২২ বছর বয়সে রূপালি জগতে পদার্পন করা সালমান শাহ’র যবনিকা পর্বেরও আজ ২২বছর পূর্ণ হলো। সালমান শাহ! একজন কমনম্যানের ক্রমশ তারকা হয়ে ওঠার গল্প। গল্পটা সংক্ষিপ্ত, অসমাপ্ত এবং অমিমাংসীত। শোবিজে কাজ করার ইচ্ছেটা অনেক দিনের হলেও সুযোগ হচ্ছিল না। বড় পর্দায় কাজ করার অভিজ্ঞতাটা হয় কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির মহরতের মধ্যে দিয়ে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৩তে। প্রথম বছর যেতে না যেতেই তিনি ঢালিউডের প্রথমশ্রেনীর নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী! শ্যুটিং-এ যাবার সময় সালমান শাহের সাথে ব্যক্তিগত একটি ব্রিফকেস থাকত সবসময়। যার উপর লেখা ছিলো ‘সালমান, দ্যা শ্যাডো অব ইমন’। তাতে থাকতো শিডিউলের সব কাগজপত্র এবং ডায়েরি। মানুষ ও নায়ক, সালমান শাহ’র দ্বৈতসত্তা। তার জন্ম, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা, সামিরার সাথে প্রেম-বিয়ে, শাবনূরের সাথে সম্পর্ক রহস্য, তারকা খ্যাতি, অতঃপর অমিমাংসীত মৃত্যু। শালমান শাহ’র মৃত্যু কোন নায়কের মৃত্যু নয়, ব্যক্তির মৃত্যু। তাই তো নায়ক হয়েও পর্দার সালমান অম্লান হয়ে রয়ে গেছেন দর্শকের হৃদয়ে।
এপর্যন্ত বাংলাদেশি সবথেকে ব্যবসফল ১০টি চলচ্চিত্রের তিনটির নায়ক সালমানকে যুবরাজ বলতে দ্বিতীয়বার ভাববার কোনো কারণ নেই। জনপ্রিয় এই নায়কের স্বপ্নের ঠিকানা, সত্যের মৃত্যু নেই এবং কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবি তিনটি রয়েছে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের তালিকাতে। নায়ক রাজরাজ্জাকের পর, পরিচালকগন সালমানের উপর ভরসা করেছেন সবচেয়ে বেশি। ৯০’র দশক সময়টা ছিলো নতুনদের আগমনের স্বর্নসময়। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দুই সফল নায়ক রাজ্জাক এবং জাফর ইকবালের ঠিক উত্তরসূরি তিনি নন। সালমান শাহের অভিনয়ের মধ্যে ছিল নিজস্বধারা। চার বছরের অভিনয় জীবনে কাজ করেছেন ২৭টি চলচ্চিত্রে। সালমানের দর্শকপ্রিয়তা তার সমসাময়িক নায়কদের তুলনায় বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিলো। সদ্য রুপালি পর্দায় অভিষেক ঘটা সালমান পর্দা থেকে বেরিয়ে হয়ে উঠেছিলেন কোটি তরুণের স্বপ্নের নায়ক। হয়ে উঠেছিলেন নব্বইদশকের একচ্ছত্র নায়ক। অধিনায়ক বললেও বাড়াবাড়ি হবে না বোধকরি। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে করেছিলেন সিনেমা হল মুখি।ক ঢালিউডের নামীদামি পরিচালক-প্রযোজকরা তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে জন্ম নিল রোমান্টিক-প্রতিবাদী যুবক। যিনি কেবল চরিত্র চিত্রণেই নয়, বয়সেও তরুন। রোমান্টিক-এ্যাকশান ঘরানার নায়কের জন্য দর্শকদের অপেক্ষার সময়টাতে তার আগমন। রোমান্টিক এ্যাকশান হিরোর ‘লাভার বয় ইমেজ’ এর সাথে রাজনীতি সচেতন ছাত্র নেতা। যিনি লড়েছেন ন্যায়ের পক্ষে, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর অধিকার আদায়ে। এভাবে পেয়ে যান দর্শকমহলে সর্বস্তরের গ্রহণযোগ্যতা।
ফ্যাশন সচেতন হিসেবে সালমানের সুনাম ছিলো বরাবর। গতানুগতিক পোশাক আর পরচুলা পরিহিত চলচ্চিত্র অভিনেতাদের পাশে চরিত্রানুগ গেট-আপের সালমানকে দর্শকপ্রিয়তা এনে দেয় তার সাবলীল প্রাণবন্ত অভিনয়। ফ্যাশন বিষয়টা অনেকখানি অনুশীলনের ব্যাপার। যেটা শেষ অব্দি ধরে রেখেছিলেন তিনি। অর্থহীন চিত্রনাট্য, বাজে মেকিং মধ্যবিত্ত দর্শকদেরকে যখন হল বিমুখ করে তোলে। ঠিক সেই সময়টাতেই সালমানকে তৈরি করেছে আমাদের কনজিউমার প্রণোদিত সোসাইটি। পুঁজিবাদের চক্রবূহ্য ঢুকে পড়ে সালমান। এটাই বোধহয় সালমানের সাফল্যের ট্রাজেডি! মডেলিং থেকে বড় পর্দার জার্নিটা বেশ গুরুত্বপূর্ন। সালমানের ছবি যদি কেউ ধারাবাহিক ভাবে দেখেন তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন তার অভিনয় শৈলীতে অগ্রজদের অনুকরন ছিলনা। তিনি দর্শকের চাহিদার স্তরকে মেনেই নিজস্ব স্টাইল চালু করেছিলেন। একই সাথে বাস্তবের সাধারণ মানুষ এবং কল্পনার আকাংক্ষাগুলো পুরোনের আনন্দদান করেছেন তিনি। সীমারেখা ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন অভিনয়ের মাধ্যমে। সালমান এক সামাজিক চরিত্র। কারোর প্রেমিক, কারোর ভাই, কারোর ছেলে, কারোর বব্ধু। সালমানের চরিত্র চিত্রণের মধ্যে দর্শকের আইডেন্টিফিকেশন হয়।
সালমানের দ্যুতির কাছে অনেক প্রতিষ্ঠিত নায়ক কিংবা অভিনেতাই কোথাও ম্লান হয়েছেন, কোথাও মিলিয়ে গেছেন। বানিজ্যিক অংকের হিসেবটা ব্যবসার টেবিলে হলেও জনপ্রতিয়তার দেখা মেলে প্রকাশ্যে। প্রতিটি হাউস ফুল শোতে এবং সেই সময়ের সংবাদপত্রে উঠে আসা সংবাদে। যেখনে টিকিট কালোবাজারী এবং টিকিট না পেয়ে হলের সামনে ভক্তদের উষ্মা প্রকাশের সংবাদে। প্রত্যেকটি ছবি নিয়ে আলাদা করে ভাবতেন তিনি। তৈরি নিয়েছিলেন রোমান্টিকতায় নিজস্ব ধারা। যে কারনে তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন দর্শকদের প্রিয় নায়ক। সালমান শাহ এবং কেয়ামত থেকে কেয়ামত একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ে সূত্রে পৌঁছে যান শহর-মফস্বল থেকে গ্রামে।
ভবিষ্যতহীন কিছু ছবির সাথে নিজের নাম জড়ানোর ইচ্ছে না থকলেও অনেক পরিচালক কিংবা প্রযোজকের অনুরোধে বেশ কিছু কাজ করতে হয় তাকে। কেননা তখন সালমান মানেই দর্শকপ্রিয়তায় অব্যর্থ সাফল্য। ‘ভালো ছবি’ এবং ‘জনপ্রিয় ছবি’ এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সব ভালো ছবি জনপ্রিয় হয় না। আবার সব জনপ্রিয় ছবি ভালো ছবি নাও হতে পারে। সালমান ছিলেন জনপ্রিয় তারকা। খারাপ সময় কখনোই পিছু ছাড়েনি এই তারকার। কখনো রোড এক্সিসিডেন্ট, শ্যুটিং করতে গিয়ে আহত হয়েছেন। আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সালমান “শেষ ঠিকানা” নামের একটি চলচ্চিত্রের শুটিং চলাকালে সালমান আহত হন। চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয় ধানমন্ডির নাজ ক্লিনিকে।, কখনো ঈর্ষার কিংবা প্রতিহিংসায় বলি হয়েছেন। সমস্যায় পড়েছেন যেমন, সমস্যা কাটিয়ে ওঠার মনোবলও তার ছিলো।
২৬ বছরের স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবন দিয়েই সালমান চিরদিন দর্শকদের কাছে তরুনদের জয়গানের নায়ক হয়ে রয়ে গেছেন। “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” যেখান থেকে শুরু হয় এক স্বাপ্নিক অধ্যায়ের। পরিচিত হয়েছিলেন গণমানুষের সাথে। প্রথম সিনেমাতেই তারুন্যের দেখা পেয়ে যায় দর্শক। তারুণ্যের প্রাণটা তার মধ্যে ছিলো। মন জয় করে নিয়েছিলেন দর্শকের। তৈরি করে নিয়েছিলেন অনেক দূর যাবার পথ। গ্রহণযোগ্য হতে শুরু করেছিলেন সবশ্রেনীর দর্শকের কাছে। দর্শক-ই একজন অভিনেতাকে তারকা বানায়। তাই দর্শকের কাছে গ্রহনযোগ্য ও জনপ্রিয় হতে শহুরে এবং গ্রাম্য সব ধরনের চরিত্রেই কাজ করেছেন তিনি। দর্শককে ড্রয়িংরুম থেকে টেনে এনেছিলেন সিনেমা হলে। দর্শক টানার ক্ষমতা সবার থাকে না। গতানুগতি ভাবে নয় বরং সচেতন এক্সপ্রেশন আর সাবলীল অভিনয় তাকে স্বকীয় করে তুলেছিল। পূরন করতে পেরেছিলেন দর্শকের প্রত্যাশা। অনবদ্য অভিনয় দিয়ে রাজত্ব করেছেন নিজের সময়টাতে। হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী।
চরিত্র অনুযায়ী তৈরি করে নিতেন নিজেকে। নিটোল প্রেমের ছবিই করেছেন বেশি। ছবিতে বিদেশি লোকেশনে গান চিত্রায়িত হতো না। তবুও একের পর এক সুপার হিট ছবি উপহার দিয়েছেন। জনপ্রিয়তার কল্যানে উতরে গেছেন সীমাবদ্ধতা গুলো। ভাল গল্প, চিত্রনাট্য কিংবা সংলাপের অভাব হয়তো ছিলো তবে অভিনয় গুনে এবং জনপ্রিয়তার কারনে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। কারো কারো অভিমত ছিলো এমন যে, সালমানের মৃত্যু চলচ্চিত্র শিল্পের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটালো। তারকাদেরকে নিয়ে দর্শকরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করেন। তাদের সম্পর্কে কৌতুহল মেটাতে স্মরনাপন্ন হন গণমাধ্যমের। তাই তো সিনেম্যগাজিনের প্রচ্ছদ কাহিনি লেখা হয় তারকাদের নিয়ে। ফলে শুধু পর্দার নায়ক নন, তারকারা সোস্যাল আইকনও হয়ে ওঠেন। সালমান শাহকে পর্দার ভেতরে এবং বাইরে, বিশেষ করে তার অনাকাংক্ষিত মৃত্যু নিয়ে অনেক গল্প কিংবা উপকথা তৈরি হয়েছে। এবং এখনপর্যন্ত দর্শক তাকে স্মরণ রেখেছেন। সালমান-ই একমাত্র বাংলাদেশী নায়ক, যাকে নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২৩ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন করে।
সালমান শাহ মুলত ব্যানিজ্যিক সাফল্যের নাম। তার ঝুলিতে রয়েছে বেশ কিছু ব্যবসা সফল ছবি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন তুরুপের তাস। ছবিতে নায়িকাদের ভূমিকা নেহাতই চরিত্রাভিনয়। পারিশ্রমিক ক্রমশ উর্দ্ধমুখি হচ্ছিল। নব্বই দশকের মধ্যবর্তী সময়ে একমাত্র সালমানের-ই ছিলো ম্যাজ়িক টাচ, যা দিয়ে লগ্নির টাকা উঠে আসে দ্রুত। লাভের মুখ দেখেন প্রযোজকরা। ১৯৯৪ সালের ১৬ নভেম্বর সংখ্যা সাপ্তাহিক ‘পূর্নিমা’ইয় প্রকাশিত হয় চমক সৃষ্টিকরা আলোচিত কাভারস্টোরি ‘তেইশ বছরের সালমানকে ঘিরে বাইশ কোটি টাকা বিনিয়োগ’। দর্শকদের রুচির একটা পরিবর্তন আসছিলো এ সময়। প্রতিবাদী রোমান্টিক নায়কের ভুমিকাতেই শুধু নয় সালমানে অভিনীত চরিত্রগুলোতে বৈচিত্র্য খুঁজে পান দর্শক। তারকাদের প্রতি দর্শকদের স্বপ্ন, সম্ভাবনা এবং প্রত্যাশার পারদ উর্ধ্বমুখি থাকে। সালমান হয়ে উঠেছিলেন ফ্যাক্ট থেকে ফ্যাক্টর। ফ্যাক্ট ছিলো সালমান সুদর্শন ছিলেন। স্মার্টনেসটা ছিলো। নাচ-গান-অ্যাকশানে হয়ে উঠেছিলেন পারদর্শী। কাজ করেছেন সেই সময়ের আধুনিক এবং সফল পরিচালকদের সাথে। দর্শকের ধরনে ভিন্নতা থাকে বলে অভিনেতাদের গ্রহনযোগ্যতা পেতেও সময় লাগে। সুপারস্টার যেমন দর্শক তৈরি করে, দর্শকও তেমনি সুপারস্টার বানায়।
সালমানের অন্তর্ধানের ২১ বছর পরের তিনি দর্শকের হৃদয়ে অনস্বীকার্য উপস্থিত। অন্তত দর্শকের নিরন্তর অভাব বোধের মধ্যে তিনি হৃদয়জন হয়ে রয়েছেন। এখনো প্রায়শই টিভি পর্দায় তার অভিনীত সিনেমা প্রচারিত হলে দর্শক রিমোটে হাত রাখেন না। এখনো পত্রিকার মলাটে তার ছবি থাকলে পথচারী হাঁটতে হাঁটতে থেমে যান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অনেকেই বলেন রাজ্জাকের মতো জনপ্রিয় না হলেও সাম্প্রতিক কালের জনপ্রতি তারকাদের মধ্যে সালমানের নাম শুরুর দিকে থাকে। তিনি অনেক ব্যবসাসফল কিংবা হিট চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। এবং তার প্রতি ৯০ দশকের দর্শকই শুধু নয় তার পরবর্তী দর্শকদেরও অগাধ ভালোবাসা প্রকাশ আমরা গণমাধ্যমে দেখি। সালমান শাহর জন্ম এবং মৃত্যুদিনে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়াতে অনেক লেখালিখিতেই বোঝা যায় যে, সেই ভালোবাসা এখনো অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের একসময়ের রোমান্টিক সম্রাট আজও বেঁচে আছেন দর্শকের মনোজগতে। জেগে আছেন তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে, তর্কে এবং স্মৃতিচারণায়। এখনো চলচ্চিত্র প্রেমীরা অবলীলায় বলেন, ‘সালমান শাহর মতো আর কেউ এল না’। ১৯৯৩ সাল থেকে সালমান যতোদিন ছিলেন, তাকে নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ এতটুকু কমার আলামত পাওয়া যায়নি। বাংলা চলচ্চিত্রে বোধ করি সালমানই একমাত্র নায়ক যার জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের চেয়ে অজনপ্রিয় ছবির তালিকা করা সহজ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ ভোর ৫:১৫