থাকে। দু বছরে একবার আসে। যুদ্ধের পর এখনও আসেনি। গণঅভ্যুত্থানের সময় একবার এসেছিল যতটা মনে পরে। দ্বিতীয় সোয়েটারটা ছোট মেয়ে সাবরিনার দেয়া। শেষবার যখন এসেছিল, তখন বিদেশ থেকে কিনে এনেছে। অস্ট্রেলিয়ার মেরিনো উলের সোয়েটার। গায়ে দিলেই আগুন হয়ে যায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে। কিন্তু আজকে মা মেয়ের সোয়েটার দুটো মিলিয়েও শীতে পোষাচ্ছে না। ওপরে আফগানি শাল চাপিয়েছেন একটা। সাথে ফারের কানটুপি। কিন্তু শীতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সাথে রয়েছে কুয়াশা বৃষ্টির মত মিহিকণার ছটা। মসজিদ থেকে বেরিয়ে কাঁচা মেঠো পথ, গাই গোবরের মাঝ দিয়ে শিশির জমা ঠাণ্ডা ঘাসে স্যাণ্ডেল ডুবিয়ে ফিরেছেন আবছা অন্ধকারে। এই ভোর বেলাতেই কোথাও শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন ধরিয়েছে, সাথে খড় দিয়েছে। পট পট শব্দ করে সেই খড় ফুটছে। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে কুয়াশার মাঝে। মোস্তফা সাহেব বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বাড়ি ফিরেছেন কায়দা, সিফারা নিয়ে মক্তবের দিকে যেতে থাকা ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মাঝ দিয়ে।
মোস্তফা সাহেবের মেজ ছেলে যুদ্ধে গিয়েছিল এপ্রিলের দিকে। এই যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে পিতা পুত্রের মাঝে ভয়াবহ বাকবিতণ্ডাও হয়েছিল। তিনি ত্যাজ্জ করেছেন মেজ ছেলেকে। ত্যাজ্জ অবশ্য মুখে মুখে করেছেন। ছেলে এরপর কাউকে কিছু না বলে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে গেছে। মনোয়ারা মূর্তির মতো বসেছিলেন পরের এক সপ্তাহ। বিশ্বাসই করতে পারেননি যে মোস্তফা সাহেব তাঁদের মেজ ছেলে ইমনকে ত্যাজ্জ করেছেন, এবং সেই ছেলে মাকে না বলে চুপচাপ রাতের বেলা বাড়ি ছেড়ে চলেও গেছে। একটা চিঠি কিংবা একটা খবর পর্যন্ত বলে যায়নি। কোনো ঠিকানা দিয়ে যায়নি। বেঁচে আছে না মরে গেছে এর মাঝে নয় মাস কেউ জানতেই পারেনি! মনোয়ারা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য। জায়নামাযেই পড়ে থাকতেন সারাক্ষণ। নামায আর কোরআন খতম দেয়া ছাড়া আর কিছু করেননি। এরপর একদিন অস্ট্রেলিয়া থেকে সাবরিনা ফোন করে মায়ের সাথে কথা বলে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিল সেই দফা। ফোনের মধ্যে মা মেয়ের কী আলাপ কিংবা কান্না কাটি কতটুকু হয়েছে মোস্তফা সাহেবের খেয়াল নেই। কিন্তু মনোয়ারা ফোন রাখার পর অনশন ভঙ্গ করে গম্ভীর মুখে খাওয়া শুরু করেছিলেন। মোস্তফা সাহেব কী বলবেন ভেবে পাননি। স্ত্রীকে কদিন ধরেই অচেনা লাগছিল। মনোয়ারা খেতে খেতে নিজে নিজেই মোস্তফা সাহেবকে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ শেষ হলে ইমন বাড়িতে আসবে। কেউ তাকে কিছু বলবে না। যে আগ বাড়ায়ে কিছু বলতে আসবে, তারে আমি বটি দিয়ে কুপিয়ে লাশ বানায় ফেলবো। তোমার জন্যও প্রযোজ্য কথাটা। ইমন আসার পর ওকে আমি স্যাণ্ডেল দিয়ে মারবো। আমাকে থামাতে আসবা না কেউ।’
মোস্তফা সাহেব পঞ্চাশ বছরের সাংসারিক জীবনে স্ত্রীর এই রুদ্রমূর্তি পূর্বে কোনোদিন দেখননি। বজ্রাহতের মতো বসেছিলেন।
এবং সত্যি সত্যি ইমন ফিরে এসেছিল যুদ্ধের নয় মাস পর। গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিল। উঠানের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলার অবস্থা। কারেন্ট ছিল না। সবাই ঘুমিয়েছিল। কুকুরের চেঁচানি আর দরজার ধাক্কার শব্দে জেগে ওঠে সবাই। হারিকেন জ্বালিয়ে মোস্তফা সাহেব দেখতে যান এত রাতে কে এসেছে। পেছন পেছন মনোয়ারাও গিয়েছিল। যুদ্ধের পর আশেপাশের মফস্যল শহর, কিংবা গ্রামে ডাকাতের উদয় হয়েছে ইদানীং। সেরকম কিছু হবে কিনা ভেবে সাবধান হবার জন্য হাতে দা নিয়ে স্বামীর পেছন পেছন গিয়েছিলেন। কিন্তু দরজা খুলতেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন মোস্তফা সাহেব। তাঁর মেজ ছেলে বাড়ি ফিরেছে.... ইমন। বাম হাতটা স্লিং এ ঝোলানো। গুলি খেয়েছিল। ব্যান্ডেজ করা। কালকে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ সেটায়, সারতে সময় লাগার কথা। শুকিয়ে কংকাল হয়ে গেছে ছয় ফুটি তালগাছ উচ্চতার ছেলেটা। এক রত্তি মাংস নেই শরীরে। আগের রোদে পোড়া তামাটে চেহারা কালো হয়ে গেছে একদম। মাথায় একটা চুলও নেই। ন্যাড়া। দাড়ি গোঁফ খোঁচা খোঁচা। ছেলেকে দেখে চিনতে সময় লেগেছিল মোস্তফা সাহেবের। তিনি যতক্ষণে ছেলেকে চিনেছেন, ততক্ষণে পাশ থেকে মনোয়ারা স্যাণ্ডেল খুলে নিয়ে চিলের মতো উড়াল দিয়েছে ছেলের দিকে। অসুস্থ হাত কিংবা স্লিং দেখার সময় নেই, চোখ বন্ধ করে তাতস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে বাসা বাড়ি মাথায় তুলে ছেলেকে কম পক্ষে পঞ্চাশ থেকে ষাটটা স্যাণ্ডেলের বাড়ি মেরে সেই স্যাণ্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। মোস্তফা সাহেব স্ত্রীর কথা অমান্য করেননি। বাঁধাও দেননি। ইমন স্যাণ্ডেলের বাড়ি খেয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু হা হা করে অট্টহাসির মত শব্দ করে হাসছিল! ‘আম্মা! তোমার এই মার খাওয়ায়ার জন্য আল্লাহ মনে হয় বাঁচায় রেখেছিল! এখন একটু থামো, মেহমান এনেছি তো! সব মার কি একদিনেই দিয়ে দেবে নাকি! নয় মাসের ঝাল নয় মাস পিটিয়ে মনের সুখে মিটিও।’
মনোয়ারা স্যাণ্ডেল ছেঁড়ার পর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে অস্থির হয়ে গেলেন, ছেলের সব কথা শোনার মতো অবস্থায় নেই। রুহামা এসে শাশুড়িকে টেনে সরিয়ে নিতে নিতে টের পেল শাশুড়ি জ্ঞান হারিয়েছেন।
প্রায় দশ মিনিট মাথায় পানি ঢালার পর মনোয়ারার জ্ঞান ফেরে। ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর অবাক হয়ে বলেন, ‘ইমন? এইটা দীপা না? কি আশ্চর্য্য! তুমি বেঁচে আছো?’
হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন যার দিকে সবাই এতক্ষণে যেন তাকানোর সময় পেয়েছে ইমনের সঙ্গে আসা মেহমানটাকে। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়েছিল তেইশ চব্বিশ বছর বয়সী শ্যামল বর্ণের এক তরুণী। ছাই রঙ্গা একটা এলোমেলো সুতি শাড়ি পরনে। তার মাঝে বেঢপ হয়ে ফুলে রয়েছে পেটটা। চোখের আশ পাশ, ঠোঁট অনেকটাই থেঁতলে গেছে। কালো জমাট রক্তের মত জমে রয়েছে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে খামচে ধরে থাকা চেয়ারের গায়ের আঙ্গুলগুলোর অধিকাংশই ব্যাণ্ডেজ করা।
ইমন একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। বেঁচে আছে....’

মোস্তফা সাহেব গায়ের চাদরটা ভালমতো টেনে টুনে বাড়ির উঠানের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে দেখতে পেলেন নিচতলার বারান্দায় আবছা অন্ধকারে মনোয়ারা এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সকাল হয়নি এখনো। শেষ রাতের বিদায়ী চাঁদ আর সকালের উঠতে চাওয়া সূর্য একই আকাশে জায়গা করে নিচ্ছে সবে। মোস্তফা সাহেব ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন স্ত্রীর দিকে, ‘কী ব্যাপার? আজকে এত আগে উঠে গেছো!’
মনোয়ারা শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমাদের উঠানের পুরানা কুয়াটার মুখ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সূর্য উঠলেই কুয়ার মুখ বন্ধ করার জন্য লোক ডাকবেন।’
বিস্মিত মুখে তাকালেন মোস্তফা, ‘কুয়া! কেন? হঠাৎ এ কথা কেন বলছো?’
‘আমি প্রতিদিন রাতে দীপাকে দেখি ওর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কুয়া পাড়ে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাচ্চাটাকে কুয়ায় ফেলার মতো করে ধরে রাখে অনেকক্ষণ। তারপর চুপচাপ ফিরে আসে। প্রায় প্রতিরাতেই এই ঘটনা ঘটে।’
হকচকিয়ে তাকান মোস্তফা সাহেব। ইমনের সঙ্গে নিয়ে আসা দীপা নামের মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা ছিল আট মাসের মনে হয়। এখানে আসার চার দিনের মাথায় হঠাৎ পানি ভাঙ্গে, তারপর খুব অল্প ওজনের একটা মেয়ে জন্ম দেয়। দুধ পাচ্ছে না। বাজার থেকে ডানোর বোয়ম কিনে দিয়েছে ইমরান। সেটাই বোতলে পুরে খাওয়াচ্ছে মনোয়ারা। দীপা বাচ্চাটাকে খাওয়াতে চায় না। শুধু রাতের বেলা বেশি কান্না কাটি করলে দীপা এসে বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়। ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এর বাহিরে আর তেমন একটা যত্ন করা হচ্ছে না। আগ্রহ নেই বাচ্চাটার প্রতি।
মনোয়ারার মুখে এইরূপ ভয়ংকর কথা শুনে মোস্তফা সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেছেন। আর যাই হোক এ ধরণের কিছু শোনার মতো আশা করেননি।
দীপা দাস নামের এই মেয়েটা ইমনের দুই তিন বছরের ছোট হবে বয়সে। মোস্তফা সাহেবের ছোট মেয়ে সাবরিনার স্কুলের বান্ধবী। ঢাকায় থাকা কালীন সময়ে দুজনেই হলিক্রসে পড়তো। সাবরিনা পড়ায় অমনোযোগী ছিল সব সময়। টেনে টুনে দুই বারে ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। পরে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মোস্তফা সাহেব। অন্য দিকে দীপা ম্যাট্রিকের পর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিল। পড়াশোনা চলাকালীন সময়েই সেখানকার এক সিভিল সার্জন বিমল দাসকে বিয়ে করে। ভালই চলছিল সব।
কিন্তু মাঝখান দিয়ে যুদ্ধ শুরু গেল। কথা নেই বার্তা নেই দীপার স্বামীকে হাসপাতাল থেকে কারা যেন তুলে নিয়ে গেল। দুদিন বাদে লাশ পাওয়া গেল নিউমার্কেটের পেছনের একটা ডাস্টবিনে। চোখ নেই। তুলে ফেলেছে। সারা শরীরে বেয়োনেটের অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন।
দীপা অবশ্য এসব জানার সময় পায়নি। তাদের গোটা পরিবারটাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকারদের একটা বাহিনী। পুরুষদের মেরে ফেলেছিল। দীপাদের জায়গা হয় পাকিস্তানী মিলিটারিদের কন্সান্ট্রেশন ক্যাম্পে। দীপার ননদ দুজনে একই ক্যাম্পে চার মাস বেঁচে থাকার পর মারা গিয়েছিল। দীপা কেমন করে বেঁচে আছে সেটা একটা বিস্ময়।
ইমনদের প্লাটুনটা চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টের ঐ ক্যাম্প থেকে দীপা সহ আরো অনেক বেঁচে থাকা মেয়েদের উদ্ধার করেছিল যুদ্ধের শেষ দিকে। অবশ্য তখন ইমন নিজেও চিনতে পারেনি দীপাকে। দীপাও চিনতে পারেনি। অথবা চেনার মতো অবস্থায় কেউ ছিল না। অধিকাংশ মেয়েই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল চিরদিনের জন্য। সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল বাহ্যিক ক্ষতের ভিত্তিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য। অতিরিক্ত আহত মেয়েগুলো সপ্তাখানেক বেঁচে থাকার পর মারা যায়। আর যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে ছিল, কথা বলতে পারতো তাদের তালিকা করে যার যার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার জন্য যখন লিস্ট করছিল হাসপাতালের ডাক্তারেরা, সে সময় ঘটনাক্রমে দীপার পরিচয় বের হয়ে আসে। জানা যায় যে নয় মাস আগে খুন হওয়া এই হাসপাতালের সার্জন বিমল দাসের স্ত্রী সে। কথাটা ছড়িয়ে পড়া মাত্র ইমন খুঁজে বের করে দীপাকে। নয় মাসের অমানুষিক নির্যাতনের কারণে দীপা কাউকে চিনতে পারতো না সে সময়। আলো দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেত। কেবল নিজের নাম আর স্বামীর নাম বলতে পারত। ইমন আরো কিছুদিন সময় অপেক্ষা করে, দীপাকে হাসপাতালে রেখে ওর শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ি সব জায়গাতেই খবর পাঠায়। কিন্ত দুই পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।
উপায় না দেখে ইমন সাথে করে নিয়ে এসেছে একটু স্বাভাবিক হবার পর। চাইলে হাসপাতাল কিংবা বিভিন্ন পুনর্বাসন সংস্থার আওতায় রেখে আসতে পারতো। কিন্তু চায়নি। বিদেশ থেকে প্রচুর এনজিও কর্মী এসেছে। চারদিকে সাহায্যের ধুম পড়ে গেছে।
ইমন একজনের বোঝা কমিয়েছে। অবশ্য হাসপাতাল ছাড়ার আগে লিবিয়ান এক বয়ষ্ক মহিলা ডাক্তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে ইমনকে বলেছিলেন, ‘আমি খুব আশ্চর্য্য হয়েছি যে ও বেঁচে আছে কীভাবে! এমনকি মানসিক ভাবেও সেরে উঠছে! প্রচণ্ড মানসিক শক্তি না থাকলে এইভাবে উঠে দাঁড়ান যায় না!’

বাড়ির বড় বৌ অন্তঃসত্ত্বা যে কিনা একটুতেই ভয় পায়, আরেকজন সদ্য মা হয়েছে। যে কিনা প্রতিরাতে নিজের এক মাসের বাচ্চাকে কুয়ায় নিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে- মোস্তফা সাহেব দুশ্চিন্তায় বারান্দার সিঁড়িতেই বসে পড়লেন। বোকা বোকা মুখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। মনোয়ারা গম্ভীর মুখে ঘুরে চলে গেলেন বাড়ির ভেতরে। যা বলার স্বামীকে বলে দিয়েছেন তিনি। বাকি কাজ এখন মোস্তফা সাহেবের।

বরইয়ের আচার শুকাতে দিয়েছে রুহামা। দশ বারোটা বয়ম মুখ খুলে পাটি বিছিয়ে মেলে দেয়া হয়েছে। শীতের এই তেজহীন রোদে যা শুকায় আরকি। দুপুর হয়ে গেছে দেখে ইমনকে মোড়ায় বসিয়ে দিয়ে গোসল করতে চলে গেছে। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে চুপচাপ বসে বসে পত্রিকা পড়ছিল ইমন। লম্বা লম্বা পাগুলো বিছিয়ে রেখেছে সামনের দিকে। আপনমনে পাতা উলটে পড়ছে। বাম হাতটা এখন আর স্লিং এ ঝোলাতে হচ্ছে না। সেরে উঠছে দ্রুত। ন্যাড়া মাথায় চুল গজিয়েছে অল্প। কুট কুট করে সারাক্ষণ। একটু পর পর চুলকায় নিজের অজান্তে।
‘আজকে কত তারিখ?’
পত্রিকার পাতায় এত নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে ছিল যে আচমকা কথাটা শোনামাত্র চমকে উঠল। মুখে তুলে তাকাল। দীপা ছাদে এসে বসেছে আরেকটা মোড়া নিয়ে। বাচ্চাটা সাথে নেই। বাড়ির ভেতরে রেখে এসেছে মনে হয়।
‘হু?’ বুঝতে পারে না এমন ভাবে তাকায় ইমন।
‘বলছিলাম আজ কত তারিখ?’ রোদের দিকে মুখ তুলে তাকায় দীপা। চোখ কুচকে যায়। মাথার উসকো খুসকো ঝাকড়া চুলগুলো পেছনে নিয়ে একটা ব্যাণ্ড দিয়ে বেঁধে রেখেছে। সাবরিনার জামা ছিল বাসায়। সেগুলোই পরছে। এখন যেটা পরে আছে সেটা কোনো একটা জন্মদিনে আব্বা কিনে দিয়েছিল। বেশি আগের না। দুই বছর আগের হতে পারে। যাওয়ার সময় কেন নিয়ে যায়নি সেটা অবশ্য বলতে পারছে না ইমন। দীপার চোখের পাশগুলো আস্তে আস্তে সেরে উঠছে, ঠোঁটের কালচে থেতলানো অংশটাও শুকিয়ে গেছে অনেকটা।
‘২৭ জানুয়ারি।’ ছোট বোনের সম বয়সী একটা মেয়ের সামনে এভাবে খালি গায়ে বসে থাকতে অস্বস্তি লাগছিল ইমনের। কিন্তু উঠে গিয়ে দড়ি থেকে গেঞ্জিটা পেড়ে আনতে ইচ্ছা হল না। রোদের উত্তাপে পিঠ চর চর করে জ্বলছে, আরামই লাগছে। ঘুম ঘুম একটা অবস্থা এসে যাচ্ছে।
‘আশীর্বাদের দুই বছর হল...’ ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ইমনের দিকে তাকালো, ‘সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায় মনে হচ্ছে!’
ইমন কী বলবে বুঝতে পারলো না। দীপার সাথে তার আগেও তেমন একটা কথা বার্তা হতো না।
‘আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থিয়োরিটা খুব অদ্ভুত বুঝলেন ইমন দা। ভাল সময়গুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় সেকেণ্ডের মাঝে। আর খারাপ সময়গুলো জনম জনম ধরেও যেন শেষ হয় না!’ বিচিত্র একটা হাসি ফুটে ওঠে দীপার ঠোঁটের কোণে।
মাথা ঝাকায় ইমন। পত্রিকাটা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে বেশ স্পষ্ট গলাতেই বলল, ‘আম্মার মুখে শুনলাম তুমি নাকি প্রতিরাতে কুয়ার কাছে গিয়ে বাচ্চাটাকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছো?’
‘হ্যাঁ। যদিও কৃতকার্য হতে পারছি না এখনো। চেষ্টা অব্যহত আছে। ক্লাস ফাইভে কেবল বৃত্তি পেয়েছিলাম। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি কেন পাইনি এনিয়ে বাসায় প্রচুর কথা শুনিয়েছিল। এইটে উঠে জেদ ধরে পড়ে পড়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিটা বাগিয়েছিলাম। চেষ্টা করলে সবই করা যায়।’ খুব স্বাভাবিক গলায় বলল দীপা। একটা আচাড়ের বোয়ম তুলে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে সূর্যের আলোতে দেখতে থাকে।
ইমন কি বলবে খুঁজে পেল না। দীপার অকপটে স্বীকার করে ফেলার ব্যপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে।
‘কিন্তু... বাচ্চাটার তো কোনো দোষ নেই? তাই না? সি ইজ ইনোসেন্ট। একটা এক্সিডেন্ট....” বলতে গিয়ে থেমে গেল মাঝপথে। কারণ দীপা সরাসরি ফিরে তাকিয়েছে ওর দিকে। চোখে চোখে তাকানো গেল না।
‘এক্সিডেন্ট? এক্সিডেন্ট??’ তীব্র গলায় বলে উঠল দীপা, ‘ইমন দা, বিলিভ মি। এই নয়টা মাসে আমার একটাই কাজ ছিল। আমি প্রতিদিন প্রতিটা রাতে গুনেছি... কত বার... এণ্ড আয়্যাম শিওর দ্যাট ওয়াজ নট লেস দেন সেভেন হান্ড্রেড টাইমস... কজ শেষের দিকে আর গোণার মতো মানসিক শক্তি ছিল না, অবশিষ্ট ছিল না কিছুই। আই ওয়াজ নাথিং বাট আ পিস অফ বোন এণ্ড ফ্ল্যাশ...’
‘আ-আমি ওটা মিন করিনি দীপা। বাচ্চাটার কোনো দোষ নেই এটুকুই বলতে চেয়েছি। আমি জানি তোমার ওপর দিয়ে যা গেছে সেটা অনুমান করার মতো ক্ষমতা স্রষ্টা আমাকে দেয়নি। তবু বাচ্চাটার প্রতি মা হয়ে অন্যায় কোরো না প্লিজ...’ ইমন পত্রিকাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
‘ইমন দা?’ পেছন থেকে ডাক দেয় দীপা।
‘হু?’ ফিরে তাকায়।
‘বিমলদের কেউ বেঁচে নেই, আমাদের বাড়িরও কেউ বেঁচে নেই। এই ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি কী করবো বলতে পারেন?’
‘বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে জরুরী। আমাদের পরিবারের মানুষ তুমি এখন।’ ইমন চুপ চাপ বেরিয়ে গেল।
দীপা চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে মুখ তুলে তাকায়। নাকের মাঝে বারুদের গন্ধ ভেসে আসে। কান পাতলেই শিখা আর মৈত্রীর মৃত্যুযন্ত্রণায় দেয়া চিৎকারগুলো স্পষ্ট শুনতে পায়। দিনের পর দিন গোসল না করে অশুচি শরীরে সেলের ভেতর জড় মাংসের মত বিশ পঁচিশটা নগ্ন মেয়ের সাথে অন্ধকারে বসে থাকার কথা মনে আসে। সপ্তাহ কিংবা দশ দিনে একবার বন্দুকের নলের মুখে সব মেয়েদের পুকুরে গিয়ে গোসল করার দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে। হিন্দু মুসলিম বলে কোনো আলাদা কিছু ছিল না। কত বার যে পুকুর থেকে উঠে ইচ্ছা করে দৌড়ে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মুক্তি মিলেছে কত মেয়ের, গুণে গুণে বলে দিতে পারবে দীপা। লজ্জা, আত্মসম্মান, ঘৃণার মত অনুভূতিগুলো সব ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। কাপড় ছাড়া মাসের পর মাস থেকেছে। কেউ কেউ অকল্পনীয় নির্যাতনের কারণে সেলের ভেতর মরে যেত। সেই লাশ নিয়ে দীপারা দিনের পর দিন বসে থাকতো। এক সময় পাকিস্তানী কোনো মিলিটারি এসে পায়ে দড়ি পেঁচিয়ে কুকুরের মত টানতে টানতে সেই লাশ বের করে নিয়ে যেত।
দীপা নিজের অজান্তে দুই কানের লতিতে হাত দেয়। ছিঁড়ে দু ভাগ হয়ে আছে দুটোই। কন্সাট্রেশন ক্যাম্পের প্রথম রাতেই বিমলের কিনে দেয়া টবগুলো কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছিল পাঠান এক মিলিটারি। কত শখ করে টবগুলো বানিয়ে দিয়েছিল বিমল। হাতের সোনার বাউটিগুলোও কোথায় কখন হারিয়ে ফেলেছে মনে করতে পারে না। হয়ত লাশের নিচে ছ্যাঁচড়ে চলে গেছে কোথাও। কিংবা ড্রেনের মাঝে পড়ে গেছে।
মাথার চুলগুলোতে হাত বুলায় দীপা। ক্যাম্পের অনেক মেয়েই ছিল যাদের লম্বা বেণী ছিল। শুরুর দিকে একই পরিবারের মা নিজের মেয়েকে লম্বা বেণী পেঁচিয়ে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলেছিল। যাতে বেশি কষ্ট সইতে না হয়। শাড়ি কিংবা ওড়নার বাতুলতা তো বহু আগেই অগ্রাহ্য হয়েছে। বাকি ছিল একে অন্যকে মুক্তি দেয়ার নির্দোষ খুনের চেষ্টা। সেটা ধরা পড়ে যাওয়ার পর সেলের প্রায় সব মেয়েদেরই চুল কেটে দিয়েছিল।
বন্ধ চোখের পাশ বেয়ে ক্ষীণ ধারায় উষ্ণ জল গড়িয়ে নামে হঠাৎ। বিমল বিয়ের পর প্রায়ই ওর চুল ধরে ঘ্রাণ নিতো মুগ্ধ হয়ে। দীপা লজ্জা পেয়ে যেত, ‘আপনি এমন করেন কেন মাঝে মাঝে?’
‘যতদিন না তুমি আপনি থেকে তুমিতে নামছো এরকম হতেই থাকবে। এত মিষ্টি কেন তোমার চুলের ঘ্রাণ? বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলে মনে হয় যেন পৃথিবীর সমস্ত অক্সিজেন বুকের খাঁচায় পুরে জমা করেছি!’ হাসতে হাসতে বলত মানুষটা।
সমস্ত পৃথিবীতে এত বারুদের গন্ধ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে গেছে, লাশের গন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া দায়- অথচ সেই অক্সিজেন খোঁজা মানুষটা মিলিয়ে গেল? তার কি ফিরতে ইচ্ছা জাগে না আর? অবশ্য ফিরে এসে জড়, পোড়া একটা মাংসপিণ্ড ছাড়া দীপাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় আর। কানের টব আর হাতের বাউটির মতো বিমল দাসের দীপা হারিয়ে গেছে লোকালয় থেকে। এখন যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটা অনর্ঘ্য। যে দেবীতে পূজা হয় না।

বিকাল দিকে মোস্তফা সাহেবের বাড়ির উঠানে দুই ভ্যান ভর্তি ইট এসে জমা হল। সাথে সিমেন্টের বস্তাও, রড আছে বেশ কিছু। দিন শেষ হয়ে গেছে দেখে আজকে আর মিস্ত্রী আসবে না। কাল সকাল দিকে এসে কুয়া বন্ধ করার কাজে হাত দেবে। মোস্তফা সাহেবের দাদার আমলের কুয়া এটা। বাসায় টিউবওয়েল আছে, কিন্তু তারপরো কুয়াটা রেখে দেয়া হয়েছিল। যত্নের অভাবে, অবহেলায় চারপাশে ঝোপঝাড় গজিয়ে গেছে। দীপা সূর্য ডোবা আলোতে দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই ইট নামানোর দৃশ্য দেখতে থাকে।
মোস্তফা সাহেব কুয়ার কাছে ইট নামানোর তদারকি করতে গিয়েছিলেন, বাড়ির দিকে ফেরার সময় দেখতে পেলেন জানালার পাশে পড়ন্ত সূর্যের লালচে আভার জ্বলছে দীপা। হলদেটে কোনো দেবীর প্রতিমূর্তি মতো লাগছে তাকে.....

গভীর রাতে ঝপাস শব্দ শুনতে পেয়ে মোস্তফা সাহেব ঘুমের ভেতরেও চমকে উঠলেন। তড়িঘড়ি করে উঠে বসতেই টের পেলেন তার পাশে মনোয়ারা নেই। উঠে গেছে আরো আগে।
মশারি উঠিয়ে তাড়াহুড়ো করে চশমাটা বেড সাইড টেবিল থেকে তুলে পায়ে স্যাণ্ডেল না লাগিয়েই খালি পায়ে দৌড় দিলেন। দরজা খোলাই আছে। হুড়মুড় করে রাতের কণকণে ঠাণ্ডা বাতাস আর কুয়াশা ঘরের ভেতর এসে ঢুকে যাচ্ছে। গায়ে সোয়েটার দেয়াই আছে। কিন্তু তবুও ঠকঠকিয়ে কাঁপা শুরু করলেন। কারেন্ট নেই এখনও। কিন্তু বাহিরের বারান্দায় হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। এক রকম দৌড়ে বেরিয়ে এলেন নিচতলার বারান্দায়। মনোয়ারা সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন, কোলে দীপার মেয়েটা। কাঁথার ভেতর থেকে শরীর বাঁকিয়ে কাঁদছে। রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে সেই কান্না তীরের মত কানে এসে বিঁধছে।
মোস্তফা সাহেব অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখতে পেলেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
উঠানের শেষ প্রান্তের কুয়াটার পাশে ইমন চুপচাপ হেলান দিয়ে বসে আছে ইটের স্তুপগুলোর ওপর। দীপাকে উদ্ভ্রান্তের মত দেখা যাচ্ছে একের পর এক ইট এসে তুলে নিয়ে চিৎকার করে করে কুয়ার পানিতে গায়ের জোরে ছুড়ে ছুড়ে মারছে।
দোতলা থেকে রুহামা, ইমরান আর ওদের বাচ্চাগুলোও নেমে এসেছে নিচে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে দীপার উন্মাদ কর্মকান্ড। রাতের নিঃশব্দতার ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে দীপার কান্না মেশানো রাগ, ক্ষোভের সেই আস্ফালন।
একটা একটা করে ইট টেনে নিয়ে ঝপাস করে কুয়ার মধ্যে ফেলছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। ইমনকে বহুদূর থেকেও দেখা যায় হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছছে আবছা অন্ধকারে।
মোস্তফা সাহেব কিছু বুঝতে পারেন না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারেন ভয়ংকর কোনো কষ্ট জড়িয়ে আছে সমস্ত দৃশ্যটার মাঝে...... মনোয়ারা কোলের বাচ্চাটার কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, ‘বাহিরে ঠাণ্ডা অনেক। ভেতরে চল। বাচ্চাটার কান্না থামছে না।’
রুহামা এগিয়ে এসে বিমূঢ়ের মত জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে আম্মা? দীপা পাগলের মত কুয়ার মধ্যে ইট ফেলছে কেন?’
মনোয়ারা উত্তর দিলেন না। চোখের ইশারায় বড় ছেলে ইমরানকে বুঝিয়ে দিলেন সবাইকে নিয়ে ঘরে ফেরত যেতে। এখানে উদ্বিগ্ন হবার মতো কিছু ঘটেনি।
মোস্তফা সাহেব কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে গেলেন স্ত্রীর কথামতো। বাহিরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে দীপা...

ষাট সত্তরটা ইট কুয়ার মাঝে ফেলার পর হাঁটু গেড়ে ধপ করে বসে পড়ল দীপা লম্বা লম্বা ঘাসের ওপর। কাঁদছে না আর। দু হাত দিয়ে ঘাসের ভেতর আঙ্গুল খামচে ধরে রেখেছে মাটি। চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। বন্য লাগছে।
ইমন আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে হাঁটু ভেঙে দীপার পাশে বসল। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘জাহিদকে যখন মিলিটারিরা পাহাড়তলি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তখন আমরা ভেবেছিলাম ওকে মেরে ফেলবে দুদিনের মাঝে। কারণ আমরা যে পালটা আঘাত করবো, তেমন কোনো রসদই ছিল না হাতে। জাহিদ তিন মাস বেঁচে ছিল। আমরা যখন পাহাড়তলিতে এটাক করি, সে সময় ওকে জীবন্ত খুঁজে পেয়েছিলাম। ক্রমাগত বুটের আঘাত আর বেয়োনেটের খোঁচার ওর দুই পা থেঁতলে মাংস বের হয়ে পঁচন ধরে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা যখন উদ্ধার করলাম, সে বেশ আনন্দিত গলায় বলেছিল- একটা বেনসন দে তো। দুটো টান দিয়ে যাই দুনিয়া ছাড়ার আগে! আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম। সাথে একজনের বেনসন ছিল। খেতে দিলাম। দুই তিন টান দেয়ার পর কাশতে কাশতে জাহিদ মারা গেল। আমরা সবাই বৃষ্টির মধ্যে কাঁদা পানি সরিয়ে কবর খুঁড়ে ওকে বিদায় দিলাম। সে বার একটা কথা মাথায় এসেছিল দীপা। বৃষ্টির মাঝে জানাজায় দাঁড়িয়ে একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল সারাক্ষণ...’
দীপা মুখ নামিয়ে দম নিচ্ছে। ঘন ঘন সেই শব্দ শোনা যায়।
‘আমাদের এই দেশটা অনেক বেশি কিছু দিয়ে ফেলেছে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে। এত এত স্যাক্রিফাইস, এতগুলো মৃত্যু, কিংবা তোমাদের সম্ভ্রম হারানোর ব্যাপারগুলো চাট্টিখানি কথা না... জাহিদ সিগারেটের শেষ ফুঁ দিতে দিতে কী বলেছিল জানো? I’m born to free man! Let me see the dark sky and let me smoke with freedom! আমার আত্মাটা স্বাধীন হয়ে মৃত্যুবরণ করুক!’ ইমনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, ‘দীপা, আমাদের অনেক অমূল্য সম্পদ চলে গেছে দেশটার জন্য... কিন্তু আমরা এখন স্বাধীন। তুমি চাইলেই কুয়াতে তোমার বাচ্চাকে ছুঁড়ে মারতে পারবে, চাইলেই নিজেকে হত্যা করতে পারবে, চাইলেই বুক ভরে কাঁদতে পারবে। কেউ তোমাকে বাঁধা দেবে না। এটলিস্ট ইউ ডিজার্ভ ইট। আই কান্ট টেক ইট ফ্রম ইউ। কিন্তু আমাদের সবার বেঁচে থাকার পেছনে স্রষ্টা নিশ্চই কোনো কারণ লিখে রেখেছেন। সেই কারণটুকু আমাদের খুঁজে বেরাতে হবে...’
দীপা যেন শুনতে পায় না ইমনের কথাগুলো। ঘাস, মাটি খামছে তুলে নিজের মুখে, গলায়, বুকে, সমস্ত শরীরে পাগলের মত মাখতে শুরু করে হঠাৎ... ইমন মুখ ঝুঁকিয়ে ফেলে।
‘ইমন দা, এই মাটিগুলো অনেক পুণ্যের মাটি না? আমার সমস্ত শরীরটা অসহ্যরকম নোংরা হয়ে গেছে। আমাকে এই মাটি দিয়ে লেপে দিন প্লিজ। আমি ভিক্ষা চাইছি আপনার কাছে। আমাকে চিতায় না জ্বালিয়ে আজন্ম চিতায় তুলে দিয়েছে তারা। আমাকে এবারে কবর দিন। এই মাটি দিয়ে লেপে দিন দোহাই লাগে আপনার...’ কাতর মুখে মাটি খামছে উন্মাদের মত মুখে, হাতে পায়ে ডলতে থাকে দীপা। কাঁদতে কাঁদতে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে এক ফালি চাঁদের নিচে।
ইমন হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে এক মুঠো ঘাস মাটি নিয়ে সামনে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকা মাটি মাখা দীপার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘দীপা, তোমরা এই মাটির চাইতেও অনেক পবিত্র...’
ঘাসের ওপর শুয়ে থাকা দীপা ইমনের সেই মাটি ধরা হাতটা ধরে কাঁদতে থাকে আকূল হয়ে।
বহুদূর বনে তাক্ষতের ডাক শোনা যায়। কুকুরের করুণ সুরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে শীতের পাতাঝড়া বাতাসের মাঝ দিয়ে। সেই বাতাসে দীপার মত আরো কত শত নারীর ক্রন্দন জনমভর মিশে গেছে তার ইয়ত্তা নেই...

(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৫:৩০
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×