প্রথমে টিভি পর্দায় পণ্যটির সাথে পরিচিত হই। তারপর দৈনিক সংবাদ পত্রের ৮কলামের বিজ্ঞাপন আমাকে বিষয়টা নজরে নিতে বাধ্য করে। আর তারপর ঢাকার অভিজাত এলাকার এক বিলবোর্ডে চোখ আটকে গেল। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পাশেই। বিজ্ঞাপনটা আই-পিলের। মানে ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টরি পিলের।
টিভি বিজ্ঞাপন বলছে, “নাহ, এখনি না! এমন সুন্দর স্বপ্ন গুলোকে এক মূহুর্তের অসাবধানতায় মুছে যেতে দেবো না”। নোরিক্স, যখন আপনি রেডি নন। কিংবা হঠাৎ করে এমন ভুল হতেই পারে, আর সেই ভুল শুধরানোর জন্য পিউলি। পাঁচ দিনের মধ্যে একটা পিল খেয়ে নিলেই অনাকাক্ষিত প্রেগনেন্সি ঝুঁকি আর থাকবেনা। পিউলি পাঁচ দিন পর্যন্ত কার্যকর ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টরি পিল।
কিছু পিল ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এবং কিছু পিল ৭২ ঘন্টার মধ্যে একটি গ্রহন করলে অনাকাক্ষিত প্রেগনেন্সি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এবোর্শন থেকে প্রেগনেন্সি প্রতিরোধ করা সহজ তাই নয়-কি?
আধুনিক সভ্যতা তো অসতর্কতার অভিশাপ বহন করে বেড়াতে বাধ্য করায় না। এমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিলকে অনেকে মর্নিং আফটার পিলও বলে থাকেন। পোস্ট কয়টাল বা সঙ্গম পরবর্তী কিংবা মর্নিং আফটার বা পরদিনের- যে নামেই ডাকা হোক অরক্ষিত সেক্সের পর দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল এখন বেশ ভালো মাত্রায় ভোক্তাপ্রিয়তা পেয়েছে। সবথেকে বেশি- ক্রেতা মেয়েরা যাদের বয়স ১৫-৩০ বছরের মধ্যে। গ্রাম শহর দুই জা্যগাতেই এই পিল সমান জনপ্রিয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ঔষধের দোকান থেকে যে কেউ এই পিল সংগ্রহ করতে পারেন। একে ঔষধ ব্যবসার ভাষায় বলে, “ওভার দ্য কাউন্টার প্রোডাক্ট বা ওটিসি”। একটা ঔষধ ওটিসি হওয়ার জন্য তাকে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়ঃ
ঔষধটি নিরাপদ
ঔষধটি কার্যকর
সহজে প্রয়োগ যোগ্য
১৯৭৪ সালে ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপসন এর জন্য পিল পদ্ধতির প্রথম প্রচলন করেন ডা. আ্যালবার্ট উজপি। তখন সঙ্গমের ৭২ ঘন্টার মধ্যে বাজার-চলতি কন্ট্রাসেপটিভ পিল একসঙ্গে চারটে খেয়ে নিতে হতো, তার ১২ ঘন্টা পর খেতে হতো আরো চারটা। ১৯৯৮ সালে ‘প্রিভেন’ নামে প্রথম আধুনিক ইনার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল বাজারজাত করা হয়।
আধুনিক যে কন্ট্রাসেপটিভ পিল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোতে পিলের মতো ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরন উভয় হরমোন না রেখে একটু বেশি ডোজের লিভোনর্জেস্ট্রেল নামে এক প্রোজেস্টেরন হরমোন রাখা হয়েছে। এই শতকের শুরু দিকেও ০.৭৫ মিলিগ্রামের দুটি ট্যাবলেট এক পাতায় পাওয়া যেত। অরক্ষিত যৌন সঙ্গমের পর যত দ্রুত সম্ভব একটি ট্যাবলেট খেতে হতো, এবং তার ১২ ঘন্টা পর খেতে হতো দ্বিতীয়টি। পুরো ডোজ শেষ করতে হতো ৭২ ঘন্টার মধ্যে। পরে দেখা গেল, ৭২ ঘন্টার মধ্যে দুটি ট্যাবলেট এক সঙ্গে খেয়ে নলেও একই ফলাফল পাওয়া যায়। তখন থেকে চালু হল ১.৫ মিলিগ্রামের একটি ট্যাবলেটের প্যাক।
অসাবধানী সঙ্গমের পর গর্ভসঞ্চারের আশংকা ১০০ জনের মধ্যে ৮টি। ডা. উজপি-র নিয়মে পিল খেলে সেই হার নেমে আসে ২ এর কাছাকাছি। আর আধুনিক ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল খেলে সে আশংকা আরও কমে হচ্ছে ১.১ শতাংশ। সমীক্ষা বলছে, প্রথম ১২ ঘন্টার মধ্যে ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ খেলে সাফল্যের হার পিল ৯৫ শতাংশ। ৬১ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে খেলে তা কমে দাঁড়াচ্ছে ৪৭ শতাংশে। তবে বিজ্ঞাপন বলছে মিলনের পাঁচ দিনের মাথায় খেলেও লিভোনর্জেস্ট্রেল ট্যাবলেট কাজ করে থাকে।
আই –পিলের মার্কেটিং এট্রাটেজিঃ
দাম কমে যাওয়ায় কারনে কিনা জানি না তবে এই পিল এখন দারুন জনপ্রিয়। শুরুতে এত সুলভ মূল্য ছিলো না। তিন বছর আগেও ছিল এক্সপেন্সিভ। মার্কেটিং এট্রাটেজি কারনে এর বিজ্ঞাপন এর বিলবোর্ড যত্রতত্র বসানো হচ্ছে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাই এর মূল ভোক্তা। নূন্যতম শিক্ষা থাকলে তার এই পিল খাওয়ার কথা না। ফ্রি সেক্সের যুগে ইমোশনালি অনেকে জড়িয়ে পড়ে। তখন সব ক্ষেত্রে প্রিকর্শন থাকে না। এবং এই ধরনের পিলের যোগান থাকার কারনে অনেক নির্দ্বিধায় পিল খাচ্ছেন। কিন্তু কত বার খেতে পারবেন এমন কোন তথ্য বিজ্ঞাপনে থাকে না।
যেমন নিচের এই অংশটুকু একটা অনলাইন বিজ্ঞাপন থেকে নেয়া
কখন ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টরি পিল ব্যবহার করবেন?
অরক্ষিত সহবাসের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই জন্মনিরোধক ব্যবহার করতে হবে। তবে সহবাসের ১২০ ঘন্টার পরে নয় এবং নিন্ম লিখিত কারনে ইমার্জেন্সি জন্মনিরোধক ব্যবহার করা বাঞ্চনীয়
- সহবাসের সময় আপনি বা আপনার সঙ্গী যদি কোন জন্মনিরোধক পদ্ধিতি ব্যবহার না করে
- যদি আপনি পরপর ৫ দিন জন্মনিরোধক বড়ি খেতে ভুলে যান (এ ক্ষেত্রে আপনি জন্মনিরোধক বড়ি তথ্যসমৃদ্ধ লিফলেট পড়ুন)
- যদি সহবাসের সময় আপনার সঙ্গী কনডম সঠিক ভাবে ব্যবহার না করে থাকেন, অথবা কনডম ফেটে গিয়ে থাকে
- যদি আপনি মনে করেন যে, আপনার জরায়ুতে অবস্থিত জন্মনিরোধক (আই, ইউ, ডি) স্থান্যচুত হয়েছে
- যদি আপনের যোনিতে অবস্থিত ডায়াফ্রোম অথবা জন্ম নিরোধক ক্যাপ সরানো হয়ে থাকে
- যদি আপনি মনে করেন যে, অকার্যকর হয়েছে এবং অনুসরন করাকালীন সময়ে যদি সহবাস করে থাকেন এবং ধর্ষণ জনিত অবস্থায়
কখন কোন বয়সে পিল খাওয়া যাবে, শাররীক অসুখ থাকলে কী করতে হবে সে ধরনের কোন পরামর্শ নেই। এমন কী ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার কথাও উল্লেখ নেই বিজ্ঞাপনে।
বাংলাদেশে যেসব ব্রান্ডের ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছেঃ
এমকন-১, (রেনেটা) মূল্য- ৬০টাকা-
নরফিল-১, তুলিপ (স্কয়ার) মূল্য- ৭০টাকা
তুলিপ (স্কয়ার) মূল্য- ৪৮৫ টাকা
পিউলি-১(জিসকা)মূল্য- ১৯৫টাকা
নোরিক্স (এসএমসি)মূল্য-৩০টাকা
আই-পিল (ইন্ডিয়ান)মূল্য-১৩০টাকা
ক্ষতিকারক দিক গুলো কি কি-
ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ২০ ভাগ নারীর গা গুলায় এবং ৫ ভাগ নারীর বমি হয়। এছাড়াও সাময়িক মাথা ঘোরা, মাথা দপদপ করা, স্তন ভারি হওয়া এবং ব্যাথা করা, ক্লান্তি ভাব আসতে পারে। জ্বর, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, খিচুনি মতো ওঠা, খাবারে অরুচি হতে পারে। প্রচুর ব্লিডিং হতে পারে। ক্র্যাম্প ধরার সমস্যায় ভুগতে পারেন। এমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিলের ফলে আপনার পিরিয়ড সাইকেল অনিয়মিত হতে পারে। এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার যে, এমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল কিন্তু অ্যাবরশন করায় না। শুধু ওভিউলেশন পিছিয়ে দিয়ে প্রেগন্যান্সি রুখতে পারে। তাই গর্ভধারণের পর এই পিল খেলে কোনও লাভ হবে না। কোনো কারণে ভ্রুণটা নষ্ট না হলে অসুস্থ এবং অপরিনত শিশু জন্ম নিতে পারে। এমার্জেন্সি কন্ট্রসেপটিভ পিলের ব্যবহার কিন্তু মুড়ি মুড়কির মতো করা উচিত নয়। যথেচ্চ অসুরক্ষিত সেক্স, তারপর যখন তখন এমার্জেন্সি পিল কিন্তু অত্যন্ত ক্ষতিকারক। অনেক সময়ই নিশ্চিত হতে না পেরে, কেউ কেউ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খেয়ে ফেলেন এই পিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর গোটা বিশ্বে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লক্ষ অ্যাবরশন করানো হয়। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃ্তীয়াংশ করানো হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে- প্রায় পুরোটাই হয় উন্নয়নশীল দেশে। এর ফলে অন্তত ৭৮,০০০ হাজার মহিলার মৃত্যু হয়। এবং আরো বিপুল সংখ্যক মহিলা স্থায়ী কিছু না কিছু সমস্যা নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে বাধ্য হন। সেদিক থেকে বিচার করলে ইমারজেন্সি কন্ট্রসেপটিভ পিল এর পক্ষে যাদের মত তারা বলতে পারেন যে, এই পিল গর্ভপাত ঘটায় না, গর্ভ সঞ্চার প্রতিরোধ করে। সে বিষয়ের আলোচনাটা আরেক দিনের জন্য তোলা রইলো। তবে এই সময়ে সবথেকে বেশি প্রয়োজন সেক্স এডুকেশন।
ইমারজেন্সি কন্ট্রাসেপ্টরি পিল এর উপর ভরসা করে ফ্রি সেক্স এর আনন্দে গা ভাসানোর আগে একটু ধৈর্য ধরে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য জেনে রাখুন, এই পিল আপনাকে প্রেগনেন্সি থেকে নিরাপদ রাখতে পারবে, তবে এইচআইভি, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস সি জাতীয় ভয়ংকর রোগগুলির সম্ভাবনার কথা ভুলে যাবেন না প্লিজ!!