somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্বারিন

২১ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক.
আমার শ্বশুর ব্যারিস্টার ফজল শেখ তাঁর আমলের খুব নাম করা উকিল ছিলেন। আশির দশকের কথা। সেই সময়ে নাজিরহাট সহ আশেপাশের প্রায় বিশ ত্রিশ গ্রাম এক নামে চিনত তাঁকে। ফৌজদারী মামলায় বেশ দখল ছিল তাঁর। চট্টগ্রামের হাই কোর্টে চারদিকে “ফজল সাব” রীতিমত সমীহ জাগানো একটা নাম ছিল। মামলায় হারেননি বলতে গেলে কখনোই। সমস্যার মধ্যেই একটাই ছিল, কিছু কিছু সর্বজন নিন্দিত আসামীকে তিনি বিচিত্র সব কায়দায় নিরাপরাধ সাব্যস্ত করে বের করে এনেছিলেন। এমনকি সেই সময়ের ঘাঘু খুনের আসামী আরস আলী মাতুব্বরকেও বহুবার নানান খুনের মামলা থেকে উদ্ধার করে দিয়েছিলেন। সে জন্য পেছন দিকে অনেকেই কানা ঘুষা করেছে। পাত্তা দেননি তিনি। শত্রুও গজিয়েছিল এসব করতে গিয়ে। শেষ বয়সে সম্ভবত ফরিয়াদী পক্ষের কেউ রাতের বেলা আব্বাকে বাজার থেকে ফেরার সময় রাম দা মেরে পেছন থেকে ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে আলগা করে দিয়েছিল। বাকি চার বছর যাও বা বেঁচেছিলেন- বিছানায়। সুস্থ আর হননি। যমে বৈদ্যে টানা টানি চার বছর ধরে চলার পর বৈদ্যে ক্ষান্ত দিয়েছে। হাঁফানির এমন টান উঠেছিল এক পৌষের ভোরে, যে ওখানেই ইহলীলার পরিসমাপ্তি।
আমার শ্বশুর আব্বার সঙ্গে আমার তেমন একটা ভাল সম্পর্ক ছিল না। আমি ছিলাম সরকারী চাকুরেজীবি। টুকটাক লেখালেখি করতাম। ওনার বাকি জামাইদের তুলনায় বলা যায় আমার তেমন কিছুই ছিল না। সেজন্য উঠতে বসতে খোঁটা দিতেন অন্যদের সাথে তুলনা দিয়ে। পারতপক্ষে শ্বশুরবাড়ির পথ তেমন একটা মারাতাম না আমি। এড়িয়ে চলতাম। শুধু বৌটা পোয়াতি হওয়ার পর বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। শাশুড়ি মানুষটা ভাল। ভাল মাটি দিয়ে গড়েছেন আল্লাহ পাক। নালা নর্দমার আশপাশ থেকে মাটি এনে সম্ভবত গড়েছিলেন আমার শ্বশুরকে। এজন্য কথা বলে শান্তি পেতাম না। বৌকে নিয়ে সেবার যখন যাই, উনি শীতের এক ঠ্যাঙের মোরগ হয়ে গেছেন দূর্ঘটনায়। বিছানাতেই পড়ে থাকেন। তাও আমাকে খোঁটাতে তাঁর বিন্দু মাত্র ক্লান্তি নাই।
“কী ব্যাপার? লেখক সায়েব নাকি? তা বই পত্র কিছু বেচা কেনা হচ্ছে? নাকি বৌ পালতে পালতে কাহিল হয়ে নায়োর আনলা?”
শোনা মাত্র পিত্তি জ্বলে গেল। ঢোক গিলে পুরো অপমানটা গিলে খেয়ে হাসি মুখে উত্তর দিলাম, “আপনাদের দোয়ার ভাল আছি। সমস্যা নেই। বইপত্রও কেনাবেচা ভাল চলছে।”
“কি বলো? আমি তো দোয়া কালাম করিনা বহুদিন। বিছানায় হাগামুতা করতে করতে হাঁপায় গেলাম! তোমার জন্য দোয়া করার সময় কই আমার?”
এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কিছু নেই। পাশ কাটিয়ে গেলাম অন্যান্য বারের মতো।
যাহোক, ভূমিকা দীর্ঘায়িত না করে বরং বলে ফেলে আজকে কেন লিখছি।
আশির দশকের কুখ্যাত ভূমি দস্যু এবং ধর্ষন মামলার আসামী আরস আলী মাতুব্বরকে নিয়ে আমার শ্বশুর আব্বা কোনো এক কার্তিকের সন্ধ্যায়- মন ভাল থাকা অবস্থায় অদ্ভুত এক গল্প বলেছিলেন। সেটাকে “গল্প” নাম দিলে একটু বেমানান লাগে। কারেন্ট চলে যাওয়ায় কুপি বাতি জ্বালিয়ে আড্ডা হচ্ছিল, আমাদের তিন জামাইদের নিয়ে আব্বার ঘরে। আড্ডাটায় আমি নিছক নাম মাত্র বসেছিলাম। বড় দুই জামাই ভার্সিটির প্রফেসর আর এসোসিয়েট প্রফেসর। জ্ঞান বিজ্ঞানের জাহাজ বড়টা, মেজ দুলাভাই জ্ঞান বিজ্ঞানের স্টিমার। সেই তুলনায় আমি ডিঙি নৌকাও না। তাই এক কোণায় জবুথবু মুখে বসেছিলাম। জামাই শ্বশুরে আলাপ শুনছিলাম।
বড় দুলাভাই ইরাক-ইরান, আমেরিকার রাজনীতি আর বুশ সাদ্দাম নিয়ে বিশাল বিশাল বয়ান দিয়ে মুগ্ধ করে দিলেন শ্বশুর সাহেবকে। তিনি শুয়ে শুয়েই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন বড় দুলাভাইয়ের বিরাট দর্শন। এরপর মেজো দুলাভাই করলেন ফ্রান্সের কোন বিজ্ঞানী কি কি করে যাচ্ছেন দেশের উন্নতির জন্য সেসব। পাশাপাশি এরশাদ কি কি ভূল ভাল করছে বর্তমানে সেটা নিয়েও বিস্তর গবেষণা। দুই ভায়রাভাই ই আলোচনায় একজন আরেকজনকে তাল দিয়ে যাচ্ছেন। সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছেন আলোচনা আগানোর জন্য।
তাদের তুলনায় আমি অকাট মূর্খ মানুষ। আমার পালা এলে কি নিয়ে গল্প করা যায় সেটাই ভেবে কূলকিনারা না পেয়ে ঘামতে থাকি। আলাপ তো একেবারেই জমাতে পারি না। আজকেও হয়ত ভাল কোনো বিষয়ে আলাপ করতে না পারায় শ্বশুর আব্বা কথা শুনিয়ে দেবেন দুই জামাইয়ের সামনে। জামাই হিসেবে আম্মার পছন্দ ছিলাম আমি। আব্বা তেমন একটা পছন্দ করেননি। সে জন্যই বোধহয় তূণে থাকা মোক্ষম সব বাক্য বাণে সারাক্ষণ আমাকে বিদ্ধ করতে থাকতেন।
যাহোক, বিচিত্র কারণে সেদিন আলাপটা আমার পর্যন্ত আর এলো না। মেজো দুলাভাইয়ের সেই বিজ্ঞানীর অদ্ভুত সব গবেষণার কথা বলতে বলতে আলোচনা কীভাবে যেন লৌকিকতা থেকে অলৌকিকতায় চলে গেছে। ডাল পালায় কথা প্রসঙ্গ গিয়ে ঠেকল জ্বিনে গিয়ে।
আমার উচ্চ শিক্ষিত দুই ভায়রা ভাই জ্বিনের আলোচনা গিয়েই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। বড় জন গণিতের শিক্ষক, তিনি ধর্মানুরাগি। ওমরাহ্‌ করেছেন গত বছর। তার মতে জ্বিন আছে। মেজ দুলাভাই হলেন পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি জ্বিন, ভূত দেও দানবে বিশ্বাসী নন। খানিকটা নাস্তিক গোছের। যদিও আব্বার সামনে সেটা সহজে প্রকাশ করেন না।
জ্বিন আছে কি নেই এ নিয়ে দেখতে দেখতে বড় দুলাভাইয়ের সাথে মেজ দুলাভাইয়ের লেগে গেল বাক বিতণ্ডা।
“আপনি জ্বিন এনে দেখাতে পারবেন আমাকে? এটার কোনো অস্তিত্ব আছে? কোরআন হাদিস কিংবা বাইবেলে থাকলেই কি সব হয়ে গেল? দেখেছেন নিজের চোখে? যেটার অস্তিত্ব নাই সেটা বিশ্বাস করাটা কুসংষ্কার ছাড়া আর কিছু না!” গলার রগ ফুলিয়ে বলে উঠলেন মেজ দুলাভাই।
বড় দুলাভাই নাকের ওপর চশমাটা বসিয়ে সরু চোখে তাকালেন তার দিকে, “তার মানে তোমার কি এটাও বলতে হবে পদার্থের অনু পরমানু কন্সেপ্ট মিথ্যা? সেগুলো তো দেখা যায় না।”
“কিন্তু বহু পরীক্ষা নিরিক্ষা আছে যেটা দিয়ে এটা প্রমাণ করা হয়েছে যে সেগুলো আছে। সে রকম প্রমাণ কই যে জ্বিন আছে?” তেড়িয়া হয়ে উত্তর দিলেন মেজ দুলাভাই।
বড় দুলাভাই সম্ভবত কোনো একটা আয়াত বা হাদিস বলতে নিচ্ছেন এই বিষয়ে, কিন্তু আচমকা শ্বশুর আব্বা হঠাৎ বলে উঠলেন, “আমি জ্বিন দেখছি শওকত।” শওকত আমার মেজ ভায়রা ভাইয়ের নাম। কেমন যেন ক্লান্ত, বিষণ্ণ শোনালো তাঁর গলাটা। “জ্বিন দেখছি। একবার না। অসংখ্যবার...”
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম তাঁর দিকে। কণ্ঠস্বরে তাঁর এমন কিছু একটা ছিল যে পালটা প্রশ্ন করার মতো কথা খুঁজে পেলেন না শওকত ভাই। কেমন যেন বোকা বোকা মুখে তাকালেন আব্বার দিকে।
বিছানায় আবছা অন্ধকারে শুয়ে থাকা আব্বা গলা খাকারি দিয়ে বললেন, “আমিও তোমার মতই বিশ্বাস করতাম না এইসবে। আমি ধার্মিক মানুষ। কিন্তু কিছু বিষয়ে ঠিক পরিষ্কার কোনো বিশ্বাস অবিশ্বাস ছিল না। বা মনে মনে মানতাম না। বলা যায় সাহস ছিল বেশি। তারপর একটা সময় আসলো যখন সবকিছু বদলায় গেল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমার সব জানা জ্ঞান বহির্ভুত এমন সব বিষয় ঘটল যে...” থেমে গেলেন তিনি। হাঁফানির টানের মতো একটা টান নিলেন বুক উঁচু করে।
আমরা গলা বাড়িয়ে দিয়েছি বকের মতো। বিশেষ করে আমি। সারস বকের মতো। বাহিরে গাছপালার শুকনো পাতার আওয়াজ, মৃদু বাতাসে নড়ছে। বিদ্যুৎহীন গ্রামের বাড়িতে গল্পের জন্য উত্তম আবহাওয়া। আব্বা বলতে লাগলেন-
“আরস আলী মাতুব্বরের নাম তো তোমরা শুনছোই। ওকালত জীবনে যথেষ্ট বিতর্কিত ছিলাম এই মানুষটার মামলা লড়ার কারণে। যদিও শেষ দিকে আর বাঁচাতে পারিনি লোকটাকে। নিজ দোষেই ফাঁসি খেয়েছে। আমার সঙ্গে আরস আলী মাতুব্বরের দেখা হয়েছিল ফাঁসির এক ঘণ্টা আগে। জেলার আমার কাছের মানুষ, ভাল করে বললে আমার খালাতো ছোট বোনের স্বামী। তোমাদের আফজাল ফুফার কথা বলছি। তাঁর জন্য প্রোটকল এদিক সেদিক করে জেল হাজতে ঢোকা নতুন কিছু না আমার জন্য। আগেও এসেছি। ফাঁসির সময়গুলোতে থাকি না, এর আগ পর্যন্ত থাকা যায়। আমি যখন গিয়েছিলাম, আরস আলী হুজুরের সাথে তওবা পড়ে জায়নামাজ গুটিয়ে অপেক্ষা করছিল ম্যাজিস্ট্রেট আর জেলারের জন্য। ফাঁসির জন্য এত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করা আসামী আমি আমার দীর্ঘ ওকালত জীবনে প্রথম দেখেছি। সাতাশ বছরের কর্ম জীবনে বহু ঘাঘু আসামীকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচিয়েছি। ক্রিমিনাল লয়্যার আমি। বহু দুই তিন নম্বুরি সাক্ষী সাজিয়ে, কোরআনে হাত রেখে নির্দিধায় মিথ্যা সাক্ষ্যও দিয়েছি। আরস আলী আমার বহুদিনের পুরনো ক্লায়েন্ট। তাকে বাঘা বাঘা সব মামলা থেকে বাঁচিয়েছি আমি। কিন্তু শেষকালে এসে একটা সাধারণ কেসে আরস আলীর ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। সাক্ষী রেডিই ছিল। ঝামেলা বাঁধিয়েছে আরস আলী নিজেই। ভরা আদালতে নির্দিধায় সব স্বীকার করে বসেছে আমি কিছু শুরু করার আগেই! আট নয় বছরের একটা ছেলেকে রেপ কেস। রেপ করে গলা টিপে মেরেছে। সেটা আবার পান চিবাতে চিবাতে সুন্দর মতো বর্ণনা করেও বলেছে কাঠগড়ায়। এমন না যে রিমাণ্ডে ছিল। প্রতিদিনের মতো বাসা থেকে আর দশটা মামলায় যেভাবে আদালতে মামলা চালাতে যায় চা নাস্তা খেয়ে- একদম সেভাবেই আমার সাথে গাড়িতে চড়ে এসেছিল। তারপর কাঠগড়ায় গিয়ে গড়গড়িয়ে সব বলে দিয়েছে! বেশ হাসিমুখেই বলেছে।
মামলা যে টেনে ঝুলিয়ে রাখব সে উপায় আর রাখেনি আরস আলী। এত পিচ্ছিল আসামীকে সুরসুরিয়ে সব বলে ফেলতে দেখে জজ সায়েবও আর অপেক্ষা করেননি, খস খস করে ফাঁসি দিয়ে কলম ভেঙ্গেছেন!
আরস আলী ফাঁসির সময় আমার হাতে দুই হাত ধরে করমর্দন করেছিল আন্তরিক ভঙ্গীতে। পান খাওয়া দাঁত বের করে বলেছিল, “উকিল সাব? টেনশন কিসের? সব মামলায় জিততে হইব নাকি? মাঝে মাঝে দুই একটা না হারলে হয়?”
আমি বিমূঢ় ভাবটা চাপা দিয়ে কোনমতে বলেছি, “আমি কিছুই বুঝলাম না আরস আলী। তুমি এই কাজটা কেন করতে গেলা?”
“কুনটা? বলৎকার? নাকি সব স্বীকার কইরা নিছি সেইটা?”
“পরেরটা।”
“অ!” জেলখানার শিকের ফাঁকে মুখ সামান্য সামনে এনে দুই হাতে শিক ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। কিছু যেন ভাবল। তারপর নিচু গলায় বলল, “আমার জ্বিনটা হারায় গেছে বুঝলেন উকিল সাব। মিছা কথা মুখ দিয়া বাইর হইতেছে না আর। সেই যে এক দৌড় দিয়া নালা নর্দমা পার হইয়া ছুট দিছে- এখনো ফিরে নাই।”
আমি বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকালাম, “এ? কী বললা?”
হাসতে লাগল আরস আলী, “মশকারি করলাম উকিল সাব। মশকারি করলে মন ভালা থাকে। ফাঁসির আগে মন ফুরফুরে থাকা দরকার।”
“তোমার বিষয়টা আমার কাছে পুরাটাই ঘোলাটে লাগছে। এইরকম পাগলামী শেষ কালে আসে কেন করলা বুঝলাম না…”
“সব বিষয় বুঝলে তো ওলী আউলিয়া হইয়া যাইতেন উকিল সাব, ওকালতি ছাইড়া দিয়া নিরুদ্দেশ হইতেন।” উদার গলায় হাসতে হাসতে বলল আরস আলী।
হাত ঘড়ি দেখে বললাম, “আমার সময় শেষ। যেতে হবে। কিছু বলার থাকলে বলো?”
আরস আলী চোখ মোটকে তাকালো, “সময় তো আমার শেষ! আপনার না! অত তাড়াহুড়া কিসের উকিল সাব?”
“টাইম এন্ট্রি করে ঢুকেছি রেজিস্ট্রারে। বের না হলে বের করার জন্য কন্সটেবল পাঠিয়ে দেবে।” পায়ের ভার বদল করে ব্যস্ত গলায় বললাম। চোখের চশমাটা বার বার নাক থেকে পিছলে নেমে যাচ্ছে। গরম অনেক। ভাদ্র মাসের গরম। জেলখানায় চাল সেদ্ধ করে দেয়া গরম। পকেটে পাইজাম কিংবা মিনিকেট নিয়ে আসলে নির্ঘাত ভাত হয়ে যেত। বাতাসে জলীয় বাস্প বেশি, সেই সাথে দোজখের মতো গরম। আসামীরা এক দোজখ থেকে আরেক দোজখে যায়- তাদের চামড়ার সহনশীল তাপমাত্রা বড় পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ার মতো করে অভ্যাস করানো হয় যা বুঝলাম।
“উকিল সাব?”
“উঁ?”
“আপনে জ্বিন দেখছেন?”
চশমার ওপর দিয়ে তাকালাম, “কী বললা?”
“জ্বিন?” উদাস কণ্ঠে বলল আরস আলী।
“নাহ। বিশ্বাস করি না এইসব। আমি যেইটা দেখিনি, সেইটা বিশ্বাস করি না।”
“এইটা ভাল বলছেন। জ্ঞানী লোকের জ্ঞানী কথা। যেইটা দেখি নাই, সেইটা বিশ্বাস করি না। কি সুন্দর!” এলোমেলো মাথা নাড়লো, নিজে নিজেই যেন বলল।
“ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়াও চোখে দেখা যায় না। কিন্তু সেইটা বিশ্বাস করি। আমি অত ধার্মীক না। এইজন্য বললাম। …… যাগ্যে, আর কিছু বলতে না চাইলে আমি গেলাম। গরমে প্রেশার বাড়ছে মনে হয়।”
আরস আলী শিকের ফাঁকে মুখ রেখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনের আধো অন্ধকার দেয়ালের দিকে। রাত প্রায় একটার মতো বাজে। কিছুক্ষণ পর সবাই এসে যাবে। ডাক্তারও থাকবে। ফাঁসির পর আরস আলীর লাশ ভালমত পরীক্ষা করে গুরুত্বপূর্ণ আর্টারি কেটে দিয়ে লাশ দিয়ে দেবে।
আমি চলে আসতে নিয়েছিলাম।
হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পেলাম আরস আলী নিচু সুরে বিচিত্র ভাষায় মৃদু কণ্ঠে গান গাওয়ার চেষ্টার করছে যেন। আমি ফিরে তাকালাম। আরস আলী আবছা অন্ধকার জেলের শিকে মুখ রেখে সামনের দিকে ঝুকে আছে। তেতাল্লিশ বছরের শক্ত সামর্থ শরীর। পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পরে ছিল। আমি তাকানো মাত্র গান থামিয়ে কেমন যেন ভীতু গলায় বলল, “পুরুষ মানুষ খুব দূর্বল বুঝলেন উকিল সাব?”
আমি পাঁচ সাত গজ দূরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম লোকটার চোখের তারায় ক্ষণিকের জন্য একটা ভয় উঁকি দিল। কিছু বললাম না। বুঝতে পারলাম আরস আলী আরো কিছু বলবে।
“নিজের কুনো পাপ-পুণ্য নিয়া ভাবি নাই বুঝলেন উকিল সাব। সব দোষ এই দুই জায়গায়।” ডান হাতে একবার মাথায় আরেকবার পাঞ্জাবি আর লুঙ্গির ওপর দিয়ে দুই পায়ের মাঝের জায়গায়টা ইঙ্গিতে বোঝালো।
আমি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম পরের কথাগুলোর জন্য।
“আপনার কাছে লুকানোর কিছু নাই আমার। আমার ভালা খারাপ সবই দেখছেন গত পনেরো বছর ধইরা। জমি জিরাতের কামড়ানি আর শরীলের কামড়ানি এই দুইটা আটকাইতে পারি না দেইখা মামলা মুকদ্দমার কুনো অভাব নাই। শয়তানের লগেও শয়তানী করছি, ভালা মাইসের সাথেও শয়তানী করছি। যদিও নিজের কাজ কর্মরে শয়তানী লাগে নাই আগে, এখনো যে খুব লাগতেছে- সেইটাও না। কাজ তো কাজই। কাজ না করলে কি খাইয়া বাঁচতাম তখন? আর বয়সের কারণে শরীলের টান বলেও তো কথা আছে। দুই চাইট্টা শখ কি মিটানো যাইবো না?”
“কথা সংক্ষেপ করো আরস আলী। যখন জিজ্ঞেস করছিলাম, তখন উত্তর দেও নাই। এখন এত কথা শোনার মতো অবস্থাও নাই। যেতে হবে।” ঠাণ্ডা গলায় বললাম।
“বশির মিয়ার ছুটো বৌটার কথা মনে আছে আপনার?” আচমকা বলে উঠল।
“বশির মিয়ার ছোট বৌ? কার কথা বলো? শবনম?” অনিশ্চিত গলায় বললাম। ঠিক খেয়াল পড়ছে না নামগুলো। তবে এরকমই কিছু একটা ছিল যতটা মনে পড়ে।
“হ্যাঁ। শবনম খাতুন। খিয়াল আসছে? আমার রাইস মিলে কাজ করতো?” জ্বল জ্বলে চোখে তাকায় আরস আলী।
আমার মনে পড়ে খানিকটা। বশির মিয়া নামের ত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের সারেং ছিল গ্রামে। বছরে বছরে বার্মা, পাকিস্তান, আফ্রিকা, সৌদি, কেনিয়া ঘুরে বেড়াত। বড় বৌ দীর্ঘদিন স্বামী না থাকায় আরেক লোকের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। দেশে ফিরে বশির মিয়া আরেকটা বিয়ে করেছিল। তের চৌদ্দ বছরের একটা মাদ্রাসার ছাত্রীকে। কোনো এক মক্তবের হুজুরের মেয়ে। শবনম খাতুন। হুজুর সাহেব আর্থিক দিক দিয়ে ভালই অভাবে ছিল। নয়টা মেয়ে। ছেলে নাই। শবনম চতুর্থ। চালের মিলে দিনের বেলায় কাজ করতো। কম বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয় পক্ষের ঘর দেখে। যতটা খেয়াল আসছে, আরস আলীর সাথে শবনমের দেখা রাইস মিলেই হয়েছে। বিয়েটা হয়েছিল তার কিছুদিন পর। আরস আলীর সাথে বশির মিয়ার বিবাদ হয় কোনো একটা পুকুরের পাড়ের জমির দাগ নিয়ে। এরপর আরস আলী এক বর্ষার রাতে বশির মিয়াকে লোক জন দিয়ে ধরে হাত পা বেঁধে পুকুরে ডুবিয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে শবনমদের মাটির বাড়িতে ঢুকে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আরস আলী। পরেরদিন একই পুকুরে স্বামীর দড়ি বাঁধা লাশের পাশে অর্ধ নগ্ন শবনমেরও লাশ ভেসে ওঠে। সেবার অবশ্য ধর্ষণের মামলা বা খুনের মামলা তেমন একটা গড়ানোর সুযোগ পায়নি আরসের নামে। প্রমাণই ছিল না। আর বাদী হয়ে কেউ মামলাও করেনি। এতদিন বাদে আজকে হঠাৎ সেই শবনমের কথা কেন এলো বুঝতে পারলাম না।
আরস আলী একটু চুপ থেকে প্রায় শোনা যায় না, এমন ভাবে ফিসফিস করে বলল, “খুব আজীব কিচ্ছা কি জানেন উকিল সাব? বলৎকার বলেন, মাডার বলেন- আমি কিন্তু নামায মিস দেই নাই। সবকিছু করার পরেও পাক গোছুল দিয়া মসজিদে গিয়া নামাজ পড়ছি। সমস্যা বাঁধছে এই শবনম ছেমড়িটারে বলৎকার কইরা। আমি এই জীবনে যতবার নামাজে দাঁড়াইছি সেই ঘটনার পর, আমার জায়নামাযের ঠিক সামনে উলটা দিক থেকে মুখামুখী আরেকটা জায়নামাযে একদম আমার দিকে মুখ ফিরায়া শবনমও নামাযে দাঁড়ায়! কালো ওড়না দিয়া মাথা, গলা প্যাঁচানো থাকে, গায়ে আগের মতো সালোয়ার কামিজ। কিন্তু নামায পড়ে না। আমি সুরা পড়ে রুকু সিজদায় যতবার যাই, সেও আমার মুখামুখী রুকু সিজদা করে- কিন্তু যেন আমারেই করতেছে! আর আমি তাকাইলেই একদম আমার চোখ বরাবর তাকাইয়া মিচকা মিচকা হাসে! রুহ শুদ্ধা উড়ে যায় সেই হাসি দেখলে! আমি এইসব খোয়াব ভাইবা এরপর একেবারে দেয়ালের সাথে জায়নামায লাগাইয়া দাঁড়াইতাম। মানে সামনে একদম দেয়াল, অন্যপাশে মুখামুখী দাঁড়ানোর কেউ থাকা সম্ভব না দেয়াল থাকায়। কিন্তু লাভ হয় নাই। আমি যেই রুকু সিজদায় গেছি- অমনি টের পাইছি ঠিক আমার পিছেই সেই মাইয়্যা নামাযে দাঁড়াইছে! না দেইখাও সেই মেয়ের চোখের মধ্যে শয়তানের মতো হাসি আছে বুঝতে পারতাম। সিজদার সময় মাথা ঝুকাইয়া তাকাইলেই স্পষ্ট দেখতে পাইতাম সালোয়ার কামিজ আর কালো ওড়না গায়ে দিয়া আমার পিছে নামাযে দাঁড়াইছে মাইয়্যাটা! সালাম ফিরাইতে গেলেই দেখতাম পিছন থেকে পাশে চলে আসছে সেই মাইয়্যা…… ভয়ে কইলজা শুদ্ধা বাইর হইয়া যায় যায় অবস্থা আমার।”
আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম শিকগুলোর সামনে।
আমার মুখের অভিব্যক্তি দেখে হাসল সামান্য আরস আলী। “তওবা কইরা ফালাইছি, নাইলে মুখ খিচ্চা কয়টা গালি দিতাম শালিরে। জিন্দেগী পুরা অশান্তি বানায় রাখছিল। এখন মইরা যদি শান্তি পাই। ভাল থাইকেন উকিল সাব। সালামালাইকুম।” ডান হাত লম্বা ভাবে নাকের সাথে মিলিয়ে সালাম দিল, বিদায়সুলভ।
আমি হাজারটা প্রশ্ন মনে দিয়ে ফেরত চলে এলাম।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
আরস আলী মাতুব্বরের ফাসী হয়ে গেল তার বিশ মিনিটের মাথায়। ডাক্তার হাত পায়ের রগ কেটে দিয়ে লাশ ফেরত দিল আরো এক ঘণ্টা পর। পরের দিন বাদ জোহর সেই লাশ কবরও দেয়া হল মাতুব্বরদের পারিবারিক গোরস্থানে। জানাজাতে হাতে গোণা তিন চারজন এলো কেবল। পুরো গ্রামবাসী বাহিরে মিষ্টি বিলাচ্ছে আরস আলীর ফাঁসি উপলক্ষ্যে। বৃষ্টির মধ্যে কবর দিয়েও শান্তি নেই। মাটি সরে সরে যাচ্ছে। ওপরে ছালা আর সিমেন্টের বস্তার কেটে হাট করে দেয়া হল, সাথে নারকেল গাছের ডাল। যাতে মাটি সরে না যায়।
তবে লাভ হল না। কবর দেয়ার দিবাগত রাতে আরশ আলীর কবর থেকে লাশটা খুঁড়ে কেউ বের করে নিয়ে গেল। হা করা একটা শেয়ালের মতো গর্ত রইল কেবল কবরটার ওপর। গ্রামবাসীর এই বিষয়ে কোনো মাথা ব্যথা দেখা গেল না। কাজটা তাদের মধ্যেই কেউ করেছে নিশ্চয়। কিন্তু স্বীকার করবে কেন? দীর্ঘ বিশ বছর আরস আলীর নানান অপকর্মের নিপীড়নের শিকার হওয়া গ্রামবাসী তার লাশ কবরে থাকতে দেবে এটা অবশ্য আমি আশাও করিনি। নদীতে ভাসিয়েও দিয়ে থাকতে পারে, অথবা জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ফেলেও আসতে পারে। শেয়াল কুকুরে টেনে টেনে খাবে। আরস আলী নিজেও খুন খারাবী করে জঙ্গলে গিয়ে লাশ ফেলে আসতো। তার লাশের সাথেও তেমনটা হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তাই আর থানা হাজত করা হল না। ভাল লোকের লাশ নিলে হৈ হৈ রব পড়ে যেমন, আরস আলীর লাশ নেয়ার পর শ্মশানের নিস্তব্ধতা ছিল গোটা গ্রামে। কারো কোনো আগ্রহ নেই। এই মড়া কবরে পচলো না নদীতে ভাসলো- কারো মাথা ব্যাথা নেই। কিছুদিন চায়ের দোকানে আরস আলী এবং তার লাশ চুরি একটা গল্পের বিষয় হয়ে রইল। তারপর দেখতে দেখতে সেটাও আলোচনা থেকে বাদ পরে গেল।
আরস আলীকে ভুলে যেতে সময় লাগলো না কারো। মাস তিনেক বাদে আরস আলী মাতুব্বর নামের লোকটার কথা সবাই ভুলে গেল। স্ত্রী সন্তানহীন লোকটার ভিটামাটি গ্রামের নতুন সালিশে ওয়াক্‌ফ করে দেয়া হল স্কুল, মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য। এমনকি লোকটার যাবতীয় জমি জমাও সালিশে সব ভাগাভাগি করে দেয়া হল যারা দাবীদার ছিল। কিংবা যারা এককালে মাতুব্বরের অত্যাচারে জায়গার দখল নিতে পারেনি- তারা সুযোগ বুঝে দখল নিয়ে নিল।
মোট কথা, তিন মাস পর আরস আলী মাতুব্বর নামের ভয়ঙ্কর খুনে মোল্লাকে নাজির হাটের সবাই ভুলে গেল বেমালুম।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
আসল ঘটনার শুরু এখানেই।
কোর্ট কাচারির বেশ কিছু মামলা নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ বললেই হয়। জজ সাহেবের ট্রান্সফার হয়ে গেছে। ঝুলে গেছে বেশ কয়েকটা মামলা। ক্লায়েন্টের চাপে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা আমার। সাথে যোগ হয়েছে বড় মেয়েটার কলেরা। গ্রাম জোড়া কলেরার প্রকোপ খুব তখন। ডাক্তার নাই কোথাও। কবিরাজের হোমিওপ্যাথি ওষুধের ওপরেই চলছি। সদর হাসপাতালে ডাক্তার নিজেই নাকি কলেরায় আক্রান্ত। বাঁচি মরি অবস্থা।
আমি সারাদিন অনেক ছোটা ছুটি করে মেয়েটাকে নিয়ে একবার কবিরাজের বাড়ি গেলাম ভ্যান নিয়ে, আরেকবার গঞ্জ থেকে কিছু দরকারি খাবার দাবার নিয়ে আসতে হল। ক্যাস্টারওয়েল শেষ হয়ে গেছে, ওটা খুঁজে পেতে ভালই ঝামেলা হল। বৃষ্টির মাঝে ভিজে ভিজে সব জোগার করে বাড়ি ফিরে তোমাদের আম্মার হাতে দিলাম। তারপর গোসল দিলাম কুয়াতলায় গিয়ে। জ্বর জ্বর লাগছে নিজেরই। ঘরে ঢুকে গরম কাপড় পরে বাড়িতেই রয়ে গেলাম। সেদিন আর বের হলাম না। কাছারি ঘরে বাহির থেকে দুজন ক্লায়েন্টের লোক ছাতা হাতে ভিজতে ভিজতে এসেছিল। ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। সম্ভব না। মগজ আর চলছে না। ঘরের ভেতর শান্তি নেই।
শুয়ে ঘুম আসবে না, দিন চলে গেছে। সন্ধ্যায় ঘুমানোর কিছু নেই। সর্দীর মতো লাগছে বৃষ্টিতে ভিজে। তাইতীব্র বর্ষণমুখর সেই সন্ধ্যায় আমার টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে গরম চা আর ঝাল করে সরিষা দিয়ে মুড়ি মাখানো খাচ্ছিলাম। বিদ্যুত নাই। হারিকেনের আলোয় বারান্দার বেঞ্চিতে বসে বৃষ্টি দেখছি। ভেতরের ঘরে ছেলে মেয়েরা পড়তে বসেছে। পুরো গ্রামের আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নেমেছে। বিশাল উঁচু উঁচু নারকেল গাছগুলো দুলছে বাতাসে এইদিক থেকে ঐদিকে। আম কাঁঠালের সব গাছ মাথা নাড়াচ্ছে ধীর ভঙ্গিমায়। পাতায় এতো জোরে জোরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে যে টিনের চালের শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে সেই আওয়াজ পাচ্ছি। উঠানের ওপর ইঞ্চিখানেক পানির স্তর জমেছে। অন্ধকারের মাঝে মুশলধারে ঝাপিয়ে নামছে বৃষ্টি, উঠানে আছড়ে পড়ে কুয়াশার মতো লাফিয়ে উঠছে। ছিটকে যাচ্ছে।
আমি আপনমনে একদৃষ্টিতে উঠানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম উঠানের কুয়াপাড়টার পাশ দিয়ে ছাতা নিয়ে কেউ একজন বের হয়ে আসছে বেড়ার ওপাশ থেকে। পেয়ারা গাছটা কুয়ার সাথেই লাগানো। ওটার ডালে হাত দিয়ে কেউ একজন পতন ঠেকালো আছাড় খেতে খেতে। সোজা হয়ে ছাতা নিয়ে উঠানের মাঝ দিয়ে হেঁটে এলো বারান্দাটার কাছে।
আমি কৌতূহলি মুখে ডাকলাম, “কে?” হারিকেনের ম্লান আলোয় বোঝা যাচ্ছে না।
টিনের চাল থেকে লম্বা ধারায় পানি যেখানে পড়ছে, সেখানে ছাতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল লোকটা। ছাতাটা সামান্য কাঁত করে দাঁত বের করে হাসলো দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গলের মাঝ দিয়ে, ডান হাতটা লম্বা ভাবে নাকের সামনে ধরে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, “সালামালাইকুম উকিল সাব, আমি আরস আলী মাতুব্বর। শরীলটা ভালা তো?”
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে ছাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে। চারপাশের এতো কোলাহল সেকেণ্ডের মধ্যে যেন স্থির হয়ে গেল কাঁচের মতো। এক মহাকাল সময় লাগিয়ে আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা সশব্দে সিমেন্টের বারান্দায় পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল। উষ্ণ রক্তের একটা স্রোত মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। আগুনের হল্কার মতো কিছু একটা দুই কানের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে…
বুকের কাছে হৃদপিণ্ডটা ফেটে যাবে প্রচণ্ড রক্তচাপে। কোনোমতে অস্ফুট গলায় বললাম, “আ-আরস আলী… ত-তুমি?” বলা বাহুল্য কথাটা শেষ করার আগেই মাথা চক্কর দিয়ে বেঞ্চি থেকে পড়ে গিয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি আমি।
মৃত্যুর পাঁচ মাস পর আরস আলী মাতুব্বর ফিরে এসেছিল আমার কাছে।

দুই.
“আপনি কাকে দেখছেন জানি না উকিল সাব, কিন্তু বিষয়টা ভাল না।” গম্ভীর মুখে ইমাম সাহেব জানালেন। এশারের নামায শেষ বহু আগেই। আমি সেদিনের ঐ ঘটনার পর টানা এক সপ্তাহ বিছানায় ছিলাম, জ্বরে বেহুশ। লোকজন কলেরা টাইফয়েড ভেবেছিল। কিন্তু আমি যে কিসের ভয়ে সয্যাশায়ী হয়েছি সেটা কাউকে বলতে পারিনি।
একটু সুস্থ হয়েই আজ মসজিদে এসে নামাযের পর ইমাম সাহেবকে একা পেয়ে সব বললাম। উনি বিচক্ষণ-বুদ্ধিমান মানুষ। দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক হিস্ট্রিতে শিক্ষকতাও করেছেন। খুবই এলেমদার মানুষ। এখন অবসরে চলে আসছেন। বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় আমাদের মসজিদের ইমামতি করেন, সেই সূত্রেই জানাশোনা। বয়সে আমারও বুজুর্গ। যদিও আমাকে আপনি বলে ডাকেন। মিম্বরের গায়ে হেলান দিয়ে মন দিয়ে আমার পুরো ঘটনাটা শুনলেন চুপচাপ। তারপর দীর্ঘক্ষণ পর মুখ খুললেন, “উকিল সাব, আপনি বলছেন আরস আলী নিজেও শবনমকে দেখতে পেতো? মারে ফেলার পরেও?”
“ফাঁসির আগে তো সে রকমই বলল। নামাযে দাঁড়ালে নাকি আয়নার মত সামনা সামনি মেয়েটাও জায়নামাযে দাঁড়াতো। কিংবা পেছনে। ফাঁসির আগে, তাও আবার তওবা করে ফেলার পর নিশ্চই কেউ মিথ্যা বলবে না?” মতামত জানতে চাওয়ার মতো তাঁর দিকে তাকাই আমি।
আবার চুপ হয়ে গেলেন ইমাম সাহেব। মিটমিটে চল্লিশ পাওয়ারের হলুদ বাতিটার চারদিকে পোকা উড়ছে। বাড়ি খাচ্ছে। পড়ে জড়ো হচ্ছে মেঝের উপর। রাত যতই বাড়বে, বাতি জ্বলতে থাকায় এইসব পোকা ততই জমবে। তারপর ফজরের সময় ঝাড়ু দিয়ে একেবারে সব ফেলে দেয়া হবে।
“আরস আলী নামাযের সময় শবনমকে নাও দেখে থাকতে পারে। কোরআন পাকে সূরা ক্বাফে পরিষ্কার বয়ান আছে সঙ্গী জ্বিনদের বিষয়ে। আপনার পড়াশোনা থাকলে তো জানার কথা। দেখতে অবিকল সেই মানুষের অবয়ব ধারণ করে থাকে এই জ্বিন। ক্বারিন নাম তার। মরে গেলে তো কেউ ফিরে আসে না উকিল সাব। জগতের নিয়ম বড়ই শক্ত। আমাদের চিন্তা চেতনায় অনেক বুঝার ফারাক আছে। মৃত্যুর পরেও যদি আপনি মৃত ব্যক্তিকে দেখেন, বুঝবেন এটা সে নিজে না। অবশ্যই তার অবয়ব ধারণকারী ক্বারিন। ক্বারিন হল মানুষের অসৎ সঙ্গী। তাকে যদিও আমাদের ধর্মে জ্বিনদের সামীল ধরা হয়েছে, কিন্তু পুঁথিপত্র ঘাটলে আরো কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, এটা ঠিক জ্বিন না। মানুষের নিজের একটা অংশ কিংবা এমন অলৌকিক সত্ত্বা যেটা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিবে।”
আমার শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে ইমাম সাহেব উঠে পড়লেন, “ভয় পাবেন না উকিল সাব। ভয় মনকে দূর্বল করে দেয়। মন শক্ত রাখেন। এসব দেখবেন না। আর তো কেউ দেখে নাই। আপনিই কেবল দেখেছেন তাকে। সূরা ইয়াসীন মুখস্ত থাকলে পড়তে থাকবেন। নাহলে আয়তুল কুরসি। ভয় ডর পেতে হলে আল্লাহকে পেতে হয়, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তুচ্ছ এই দুনিয়ায় লৌকিক-অলৌকিকতাকে ভয় পেয়ে লাভ কি?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম বিমূঢ়ের মতো। আলাপ আসলে এখানেই শেষ। ইমাম সাহেব বাতি নিভিয়ে তালা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমিও বেরিয়ে গেলাম তাঁর সাথে সাথে। হাতের পাঁচ ব্যাটারির লম্বা টর্চটা নিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে আম বাগানের মাঝ দিয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে লাগলাম। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পরিষ্কার ভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছি না।
তিন দিন হল বৃষ্টি থেমে গেছে। চারদিকের ভেজা মাটি শুকিয়ে খড়খড়ে একটা ভাব। ঘাস, ধুলার, মাটির রাস্তায় স্যাণ্ডেল মাড়িয়ে হেঁটে আসছিলাম বাগানের ভেতরটা হয়ে। সাথে কেউ নেই। গাছ গাছালির মাঝ দিয়ে একটু আধটু দূরের বাড়িঘর থেকে ম্লান হলুদ বাতির আলো চোখে আসে। কেমন যেন নীরবতা চারপাশে। নিরেট একটা ভাব। যেন সব শব্দ থেমে আছে। মাথার ওপরে গাছ গাছরার ডালপালা চুইয়ে ঘোলাটে চাঁদের আলো আসছে। অপূর্ণ চাঁদ। মেঘের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে খানিক বাহিরে পায়চারি করে। টানা আলো দিচ্ছে না।
আচমকা বাগানের ভেতর খস খসে একটা শব্দ শুনলাম। টর্চ মারলাম। বেজি টেজি হবে। ছুটে যাচ্ছে গাছে আড়াল দিয়ে। আমি পা চালাতে থাকলাম, অন্যমনস্ক ভাবে।
আবার শব্দ হল। খস খস। সেই সাথে মানুষের পায়ের শব্দের মতো। খানিকটা টেনে হাঁটলে যেমন শব্দ হয়, তেমন। আশ্চর্য তো!
“কে?” ফিরে তাকালাম, টর্চ ঘুরিয়ে আলো ফেললাম শব্দ যেদিক থেকে হচ্ছে সেদিকে। ক্ষণিকের জন্য মনে হল গাছের আড়ালে সরে গেল কেউ। বেশ চড়া গলায় ডাক দিলাম, “কে ওখানে?”
কেউ আওয়াজ দিল না। মনের ভুল? এমনিতেই আরস আলীর ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে সমস্ত চিন্তা ভাবনা। এজন্য ভুল হচ্ছে মনে হয়। তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগলাম। বাগানটা যথেষ্ট বড়, পুরো পার হতে প্রায় দশ থেকে এগারো মিনিট সময় লাগে। নামে আম বাগান হলেও আম গাছের চেয়ে সেগুন আর কাঁঠাল গাছই বেশি। গর্জন গাছও আছে। সেগুলোর বড় বড় ভেজা পাতা রাস্তার ওপর পড়ে আছে। যেগুলো শুকনো, সেগুলোয় পা পড়লে মড়মড়িয়ে উঠছে, ভেজাগুলো চপ চপ চাপা শব্দ। সেগুলোও ছাপিয়ে হঠাৎ পেছন থেকে এক সাথে একাধিক মানুষের পায়ের আওয়াজ হল।
চমকে ফিরে তাকালাম।
আবছা অন্ধকারে গাছের আড়াল থেকে একটা মানুষের মতো অবয়ব বেরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। খালি পায়ে। পুরুষ মানুষের ছায়া। ঠিক তার কয়েক গাছ পেছনে, দশ ফিট দূরত্বে কিশোরী একটা মেয়ে একই সারিতে এসে দাঁড়ালো।
আমি কাঁপা হাতে টর্চটার আলো ধীরে ধীরে তুলে ধরলাম মানুষগুলোর দিকে... আরস আলী... আর পেছনের মেয়েটাকে আমি চিনি। শবনম! টর্চের আলো মুখে পড়ার পরও কোনো বিকার নেই, অদ্ভুত হাসি হাসি একটা দৃষ্টিতে মেয়েটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আরস আলীও একটা হাত সমান করে নাক এবং চোখের মাঝ বরাবর সামনে এনে সালাম দিলো, “সালামালাইকুম উকিল সাব, ভালা আছেন?”
আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি। জগদ্দল পাথরের মূর্তি। ভেতরের সবকিছুতে অসম্ভব একটা তোলপাড় লেগে গেছে আমার। অথচ নড়তেও পারছি না আমি। অবর্ণণীয় একটা আতংক চেপে ধরতে শুরু করেছে আমাকে।
“উকিল সাব, আমাগোরে ভয় পাইয়া লাভ নাই। আমরা খুবই সাধারণ জিনিস। আপনার কাছে একটা সংবাদ দিতে আসছিলাম কেবল। এত ভয় পাইলে চলে?”
আমি তীব্র ভয়ে ততোক্ষণে পায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওখানেই বসে পড়েছি। মানুষগুলো ধীরে পায়ে হেঁটে আসছে আমার দিকে। হাতের টর্চটা ঘাসের ওপর পড়ে আরেকদিকে আলো দিচ্ছে। পেছনে অন্ধকারে ডুবে আছি আমি... আমরা।
আরস আলী এবং শবনম আমার দু হাত কাছে চলে এলো। ঠিক জীবন্ত রক্ত মাংসের মানুষ। বিন্দু মাত্র পরবাস্তবতা নেই, অলৌকিকতা নেই। আরস আলী ঝুঁকে আমার সামনে অদ্ভুত ভঙ্গীতে কুকুরের মতো বসে গলা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল, “দেখেন ছার? আমারে কি ভয় ডর লাগে? আমি ঠিক আপনার মতোই। কিস্যু নাই ভয়ের। খামাখা আপনে এত ভয় পাইতেছেন।”
আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে অনেক আগেই। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। মুখে দাঁত লেগে গেছে। গোঙাচ্ছি, দু হাতে মাটি, ঘাস খামচাচ্ছি বসে। একটা পা লম্বা করে বিছিয়ে রেখেছি। অথচ মানুষগুলোর নিঃশ্বাসের স্পষ্ট শব্দও পাচ্ছি। আমার চেয়েও জীবন্ত। আমার চেয়েও সজীব।
পাশের দশ বারো ফিট দূরত্বে একই রকম আবার খস খসে শব্দ হতেই মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম।
অন্ধকার একটা অবয়ব এসে দাঁড়িয়েছে ক্রাচে ভর করে। বেশ পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে ডান পা টা নেই। অবয়বটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শরীরের আকৃতি, গঠন সব খুব পরিচিত... সেই লোকটার হাতেও একটা বন্ধ টর্চ। একদম আমার টর্চটার মতো। শুধু নিভিয়ে রাখা। আর অবিকল... আমার চিন্তা ভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে।
“এই বাগানটা বড় খারাপ জায়গা উকিল সাব। খুব সাবধানে থাকিয়েন।” আরস আলী দাঁত বের করে হাসলো।
“ত-তুমি আরস আলী না! এইটা শবনম না! সব মরে গেছে!” অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে শব্দ বের হল। সমস্ত শরীর আগুণের মত জ্বলছে, এত গরম লাগছে কেন!
আমি মাটি খামছে কীভাবে কীভাবে যেন উঠে দাঁড়ালাম, পাগলের মতো স্যাণ্ডেল, টর্চ ফেলেই ছুটতে শুরু করলাম চেঁচাতে চেঁচাতে- “ওরা মরে গেছে ওরা মরে গেছে! এইটা সম্ভব না!”
ছুটতে ছুটতে মাথা ঘুরিয়ে এক ঝলক তাকিয়েছিলাম। কেউ পেছনে ছুটে আসছে না। গাছের পাশের ক্রাচে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাও চুপচাপ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমি লোকটাকে চিনি...”
এ পর্যন্ত এসে থামলেন আব্বা। জোরে জোরে হাপরের মতো শ্বাস নিচ্ছেন।
মেজ দুলাভাই জিজ্ঞেস করলেন, “থামলেন কেন আব্বা? লোকটা কে ছিল?”
আব্বা হাত নাড়লেন, “কিছু না। কেউ না। শুধুই ছায়া। বেশি ভয়ে উলটা পালটা দেখছিলাম।”
“কেউ তো অবশ্যই ছিল। এরপর কি হল আব্বা?” মেজ দুলাভাই কেমন যেন গোয়ারের মতো প্রশ্ন করলেন।
আব্বা দেখলাম কেমন যেন অন্য মনস্ক হয়ে গেছেন। “মানুষের সঙ্গী আছে। সৎ অসৎ কিনা জানি না। কিন্তু ক্বারিন আছে বুঝলা শওকত। আছে...”
আমাদের আলোচনাটা হঠাৎ করেই মাঝ পথে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিল। আব্বাও কেন কথা বলা শুরু করলেন, আবার কেনই বা কথা বন্ধ করে দিলেন বোঝা গেল না। এ বিষয়ে বাকি বছরগুলোতেও তিনি কোনোদিন কোনো কথা বলেননি। তারপর তিনি মারা যায়।
০০০০০০০০০০০০০
আমার শ্বশুর মারা যাবার পর রহস্য জনক ভাবে পরদিন বা সেই রাতেই কবর থেকে লাশ চুরি হয়েছিল। বলা বাহুল্য কবরের গায়ে শেয়ালের গর্তের মতো গর্ত হয়ে ছিল পরদিন যখন আমরা নারকেলের ডাল বিছাতে গিয়েছিলাম। সেই সময় এই ঘটনা নিয়ে পত্র পত্রিকায় অনেক লেখালেখি, প্রতিবেদন হয়েছিল। থানা পুলিশ হয়েছিল। কিন্তু লাশের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুরো বিষয়টার কোনো সুরাহা করতে না পেরে পুলিশ এক সময় ফাইল বন্ধ করে দেয়।
গ্রামের বাড়িতে ঘর লাগোয়া আব্বার অফিসটার জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়েছিলাম আমরা তিন ভায়রা ভাই মিলে। প্রচুর কাগজ পত্র, টাইপ রাইটার, সহ হাবি জাবি অদরকারী জিনিসে ভরা ছিল, কিংবা যার প্রয়োজনের জিনিস ছিল- তিনি নিজেই যেহেতু নেই, তাই সব বিদায় করে দিয়েছিলাম।
সে সময় আমার শ্বশুর ফজল শেখের একটা নথিতে কয়েকটা বাক্য এলোমেলো ভাবে লেখা থাকতে দেখেছিলাম। লেখালেখি করতাম বলে কাগজ পত্র গুলো ঘেটে ঘুটে দেখে নিচ্ছিলাম দরকারী কিছু ফেলে দিচ্ছি কিনা। আমার শ্বশুর ডায়েরি লিখতেন না। নোট লিখতেন দরকারে। এছাড়া আর কোনো নিজস্ব কোনো লেখা ছিল না। সে জন্যই নথির পিঠে লেখা ছেঁড়া সেই বাক্যগুলো চোখে আটকেছিল। লাল ফিতায় বাধা কিছু মামলার কাগজের পেছন পাশে পেন্সিলে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-
“আমাদের গন্তব্য কোথায়? উদ্দেশ্য কি? আমরা আমাদের সঙ্গীর মৃত্যুর পরও তাদের দৈনন্দিন সামাজিক জীবন এই মর্ত্যলোকে কতদিন কাটাবো? আমাদের নাম কি? ক্বারিন? আমরা কি আলো? না ছায়া?”
ঘাড়ের কাছটায় শিরশির করে উঠল আমার। বিচিত্র সব সম্ভাবনা উঁকি দিল মগজের ভেতর... জেল হাজতে নির্বিকার চিত্তে ফাঁসির কাষ্ঠে ওঠা আরস আলী মাতুব্বর... বাজার থেকে ফিরতে থাকা আমার শ্বশুরের ওপর আততায়ীর আঘাত... দীর্ঘদিন বিছানায় এক পায়ে শয্যা গ্রহণ... একই প্রকৃয়ার লাশ হারিয়ে যাওয়া...
খুব অদ্ভুত একটা সংযোগ দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতিটা ঘটনার সঙ্গে।
সত্যিই কি ক্বারিন কিংবা দৈত্বসত্ত্বা পৃথিবীতে বর্তমান? ক্বারিনদের কী আমাদের মাঝে বসবাস সম্ভব? কিংবা আমাদের অন্তর্ধানের পর আমাদের জায়গা দখল করা?
শ্বশুর আব্বার নথিপত্র সেদিন সব বেচতে দেইনি আমি। কারণ আমার জানা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল কারাগারে ফাঁসি আসলে কে নিয়েছিল? আদৌ আরস আলী? না অন্য কেউ? আব্বার বর্ণনার সেই এক পায়ের ছায়া মানব কে ছিল? অথবা এই বাক্যের কী অর্থ- আমরা আমাদের সঙ্গীর মৃত্যুর পরও তাদের দৈনন্দিন সামাজিক জীবন এই মর্ত্যলোকে কতদিন কাটাবো?
অফিসটায় তালা লাগিয়ে দুলাভাইদের বলেছিলাম আমাকে কয়েকটা সপ্তাহ সময় দিতে। আব্বার কাগজ পত্রগুলো নিয়ে কিছু পড়াশোনা করতে চাই। তাঁরা সামান্য বিরক্ত হলেও মানা করেননি। মেনে নিয়েছিলেন।
কিন্তু রহস্য জনক ভাবে দুই রাত পর বন্ধ সেই অফিসে ইলেক্ট্রিক শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে সব পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। কিছু যে খুঁজে বের করবো- সে রকম তথ্য উপাত্ত সব ছাই হয়ে যায়।
তবু আমি থামিনি, খোঁজ চালিয়ে গিয়েছিলাম আরস আলী মাতুব্বর, শবনম কিংবা আমার শ্বশুর ফজল শেখকে ঘিরে যত প্রশ্ন আছে- সবকিছুর। লাশ চুরির ঘটনা কিংবা নথির গায়ের লেখাটা যদি না থাকতো, আমি সবকিছু মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলো অনেক প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে।
আমি লৌকিকতায় যেমন বিশ্বাসী, অলৌকিক ভূবনেও একই রকম বিশ্বাস করি। প্রকৃতি খুবই রহস্যে ঘেরা। ভ্রুণ থেকে মানব সন্তান, কিংবা মানব সন্তান থেকে মাটি- সব কিছু অদ্ভুত একটা সংযোগে ঘুরছে। এই শৃংখ্যলে যদি কোনো আরো অজানা কিছু রয়ে যায়- সেটাকে অমূলক ভেবে উড়িয়ে দেয়ার কিছু নেই। এই মহাসৃষ্টির কতটুকুই বা আবিষ্কার হয়েছে?
হ্যাঁ, আমার করা সেই খোঁজ বা অনুসন্ধানের এমন সব উত্তর পেয়েছিলাম বহুদিন পরে যেগুলো আমার চেনা জানা জগতটাকে উলটে পালটে রেখে দিয়েছিল।
আরেকদিন সে সব নিয়ে লিখবো। আজ ক্লান্ত। বাতিটা নিভে আসছে টেবিলের। চোখের সমস্যায় ভুগছি। আর কতদিন এভাবে লিখে যেতে পারবো জানি না। বয়স বাড়ছে। ছানি পড়েছে বাম চোখটায়। অপারেশন করানো জরুরি।
আমি জানি আমি বাতি নিভিয়ে উঠে যাওয়ার পর বাকি লাইনগুলো কিংবা আপনাদের মনের ভেতর জেগে ওঠা প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ লিখবে... পেছনে খস খস শব্দ শুরু হয়ে গেছে প্রতিদিনের মতো। জায়গা ছেড়ে দিতে হবে।
রাখছি আজ।

(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:২০
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×