আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টে আগুনে নিহতের সংখ্যা দেড় শতাধিক দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ জনের লাশ সম্পূর্ণ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। আগুনে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে আরও কমপক্ষে ৭৫ জন।
উল্লেখ্য, কারখানায় আগুন লেগে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেই তড়িঘড়ি করে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের এক লাখ টাকা ‘ক্ষতিপূরণ’ দেয়ার ঘোষণা দেয় মালিকরা। গত শনিবার রাতে আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টে আগুন লেগে ১৫০ জন শ্রমিক মারা যাওয়ার পরও তাই-ই হলো। রবিবার সকালে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলেছে, নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে। বিভিন্ন গার্মেন্টে ২০০০ সাল থেকে আগুনে পুড়ে মারা গেছে প্রায় ৬০০ শ্রমিক। অবশ্য বিজিএমইএর হিসাবে এ সংখ্যা মাত্র ২৭৫ জন। এ হিসাব ধরলে আগুনে প্রাণহানির ক্ষতিপূরণ বাবদ বিজিএমইএর এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অথচ বছরে গার্মেন্ট খাতের রপ্তানি আয় এক লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আর দেশের অর্থনীতিতে এই বিপুল অবদানের কৃতিত্বের বড় অংশীদার যে শ্রমিকরা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সর্বশেষ আশুলিয়ায় অগ্নিকা-ে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বিজিএমইএর যে খরচ হবে, তা তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনের দুই দিনের রপ্তানি আয়ের সমান। গত বছর সে রপ্তানি করেছে প্রায় চার কোটি ডলারের পোশাক।
গত তিন দশকে যথেষ্ট উৎপাদন দক্ষতা অর্জন করেছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। এখনো সস্তা শ্রমই এ শিল্পের বিকাশের মূল শক্তি। এর বদৌলতেই বিশ্ববাজারে অবস্থান ধরে রাখতে পারছে প্রায় পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর এ রপ্তানি খাত। কম দামে পোশাক কেনার উৎস হিসেবে বিশ্বের বড় বড় পোশাক ব্র্যান্ডের কাছে বাংলাদেশ আকর্ষণীয়। পোশাক বানাতে যা কিছু লাগে, তার সবই রয়েছে চীনে। সস্তায় পণ্য তৈরিতেও দেশটি সিদ্ধহস্ত। সেই চীনও এখন ঝুঁকছে বাংলাদেশের দিকে। কারণ তাদের শ্রমের মূল্য যে হারে বেড়েছে, তাতে খরচ পোষায় না। বাংলাদেশেও শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। এরপরও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পোশাক বিক্রি করত সক্ষম এ দেশের শিল্পমালিকরা। এ সক্ষমতায় তাঁদের যতখানি কৃতিত্ব, তার চেয়ে অনেক বেশি ত্যাগ শ্রমিকের। পোশাকের বিশাল রপ্তানি ও তার পেছনে বিপুল আমদানি বাণিজ্যে মওকুফ করা শুল্ক টাকার অঙ্কে কত দাঁড়ায়, তার হিসাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ড জানে। গবেষকদের হিসাবে, ১০০ ডলার রফতানি আয়ের পেছনে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি আমদানি বাবদ ব্যয় হয়ে যায় ৮০ ডলার। ২০ ডলারের সমপরিমাণ স্থানীয় মূল্য সংযোজন, খুচরা কিছু উপাদান বাদ দিলে তা আসে শ্রমিকের কায়িক শ্রম থেকে। তবু পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শিল্পশ্রম নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাতে। তাদের জীবনের দাম যে কতটুকু ধরা হয়, বারবার অগ্নিকা-ের ঘটনা তা স্পষ্ট বলে দেয়।
আশুলিয়ায় তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেডে স্মরণকালের অগ্নিকা-ের পর সরকার নামকাওয়াস্তে নড়ে চড়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেয়ে দমকল বাহিনী দেশের সব কটি গার্মেন্টসে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিশ্চিত হয়েছে, শতকরা নব্বইভাগ গার্মেন্টসে অগ্নিনির্বাপকের সরঞ্জাম, ইমার্জেন্সি সিঁড়ি ও অটো ফায়ার স্পিংলার সিস্টেম নেই। নেই কোন প্রশিক্ষণরত অগ্নিনির্বাপক কর্মী। গার্মেন্টস মালিকরা বিল্ডিং কোড ও ফায়ার সার্ভিসের কোন শর্তই মানছে না। যে যার মতো পারছে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। রাজধানীর কয়েকটি গার্মেন্টসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি গার্মেন্টসে অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার সাজিয়ে রাখলেও অধিকাংশ গার্মেন্টসে অগ্নিনির্বাপকের সরঞ্জাম দেখতে পাওয়া যায়নি। অগ্নিকা- সম্পর্কে গার্মেন্টসের মালিক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের নেই কোন প্রশিক্ষণ। তাছাড়া অগ্নিনির্বাপক সম্পর্কে মহড়াও হচ্ছে না কোথাও। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সার্বক্ষণিক প্রতিটি গেট বন্ধ থাকছে। শ্রমিকদের নেই কোন নিরাপত্তার বালাই। কোন নিয়মনীতি না মানায় গার্মেন্টসে আশঙ্কাজনকভাবে অগ্নিকা-ের ঘটনা বেড়ে গেছে। তার পাশাপাশি মৃত্যুর মিছিলও রোধ করা যাচ্ছে না। আইন থাকলেও নেই কোন প্রয়োগ। আবার গার্মেন্টস মালিকরা রাজনৈতিক দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। চরম অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার মধ্যে চালানো হচ্ছে গার্মেন্টস সেক্টর। গত দুই দশকে আগুনে প্রায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। যে কোন ঘটনা ঘটলেই গঠন করা হচ্ছে তদন্ত কমিটি। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট কখনোই আলোর মুখ দেখছে না।
সঙ্গতকারণেই বলতে হয়, গার্মেন্টসে আগুন রোধে প্রতিমাসে যে কোনো ভবনের বৈদ্যুতিক ফিটিংস পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে ফিটিংসগুলো পরিবর্তন করার উদ্যোগসহ ফায়ার সার্ভিসের শর্ত পূরণ না করলে লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। সংশি¬ষ্ট মালিক বা কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় এনে গ্রেফতারে বিধান রাখতে হবে। শ্রমিকদের মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ সার্বক্ষণিক গেট বন্ধ রাখলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকা- প্রতিরোধে আইন, আদেশ ও নির্দেশ সবই আছে। কিন্তু, প্রয়োগ নেই। গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকা- প্রতিরোধ ও প্রাণহানি এড়ানোর জন্য প্রচলিত আইন মানতে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে প্রায় দেড় যুগ আগে। কখনো হালকা আর কখনো কঠোর ভাষায় প্রতিবছরই নির্দেশনা জারি করছে সরকার। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। ফলে দেশের সম্ভাবনাময় এ শিল্পে প্রতিনিয়ত ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা। ঘটছে প্রাণহানি। মৃত্যর মিছিলে প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে শত শত শ্রমিক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৫ সালের কারখানা আইন, ১৯৭৯-এর কারখানা বিধিমালা এবং ১৯৫৯-এর ফায়ার সার্ভিস অর্ডিন্যান্সেথ প্রতিটি গার্মেন্টস কারখানায় অন্তত দুইটি সিঁড়ি, প্রতিটি কক্ষে অন্তত দুইটি করে দরজা, ফায়ার ফাইটিং তথা আগুন নেভানোর সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং কারখানায় যথেষ্ট পরিমাণ পানি রিজার্ভ রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু এসব আইন অমান্য করেই গড়ে ওঠে শত শত গার্মেন্টস কারখানা। এসব গার্মেন্টে অগ্নি প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় একের পর এক ঘটতে থাকে অগ্নিকা-সহ ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তারপরেও সরকারের চেতনা হয় না। সরকারের গাফলতি কাটেনা। যেন সরকারের কাছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। আমরা এর অবসান চাই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




