somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাইয়েমা হাসানের ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’

৩০ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এদেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিরাপদ রাখতে সরকার সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে দশদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছেন। যেহেতু কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস জনিত রোগ তাই দশদিনের সাধারণ ছুটির মূল উদ্দেশ্য জনসাধারণ ঘরে থেকে নিজেদেরকে আশংকামুক্ত রাখুক। পরিস্থিতির নাজুকতা এবং ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার হওয়ার আশংকা থেকে সরকার সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করেছেন সাধারণ মানুষ যাতে ঘরে থাকে সেটা নিশ্চিত করতে। সাদা চোখে খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ এতে কোনো সন্দেহ নাই। তবে উদ্যোগটি ঠিক তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে যখন জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিছু অতিউৎসুক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ফ্রেন্ডলি ফায়ার করছেন। ফ্রেন্ডলি ফায়ার বা মিত্রপক্ষের গুলি টার্মটি এসেছে মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। সেনাবাহিনী সাধারণত শত্রুকে তাক করে গুলি চালায়। কিন্তু অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙখ্লা দেখা দেয়; যুদ্ধের ঢামাডোলে শত্রুমিত্র ঠাহর করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় অনেক সৈন্য তাদের নিজেদের বা সপক্ষের ছোড়া গুলিতে আহত হয়। এ ধরনের গুলিই হচ্ছে মিত্রপক্ষের গুলি বা ফ্রেন্ডলি ফায়ার। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন মিত্রপক্ষের ওপর হামলা ঘটে, তেমনি সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের গৃহিত অনেক ব্যবস্থা অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর উপকারের বদলে অপকার করতে পারে।

গত চারদিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যেসব ছবি এবং ভিডিও ভায়রাল হয়েছে তার মধ্যে যে দৃশ্যগুলো বার বার এসেছে তা হলো রাস্তায় পুলিশের নির্বিচারে লাঠিচার্জ এবং সেনাবাহিনীর কান ধরে উঠবোস করানোর দৃশ্য। পিছিয়ে নেই প্রশাসনও। যশোর জেলার মনিরামপুরের ভূমি কর্মকর্তা সাইয়েমা হাসানকে দেখলাম দুজন বয়স্ক মানুষের কান ধরিয়ে নিজ মুঠোফোনে ছবি ধারন করছেন। ছবিতে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা যাচ্ছে ঘটনাস্থলে মুঠোফোনে আলাপরত। ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার দ্বিতীয় দিনে তিনি যে তিনজন বয়োঃবৃদ্ধদের কান ধরিয়ে ছবি ধারন করেছেন তাঁরা পেশায় ভ্যানচালক, সবজি বিক্রেতা এবং তৃ্তীয়জন সাইকেল আরোহী ছিলেন। ধারনা করছি পেটের দায়ে তাঁরা সরকারের নিষেধ অমান্য করে কাজে নেমেছেন। হয়তো অক্ষরজ্ঞানহীন এই তিনজন মানুষ বুঝতেই পারেনি কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস কি। এর সংক্রমন সামষ্টিক ভাবে কত বড় বিপর্যায় ডেকে আনতে পারে। তবে বিসিএস এর বৈতরনী পার হওয়া, উচ্চশিক্ষিত, সরকারি আমলা মিজ সাইয়ে্মা হাসান তাদেরকে জনসম্মুখে কান ধরিয়ে খুব ভালোভাবে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

একটা তথ্য মনে করিয়ে দিই, এদেশের ৬.৫ কোটি দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে আর পুষ্টিহীনতায় ভোগে ৪১.৩ ভাগ মানুষ। গণমাধ্যমে দেখলাম তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘দেশ তো লকডাউন করা হয়নি। রাস্তায় অহেতুক ঘোরাফেরা না করতে সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় কেউ প্রয়োজনে যেতেই পারেন, গেলেই তাকে হয়রানির সম্মুখীন হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি করার জন্য পুলিশকে বলা হয়নি’। মার্চের মাঝামাঝিতেই অনেক স্বচ্ছল পরিবার ছয়মাস বছরের খাবার কিনে মজুদ করে নিয়েছেন। স্বভাবতই বাজারে পণ্যের যোগান স্বাভাবিক এবং চাহিদা অস্বাভাবিক থাকায় দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষের এমনিতে নুন আনতে পানতা ফুরায়, এখন তো নাভিঃশ্বাস অবস্থা হওয়ার কথা। তো তেমন তিনজন শ্রমজীবী মানুষকে কান ধরানোর ধারা যদি মিজ সাইয়েমা হাসান একটু কষ্ট করে আমাদের জানাতেন, তবে বাধিত থাকবো।

প্রশাসন মাঠে তৎপর আছেন এমনটা প্রমাণ করতেই হয়তো যশোর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজ সাইয়েমা হাসান ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা কালে মাস্ক না পরায় তিন বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে দাড় করিয়ে রেখে মুঠোফোনে প্রমাণ স্বরূপ ছবি ধারন করে রাখতে চেয়েছেন। প্রশাসনের ব্যর্থতা দুইভাগে বিভক্ত (১)কর্ম সম্পাদন না করার জন্য ব্যর্থতা, (২)কর্ম সম্পাদনের জন্য ব্যর্থতা। এদেশের জরুরি সময়ে এবং নাজুক পরিস্থিতিতে জনগনের পাশে না থাকলে তা হবে প্রথম ধরনের ব্যর্থতা। আর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সাধারণকে জনসম্মুখে হেয় করা হলে তা হবে দ্বিতীয় ধরনের ব্যর্থতা। রাষ্ট্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। রাষ্ট্রের কাছে মৌলিক চাহিদা মেটানোর দাবি জনসাধারণ করতেই পারে। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থা জনসাধারণের জন্য যত বেশি অর্থ ব্যয় করবে, যত ব্যবস্থা নিবে, যত দৌড়ঝাঁপ করবে, ততই মানুষের উপকার হবে। তবে জনপ্রশাসনের সাম্প্রতিক দৌড়ঝাঁপ রাষ্ট্রকে বিব্রত করতে দ্বিতীয়বার ভাবছেন না।

মিজ সাইয়েমা হাসানের কৃ্ত কর্ম চারটি পর্যায়ে ত্রুটিপূর্ণ। প্রথমত, কোভিক-১৯ বা করোনা ভাইরাস নিয়ে এদেশের আপামর জনসাধারণ আতংকগ্রস্থ। সুতরাং প্রথমেই মাঠ পর্যায়ে বিষয়টি বার বার বুঝিয়ে বলা দরকার ছিলো। দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস এদেশে মহামারী আকারে ছড়ানোর আশংকাজনক পর্যায়ে রয়েছে, তাকে এখনি নিশ্চিত ধরে নিয়ে তিনি কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন। তৃ্তীয়ত, শাস্তি প্রয়োগের ত্রুটি। তিনি তিনজন বয়োঃবৃদ্ধকে কান ধরিয়েছেন। চতুর্থত, জনসম্মুখে দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের কান ধরিয়েছেন এবং নিজ মুঠোফোনে তা ধারণ করেছেন। এখনি তাকে না থামালে হয়তো এমন বয়স্ক মানুষদের তিনি কান ধরিয়ে উঠবোস করাতেও ভুলতেন না। যে কোনো সিদ্ধান্তের ফলাফল দুই ভাগে ভাবা যায়। একটা হলো দৃশ্যমান ফলাফল, আরেকটি অদৃশ্য ফলাফল। এই ঘটনার দুইভাগের ফলাফলই অবাঞ্চিত হয়েছে। এই ঘটনার বর্ণনা যারা শুনেছেন কিংবা ছবি দেখেছেন প্রত্যেকেই নিজেদের অবস্থান থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

তৃণমূল পর্যায়ে মিজ হাসান একা নন, দিন কয়েক আগে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনও রাতে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে শারীরীক নির্যাতন করে জেলে পুরেছেন। জনপ্রশাসন বিভাগীয় তদন্ত শেষে তাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। যশোর জেলা প্রশাসনও দেখলাম মিজ হাসানকে তার দায়িত্ব থেকে সাময়িক ভাবে অব্যহতি দিয়েছেন এবং ছুটি শেষ হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন। সমস্যা হচ্ছে, আমলাতন্ত্র কখনো ভুল স্বীকার করতে চায় না। কালক্ষেপন করে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়। এদেশে স্থানীয়দের কাছে আমলাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধান করার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। সরকারি কর্মকর্তা বলে দূর্বলের উপর ক্ষমতার স্বাদ নিতে তাঁদের বিবেকে মোটেও লাগে না। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটলে, গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সেবার মানকে প্রাধান্য না দিলে এভাবেই প্রতিনিয়ত দেশের আপামর সাধারণ মানুষের সম্মানের শ্রাদ্ধ হবে। প্রশাসনের ফ্রেন্ডলি ফায়ার এড়ানোর জন্য চাই দক্ষ আমলা (তৃণমূল পর্যায়ে)। তাঁদের শুধু দক্ষ হলেই হবে না মানবিকও হতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:১৪
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×