১.
আমাদের প্রথম সন্তান আজ পৃথিবীতে আসবে। ভীষণ প্রতীক্ষিত এই দিনটিতেই জায়িফ কে দূরে যেতে হলো! ডাক্তার ম্যাডামের দেয়া তারিখ অনুযায়ী আরো ১০ দিন পরে ওর পৃথিবীতে আসার কথা। বাবা সোনাটা একটু আগে আগেই চলে আসতে চাইছে মা-বাবার কোল আলো করে। সকালেই শরীরটা খারাপ লাগছিল। সবধরনের অনুভূতি থেকে একেবারেই আলাদা। আম্মুকে জানাতেই আম্মু ছুটে গিয়ে শাশুড়ি মাকে ফোন দিলেন। ডাক্তার ম্যাডামের সাথে কথা বললেন। আর তারপর ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে রেডি করে সোজা হসপিটালে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, শুনলাম বিকাল পাঁচটা নাগাদ আমাকে অপারেশন টেবিলে শুতে হবে। অথচ কথা ছিলো, জায়িফ আমার পাশে থাকবে, আমার হাত ধরে থাকবে, প্রসব বেদনা উপশমের দায়িত্ব নিবে। ও এই সময়ে মালয়শিয়া তে। অফিসের কাজে। একদমই যেতে চাইনি, আমি-ই বলেছিলাম তুমি ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরে বাচ্চা হবে, নিশ্চিন্তে যাও তো। অথচ এখন, আমার কেবল-ই কান্না পাচ্ছে।
আমাকে এনেস্থেসিয়া দেয়া হল। ডাক্তার ফরিদা আলম বেশ হাসিখুশি মানুষ। এসেই হাসি। চিন্তার কিছু নেই মাই গার্ল। আর কিছুসময় পরেই তুমি মাদার’স ক্লাবের নতুন সদস্য হতে যাচ্ছো। আমার মুখের সামনে একটা পর্দা টেনে দেয়া হল। আমি তখনও জায়িফের কথা-ই ভেবে চলেছি। এসেই বলবে, “কী আর একটু দেরি করা গেলো না, তাই না?” ঘন্টা খানিক পরে একটা ফুটফুটে বাচ্চা আমার বাম পাশে আনা হলো। নার্স হাসি হাসি মুখে বাচ্চাটাকে আমার খুব কাছে এনে দেখালো। লাল কাপড়ে জড়ানো ছোট্ট একটা পুতুল। আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমি বাচ্চা কে ছুঁয়ে ওর কপলে ছোট্ট একটা আদার করতে গেলাম। ঠিক তখনই একটা হাত আমার হাতে উপরে। সেও বাচ্চাটাকে আদার করতে মুখ বাড়ালো। তারপরই পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
ঘুম ভেঙ্গে দেখি জায়িফ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হল, এই মানুষটা জীবনে না আসলে, জীবনের মানেটাই আমার জানা হতো না। অথচ কী নির্দ্বিধায়, সেদিন আমি ঠিক-ই করে ফেলেছিলাম, এই ছেলে কে বিয়ে, অসম্ভব!
২.
ইচ্ছে করেই বাসা থেকে দেরি করে বের হলাম। তাড়াহুড়ো করার তো কিছু নাই। সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা হলো, দেখা হবে না, তাই তো? আমার তো দেখা করতে বয়েই গেছে। নেহাত আম্মুর অনুরোধ, তাই সৌজন্যতা দেখাতেই হচ্ছে। না হলে আমি সানজিদা। আমি যেতাম দেখা করতে, দুঃখিত দেখা দিতে!
ধানমন্ডি ২৭ এর জিনডিয়ান এ পৌঁছে সিএনজি থেকে নেমেই হাত ঘড়িটা দেখে নিলাম। মাত্র ২৫ মিনিট দেরি করেছি। আজকে ঢাকায় হতে পারতো স্মরণকালের ইতিহাসের সবথেকে ভয়াবহ জ্যাম। ফোন কলে বলে দিতাম, “জায়িফ সাহেব, রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম, বসে থাকতে থাকতে আমার খুব মাথা ধরেছে। আজ আর দেখা হচ্ছে না। আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ”। না সেসব এর কিছু-ই হলো না। রাস্তা তো ভিভিআইপি দের জন্য ক্লিয়ার করে রাখা’র মতো ঝকঝকে! এসে যখন পড়েছি-ই, যা হোক একটা বিহিত করেই যাবো, ইনশাআল্লাহ।
মুল দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখি শ্রীমান দাঁড়িয়ে, হাসি হাসি মুখে অপেক্ষা করছেন। ডেনিমের সাথে আকাশী কালার এর শার্ট, হাতে খুব সুন্দর একটা ঘড়ি। সর্বনাশ! এই ছেলের তো রুচি ভালো। স্বভাবসুলভ হাসি দিলাম। ভদ্রতা করে বললাম
- দেরি করে ফেললাম?
- না, না ঠিক আছে। রাস্তায় জ্যাম ছিলো?
- নাহ, ইচ্ছে করে দেরি করেছি।
- আচ্ছা! আমরা কী ভিতরে বসতে পারি?
- জ্বী
ছেলে টা দরজা খুলে খুব সাবধানে ধরে দাড়ালো। আমি ঢোকার পরে ঢুকলো। না, পোলা তো দেখি ম্যানার জানে। এবার চেয়ার টেনে দিলো। এ তো দেখি শুধু জানে না, বেশ ভালো-ই জানে।
- মিস সানজিদা, এমনিতে ভালো আছেন তো?
- জ়্বি ভালো আছি। আপনি?
- কি! আমার নাম?
- নাহ, ওটা জানি। আপনি কেমন আছেন?
- ভাল আছি । আমরা কিছু খাবার অর্ডার করি? প্লেস যেহেতু আমার পছন্দে খাবারটা আপনি পছন্দ করেন প্লিজ।
- না,নাহ পাগল! আমার পছন্দ করা খাবার খেয়ে যা কেউ বাসায় গিয়ে গলায় হাত দিয়ে বমি করে। সরি। আপনি করেন। তবে সিজলিং বাদ দিয়ে, এই শব্দটা আমার খুব অপছন্দ!
- আর কি কি অপছন্দ?
- অনেক কিছু, একে একে বলবো?
- আপনি অবসরে কি করেন?
- বন্ধু স্থানীয়দের সাথে হাউকাউ করি।
- হাউকাউ!?
- হাউকাউ মানে হৈচৈ করি।
- আপনার কি অনেক বন্ধু।
- হ্যাঁ আছে তবে অনেক না। যারা আমার বন্ধু বা বন্ধু স্থানীয় তারা আমার খুব কাছের। কেন?
- আমার খুব বেশি বন্ধু নাই। খুব বেশি বলছি কেন, আমার তেমন কোনো বন্ধু-ই নাই। সারাজীবন প্রথম হবার রেস-এ থেকেছি। একসময় এমন ছিলো, প্রথম হবার জন্য আমি অমানুষিক ভাবে পরিশ্রম করেছি। আমার বন্ধু নাই এটা প্রথম ফিল করি, উচ্চশিক্ষার জন্য যখন বাইরে যাই তখন। পরিচিত কেউ আসেনি সি-অফ করতে। এসে কি বলতো বলেন। আমি তেমন কারোর কাছের মানুষ নই। তখন সব প্রথম হওয়া গুলো আমার কাছে মূল্যহীন লাগেছিল।
- মনে মনে বললাম, খু-উ-ব কৌশলে জানায় দিলেন আপনি প্রথম শ্রেনীতে প্রথম। অভিনন্দন। সময়ের অনুধাবন সময়ে করতে হয়। গান আছে “সময় গেলে সাধন হবে না”। মুখে বললাম, তাই নাকি? সো স্যাড।
তারপর মন দিয়ে রাস্তায় গাড়ি গুনতে শুরু করলাম। আমাকে দেখার এত ইচ্ছে, এবার শখ মিটিয়ে দেখেন। সুললিত ভাষায় স্ক্রিপ্ট পড়তে ইচ্ছে করছে না। এই লোক আগে থেকে নিশ্চয় এখানে বলে রেখেছে, “যাই অর্ডার করি, খাবার দিতে দেরি করবেন”।মহা ধুরন্ধর!
- আপনার কি গাড়ি অনেক পছন্দ?
- নাহ
- তাহলে সংখ্যা নির্নয় পছন্দ?
- নাহ। কেন?
- খুব মনোযোগ দিয়ে গাড়ি দেখছেন তাই বললাম। আপনি আন- কম্ফোর্টেবল ফিল করলে আজ থাকুক। আরেক দিন না হয়……
এই লোকের তো মতলব সুবিধার না। আরেক দিন মানে? কিসের আরেক দিন! অসম্ভব। রোজ রোজ এই প্যানা সহ্য করা যাবে না।
একে আজই বিদায় করতে হবে। আপনে প্রথম শ্রেনিতে প্রথম মানুষ, পরিপাটি এক মেয়ে বিয়ে করুন, সুখে থাকুন। আমারে মাফ করে দেন। আর ভালো লাগছিলো না।
কিন্তু এক্ষনি বাসায় গেলে, বজ্র সহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। আম্মু চিৎকার চেঁচামেচি করে বাসা মাথায় তুলবে।“ তোমার মেয়ে পেয়েছে কি? ধরা কে সরা জ্ঞান করছে। ছেলে স্টাবলিষ্ট, দেখতে শুনতে ভালো, ফ্যামিলি ভালো। ব্লা, ব্লা, ব্লা………………। তার থেকে এখানে বসে বসে গাড়ি গোনা অনেক ভালো।
- মিস সানজিদা, আমাদের মধ্যে তেমন কিছুই কমন না। আমাদের পড়াশুনোর ডিসিপ্লিনও আলাদা। আপনি চুপ করে থাকলে আমি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কি দয়া করে আমাকে একটু হেল্প করবেন। আচ্ছা ঠিক আছে, অন্তত প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করুন।
- আপনি আমাকে সানজিদা বলতে পারেন। মিস সানজিদা , মিস সানজিদা বার বার শুনে মনে হচ্ছে বোর্ড এর সামনে ভাইভা টেবিলে বসে আছি। শুধু সানজিদা বলুন।
- ঠিক আছে
- আপনার কি কিছু জানার আছে?
- নাহ
- নাহ কেন?
- জিজ্ঞেস করলেই আপনি সত্যি কথা বলবেন?
- শুরুতেই কাউকে অবিশ্বাস করতে নেই
- দেখুন জনাব জায়িফ, এই সব, মানে এই যে, এখন যেখানে আমি বসে আছি তার কোনো কিছুই আমার নিজের ইচ্ছেতে নয়। ইনফ্যাক্ট আমি এরকম নই। কিন্তু একের পর এক না বলতে বলতে আমি ক্লান্ত। আমার জীবন টা আমি কখনো এভাবে ভাবিনি। হৃদয় জয় না করে বিয়ে করাটা অন্যায়। একছাদের নিচে থাকার জন্য বিয়ে প্রথাটার প্রতি আমি একই সাথে বি্রক্ত এবং বিব্রত।
- আপনি মনে হয়, অনেক গল্পের বই পড়েন। মিস সানজিদা, আপনি ভাববেন না, আমার অসীম ধৈর্য। আপনি উষ্মা দেখাতে চান ভাল কথা। তবে এইভাবে নয়। আমিও ব্যস্ততা থেকে সময় বের করে এসেছি। তার মানে এই নয় যে, আপনার উপেক্ষা সারাটা দুপুর বসে বসে সহ্য করবো। বইয়ে্র ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড আর রিয়েল ওয়ার্ল্ডের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারলে পাঠক হিসেবে আপনি ব্যর্থ। বই মন দিয়ে পড়েন ভালো কথা, কিন্তু বইকে মন দিয়ে দেয়ার কিছু নেই। জ়ীবন, জীবন-ই। আশা করি সেটা বোঝার মতো বয়েস আপনার হয়েছে। আপনি স্পষ্টভাষী ঠিক আছে, তার মানে কি পুরো পৃথিবীকে প্রতিপক্ষ ভাবতে হবে? যাপনের জন্য জীবন টা অনেক দীর্ঘ।
- আপনার উপদেশ আমার মনে থাকবে। ধন্যবাদ। আজ তাহলে আসি।
- চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
- তার আর দরকার হবে না।
- হার্ট করার জন্য দুঃখিত। আমি সত্যি-ই অনেক দুঃখিত।
- আসি, ভালো থাকবেন।
ভীষণ অপমান বোধ করলাম। জ্ঞান দিবি দে, একটু সফট করেও তো দিতে পারতিস। ডাইকা নিয়ে অপমান। চোখে জল চলে আসছিল। রাগে আমার গা কাপছিলো। আমাকে অপমান করে, আমাকে! বাসায় এসে স্ট্রেইট বলে দিলাম, ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে। জায়িফ সাহেব এবার বুঝবেন “কত ধানে কত চাল”।
৩.
তিন দিন পরে আম্মু-ই খাবার টেবিলে দুঃসংবাদ টা দিলেন। জায়িফের বাবা মা এনগেজমেন্টের তারিখ জানতে চেয়েছেন। মাস খানিক এর মধ্যেই বিয়েটাও সেরে ফেলতে চান। সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেলো। এখন কী করবো! জ্ঞানীরা ঠিক-ই বলেন, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। এখন যদি মা কে বলি, “এই ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না” সিওর আমাকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পাঠিয়ে দিবেন। এখন………
যা বলার সেটা জায়িফ সাহেব কেই বলতে হবে। সোজা গিয়ে বলে দিবো, দেখেন আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই, স্পেশালি আপনাকে তো না-ই। কিন্তু কিভাবে। আচ্ছা, দেখা করে বলে দেই। কিভাবে মাকে গিয়ে দেখা করার কথা বলি! বেহায়া ছেলে কোথাকার। অপমান করে, আবার বাসায় গিয়ে বলে, মেয়ে পছন্দ হয়েছে।
- হ্যালো
- জায়িফ বলছিলাম, কেমন আছেন?
- ভালো না।
- কেন
- আপনাকে আমার কিছু বলার ছিলো
- আমারও
- দেখেন আমি বিয়ে করতে চাই না। কোনো ভাবেই না। ভেবেছিলাম আপনি “না” বলবেন। তাই কুবুদ্ধি করে আমি হ্যাঁ বলেছি। এখন প্লিজ আমাকে হেল্প করুন।
- মিস সানজিদা, আমিও অবাক হয়েছি। দু’টো মানুষ একই সাথে একই ভুল কিভাবে করে! তবে এখন কোন ভাবেই আমি না বলতে পারবো না। সেটা আর এখন সম্ভবও নয়। মা-বাবা বিয়ের কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছেন।
- সেগুলো যার সাথে আপনার বিয়ে হবে তাকে দিয়েন। সমস্যা সমাধান।
- দেখুন সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। আমি ইচ্ছে করে আপনাকে হার্ট করতে চাইনি।
- কিন্তু বাস্তবতা হলো সেটা করেছেন
- সেজন্য আমি সত্যিই অনেক দুঃখিত। প্লিজ
- ওকে ঠিক আছে আমার একটা শর্ত আছে। কোনো কিছুতেই আমাকে জোর করা যাবে না। আমার মর্জি কে আপনার গুরুত্ব দিতে হবে। রাজি?
- হ্যাঁ রাজি,
- কেন?
- আপনি বলেছেন তাই! এই মুহুর্তে কোনো ভাবেই বিয়ে ভাঙ্গা যাবে না।
- আপনি খুব বিরক্তিকর একটা মানুষ। ভালো থাকবেন।
- আপনিও ভালো থাকবেন।
এই লোকের সমস্যা কী? কোনো কিছুই আর নিয়ন্ত্রনে নাই। এবার থেকে তাহলে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আপনাকে যদি সারাজীবন না জ্বালিয়েছি, তবে আমার নামও সানজিদা না।
৪.
দেখেন সানজিদা, অবিবাহিত জীবনে আমার দেখা একমাত্র রোমান্টিক স্বপ্ন, “অফিস যাওয়ার আগে আমার বৌ টাই বেধে দিচ্ছে”। আপনি টাই বাধতে পারেন?
- মনে মনে বললাম ফাস দিতে পারি। মুখে কিছু না বলে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
- নাহ, বিরক্তি নিয়ে টাই বেধে দিলেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কারন আপনি তো তখন টাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, আমার দিকে নয়।
- গাধা তোর মাথা। রাগে আমার শরীর জ্বলতেছে। এই লোক তো কিছু বলা অর্থহীন। আমি বললাম, আমি বাসায় যেতে চাই।
- চলুন আপনাকে পৌছে দিয়ে আসি
- প্রয়োজন নেই
- আছে। বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আজকেও আপনি মন খারাপ করে একা বাসায় গেলে আন্টি বিষয়টা নিয়ে আপনাকে নানা প্রশ্ন করতে পারেন। যা হয়েছে সেটা আমাদের মধ্যে থাক। আমার অপরাধের শাস্তি আমি একাই পেতে চাই। অন্যদের কে বিব্রত করতে চাইনা। আশা করি আপনি আমার এই অনুরোধ টুকু অন্তত রাখবেন।
- অপরিচিতদের সাথে আমি রিকশায় উঠি না।
- আমি আপনার অপরিচিত! ঠিক আছে সিএনজি নিচ্ছি।
- না না। আপনার সাথে আমি সি এন জি তে যাবো না। ইচ্ছে করে হাতার অপর হাত রেখে ভাব ধরবেন, “আমি তো ইচ্ছে করে করিনি”।
- আরে সর্বোনাশ! আপনার মন এতো জটিল কেনো?
- মোটেও জটিল নয়। আমি আগে থেকেই সব বুঝতে পারি। সো আর কোনো আরগুমেন্টে যাবেন না প্লিজ। আমি একাই বাসায় ফিরবো।
- তাহলে আমাকে বাসায় দিয়ে আসবেন চলুন।
- কীঈঈঈঈঈঈঈঈঈ !
- না কিছু না, বলছিলাম একা যেতে পারবেন তো?
- হ্যা পারবো।
- ওকে তাহলে আল্লাহ হাফেজ।
-আল্লাহ হাফেজ।
এরকম মেজাজ নিয়েই শুরু হলো আমাদের 'যৌথ জীবন'!!
৫.
এনগেজমেন্টের তারিখ পড়লো ১২ মে। বাসার সবাই কেনাকাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ছোট বড় সবাইকে দেখে আমার কেবলই হিংসায় চোখে পানি চলে আসলো। কেউ কেন বুঝতে পারছে না। আমি বিয়ে করতে চাই না। আব্বু ব্যস্ত দাওয়াতের লিস্ট নিয়ে। আম্মু খাবারের মেন্যু নিয়ে, বোন শাড়ি আর পার্লার নিয়ে, ভাই ফুটফময়েশ নিয়ে। কেবল আমারই কিছু করার নেই। সারাদিন আমার কাটে মনখারাপের সাথে আর কুবুদ্ধি করে করে। আত্মীয় স্বজনের ফোন পেলেই আমার কান্না পাই। মনে হয় চিৎকার করে বলে দেই “আমি এই বিয়ে করতে চাই না”। শেষ ভরসা এখন আম্মু। তাকে গিয়ে বললামঃ
- আম্মু আমি বিয়ে করতে চাই না।
- ঠিক আছে কোরো না।
- তুমি জানতে চাওনা, “কেন”
- না চাইনা। তুমি তো কাউকেই নিজের যোগ্য বলে মনে করোনা। জীবন তোমার তুমি যা খুশি করতে পারো। তোমাকে পেটে ধরেছি বলে যা কর্তব্যজ্ঞান করেছি সেটা করার চেষ্টা করেছি। এখন তুমি যদি তোমার ব্যক্তি স্বাধীনতার যথেচ্ছা ব্যবহার করো, তবে আমার বলার কিছু নেই। তবে তুমি আরেকটু ভেবে আমাকে তোমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টা জানাও।
- আমি করে কেঁদে ফেললাম।
- আম্মু আমার মাথায় হাত রাখলেন। বিয়ে আগে সব মেয়েরই এমন লাগে। নতুন জীবন, নতুন মানুষ। ভয় ভয় লাগে। সাথে পুরোনো সব কিছু কে ছেড়ে যাবার বেদনা। দিনে দিনে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি দেখে নিও।
- কিচ্ছু ঠিক হবে না। আমার জীবনে কোনো কিছু ঠিক মতো হয় না।
আম্মু কিছু না বলে, চুপচাপ পাশে বসে থাকলো। চোখ মুছে দিয়ে বললেন, তুমি এরকম করলে আমার কষ্ট হয়না!
রেষ্টুরেন্টে বসে এনগেজমেন্ট আমার পছন্দ নয়। যা হবে বাসায় হবে। আমার আশৈশব স্মৃতিগুলোর সাথে হবে। সেই ইচ্ছে পুরোনে সব আয়োজন বাসায় হলো। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ মেহমানরা চলে আসলেন। আটটার দিকে আমার শাশুড়ী মা আমাকে একটা আংটি পড়িয়ে দিলেন। সাথে এটা ডালাতে লাল শাড়ী। আমাকে ভেতরে নিয়ে বসানো হলো, আমার শাশুড়ী মাও সাথে সাথে এসে আমার ঘরে বসলেল। বাসায় লোক গিজ গিজ অবস্থা। হঠাৎ বড় চাচার আবদার সবাই যখন আছে বিয়ে কেন নয়! ব্যস ভাই কে দিয়ে কাজী ডেকে আনানো হলো। কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। সবাই দিগুন উৎসাবে আনন্দ ছড়াচ্ছে। আমি কেবল লোকের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম কিংবা আলাদা হচ্ছিলাম।
আমার বিয়ে হয়ে গেল! ঠিক হলো দুই মাস পর অনুষ্ঠান করে আমাকে শ্বশুরবাড়ী নেয়া হবে।
৬.
আমি আমার মতো খাই দাই ঘুরি ফিরি। আর মনের খচ খচ টা অনুভব করি। আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে! তাতে আমার না দিন যাপনের পরিবর্তন হয়েছে, না রাত। আগের মতোই ভার্সিটি যাই, ক্লাস করি, নোট করি, পরীক্ষা দেই। আর মাঝে মধ্যে ফোনে টুকটাক তর্ক করি। জায়িফ সাহেব যা-ই বলেন, আমি রাকঢাক না করেই তার বিপরীত বলি। একদিন শ্বশুর-শাশুড়ী এসে চারটা থ্রিপিস দিয়ে গেলেন।অনেক মিষ্টি নিয়ে আসলেন। বিয়ের কেনাকাটা তে সাথে যেতে বললেন। আমি জানালাম, আপনারা আছেন তো। আপনারাই পছন্দ করে দিয়েন।
জুনের ৫ তারিখ। ভার্সিটি গ্রীষ্মকালীন বন্ধ দিয়ে দিয়েছে। আম্মু এসে জানালো, ৭ তারিখে স্বপরিবারে জায়িফ’রা সিলেট যাচ্ছে। শ্বশুর-শাশুড়ী আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে চান। আম্মু বলেছেন, মেয়েতো এখন আপনাদের। ও নিশ্চয় যাবে। আমি আম্মুকে বললাম, আমি নিশ্চয় যাবো সেটা তুমি জানো? আব্বু বললেন, এরকম করেনা মা। তাছাড়া তোমার তো এখন কোনো পরীক্ষা নেই। ওরা এত করে বললো, তাই তোমার মা রাজী হয়েছেন। আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত।
জায়িফ সাহেব যাই বলেছেন, আমি পড়াশুনার অজুহাতে এড়িয়ে গেছি। এক কাপ কফি খেতেও যায়নি। ভাব দেখিয়েছি, ঠিক ঐ সময়টাই আমি নোট করি। একদিন নোট না করলে শুধু মহাভারত নয়, পুরো পৃথিবী শুদ্ধু অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আর এখন! আম্মু-ই ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। আমাকে বেশ কিছু টাকাও দিলেন। বুঝিয়ে বললেন, মুখ গোমড়া করে বেড়াতে যেতে নেই। পরে আফসোস করবা। শুধু সেখানেই শেষ নয়; আমাকে বললেন, শ্বশুর-শাশুড়ীর সাথে যাচ্ছো শাড়ী পড়ে যাও। তারা খুশি হবেন। তুমি আমার লক্ষ্মী মেয়ে না!
নির্দিষ্ট দিনে সকাল আটটায় একটা নোয়া গাড়ী এসে থামলো আমাকে তুলে নিয়ে সবাই সিলেট যাবে। গাড়ী থেকে সবাই নামলেন। চা খেলেন। তারপর জায়িফ আমার ব্যাগ টা নিয়ে সবার পেছনে আর তার পেছনে আমি।
৭.
বিকেলে সিলেট পৌঁছে আমরা একটা কটেজে উঠলাম। ভীষন সুন্দর, চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। পরিবারের সবাই মিলে গল্প করতে করতে রাতের খাওয়া হলো। এরপর যে যার ঘরে। এখানে আমার জন্য কোনো ঘর নেই। মানে একটা রুম দেয়া হল আমাকে জায়িফের সাথে শেয়ার করার জন্য। আমি রুমে ঢুকেই চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে শুরু করলাম। জায়িফ জানতে চাইলো বাইরে যাবা? আমি বললাম নাহ, অনেক রাত হয়ে গেছে। তাছাড়া ক্লান্ত লাগছে। মোবাইলে আম্মুর সাথে কিছু সময় কথা হলো। জায়িফ বললো হাত মুখ ধুয়ে নাও ভালো লাগবে। আমি এই প্রথম বাধ্য মেয়ের মতো তার কথা রাখলাম। বের হয়ে মুখে ক্রিম মাখতে মাখতে শুনলাম, জায়িফ বলছে আমি একটু শাওয়ার নেই। দশ মিনিটেই হয়ে যাবে।
সারা ঘরে কোথাও কোনো কাথা নেই। আমি আবার কাথা ছাড়া ঘুমাতে পারি না। ব্যাগ খুলে দেখি আম্মু একটা কাথা দিয়ে দিয়েছেন। আমি আরাম করে কাথা গায়ে দিয়ে একটা বালিশ মাথায় আর পাশের টা কোলে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। অপরিচিত জায়গায় আমার হঠাৎ শীত শীত অনুভূত হতে লাগলো।
পাখির ডাকে চোখ খুলে দেখি জায়িফ সাহেব ইজি চেয়ারে শুয়ে আছেন। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘড়িতে সাড়ে ছয়টা। জায়িফ সাহেবও চোখ খুললেনঃ
- শুভ সকাল!
- আপনি রাতে ঘুমান নি?
- নাহ।চেষ্টা করে ছিলাম ঘুম আসেনি। বালিশ তো দুটোই তোমার দখলে ছিলো। আর বালিশ ছাড়া যে আমি ঘুমাতে পারি না।
- আপনি তাহলে আমাকে ডাকেন নি কেন?
- আরেহ এক রাত না ঘুমালে কী হয়।
- আপনি আমাকে ডাকেন নাই কেন?
- তুমি খুব আরাম করে ঘুমাচ্ছিলে, ডাকলে বিব্রত হতে। তাছাড়া তুমি যে অনিচ্ছা নিয়ে এসেছো, আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি।
এই প্রথম নিজের আচরনে আমি ভীষণ লজ্জ্বিত হলাম। পূর্বাপর না ভেবে ছুটে গিয়ে জায়িফ সাহেব কে জড়িয়ে ধরলাম। আমার খুব কষ্ট হতে লাগলো। আমি এমন করছি কেন! “আই এ্যাম সরি, আমি ইচ্ছে করে এটা করিনি”। জায়িফ খুব আলতো করে আমার পিঠে হাত রাখলো। আমার মাথায় গাল রাখলো। আমি খুব শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
এবং তারপরই মনে হলো, এটা আমি কী করলাম! কেন জড়িয়ে ধরতে গেলাম। ভীষণ লজ্জা হচ্ছিলো। আমি এখন জায়িফ এর দিকে কিভাবে তাকাবো। এমত অবস্থায় ধরে থাকা যতটা লজ্জার, ছেড়ে দেয়া তার থেকেও বেশি লজ্জার। আমি গাধার মতো ছেড়ে দিয়ে জায়িফের দিকে তাকালাম। আর ঠিক তখন-ই জায়িফ পৃথিবীর সব কিছু থামিয়ে দিলো।
৮.
আমার বাড়ী পরিবর্তন হয়ে গেলো। নতুন জীবন চলতে শুরু করলো পুরোনো রুটিনে। জায়িফ থাকে তার কর্মস্থলে। ছুটি ছাটাতে আসে। আমি সেই লেখাপড়াতে ব্যস্ত। কখনো আম্মুর বাসায়, তো কখনো শাশুড়ী মার বাসায়।
জায়িফ আসলে সারা ঢাকা দু’জনে মিলে টই টই করে ঘুরি। এখনো রিকশা নিলেই জায়িফ খ্যাপায়, “অপরিচিতের সাথে এক রিকশায় ওঠা যাবে তো!” আমিও লজ্জায় বেগুনি হয়ে যাই। জায়িফ রিকশায় উঠে খুব শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখে।
হঠাৎ একটা পরিবর্তন অনুভব করলাম। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফার্মেসী থেকে স্ট্রিপ কিনে উইরিন পরীক্ষা করলাম। যা ভেবেছিলাম তাই হলো। মুঠোফোনে ডাক পাঠালামঃ
- হ্যালো কী অবস্থা
- কোনো ভনিতা না করেই বললাম, তুমি কি আগামীকাল ঢাকা আসতে পারবা?
- কোনো বিশেষ কিছু?
- হ্যাঁ
- এখন বলো
- না ফোনে বলা যাবে না। তুমি আসো।
- আচ্ছা
আমি আম্মুর বাসায় ছিলাম। জায়িফ পরের দিন সোজা আম্মুর বাসায় চলে আসলো। ওর মুখটা ভীষণ চিন্তিত দেখালো। আমিও এখন পর্যন্ত কাউকে কিছু জানায় নি। আম্মুর বাসা থেকে সাধারনত জায়িফ এলে আমি ওর সাথে একসাথে বাসায় যাই। জায়িফ এসে খেয়ে আমাকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বেরলো। রিকশা্য উঠে সে আমার হাত ধরতে ভুলে গেলো। আমিই নিজে জায়িফের হাত বেশ শক্ত করে ধরে বসে রইলাম। টেনশন কাকে বলে, জায়িফ কে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। “ টেনশন কত প্রকার ও কি কি”
রাত দুজন মুখোমুখি বসলাম।
- আমি তোমাকে একটা সংবাদ দিতে চাই
- সেটা শোনার জন্যই আমি তিনশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঢাকায়।
- আমার মনে হচ্ছে, না শুধু মনে হচ্ছে না, আমি মোটামুটি নিশ্চিত “তুমি বাবা হতে চলেছো”।
- কী!!!!
- তুমি বাবা হতে চলেছো
- কিভাবে!
- কিভাবে মানে!!! ফাজিল ছেলে!
আমি এখনো কাউকে কিছু জানাইনি। আরো কিছু টেষ্ট করিয়ে নিশ্চিত হতে চাই। আরো একটা নির্ঘুম রাত। একটু পর পর জায়িফ বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করতে লাগলো, সত্যি আমরা বাবা-মা হবো। এটা কি সত্যি! আচ্ছা আমাদের ছেলে হবে নাকি মেয়ে! যাই হোক, সে যেন আমার মতো ধৈর্য্যশীল হয়। তোমার যা মেজাজ। কি, তুমি শুধু আমার মেজাজ টাই দেখলা! এ অবস্থায় রাগান্বিত হওয়াটা ঠিক না মিসেস জায়িফ।
এরপরের নয় মাস একটা ছোট্ট পুতুল আমার ভেতরে বেড়ে উঠলো। জায়িফ পোষ্টিং নিয়ে ঢাকায় এল। প্রতিদিন-ই তার সেকি উত্তেজনা। আমি লেখাপড়ার পাঠ চুকালাম। কিছুদিন বিরতি দিয়ে চাকরী খুঁজবো। শেষ দুই মাস আম্মুর বাসায় স্থায়ী হলাম। ডাক্তার ম্যাডামের পরামর্শে বেড রেষ্টে গেলাম।
আমাদের প্রথম সন্তান আজ পৃথিবীতে আসবে। ভীষণ প্রতীক্ষিত এই দিনটিতেই জায়িফ কে দূরে যেতে হলো। ডাক্তার ম্যাডামের দেয়া তারিখ অনুযায়ী আরো ১০ দিন পরে ওর পৃথিবীতে আসার কথা। বাবা সোনাটা একটু আগে চলে আসতে চাইছে মা-বাবার কোল আলো করে। সকালেই শরীরটা খারাপ লাগছিল। সবধরনের অনুভূতি থেকে একেবারেই আলাদা। আম্মুকে জানাতেই আম্মু ছুটে গিয়ে শাশুড়ি মাকে ফোন দিলেন। ডাক্তার ম্যাডামের সাথে কথা বললেন। আর তারপর ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে রেডি করে সোজা হসপিটালে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে শুনলাম বিকাল পাঁচটা নাগাদ আমাকে অপারেশন টেবিলে শুতে হবে। অথচ কথা ছিলো, জায়িফ আমার পাশে থাকবে, আমার হাত ধরে থাকবে, প্রসব বেদনার ভাগ নিবে। জায়িফ এই সময়ে মালয়শিয়া তে। অফিসের কাজে। ও যেতে চাইনি আমি-ই বলেছিলাম তুমি ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরে বাচ্চা হবে, নিশ্চিন্তে যাও তো। অথচ এখন, আমার কেবল-ই কান্না পাচ্ছে।
!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১২:২৯