প্রথম কিস্তি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রাক-কথন
গ্রামীণফোন অফিসে আজকের গুজব (শুক্রবার, ২৭ জুন ২০০৮) হলো- গতকাল দুটি পত্রিকাকে গ্রামীণফোন ৫০ লাখ টাকা করে ঘুষ দিয়েছে যাতে করে তারা গ্রামীণফোনের আন্দোলনের খবর পত্রিকায় প্রকাশ না করে। ব্যাপারটা প্রথমে অবিশ্বাস্য গুজব বলে মনে হচ্ছিলো, পরে যেভাবে ব্যাখ্যা পেলাম তাতে আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো না। এই দুটি এনজিও-ধর্মী পত্রিকার সঙ্গে আরো বেশি সামাজিক দায়িত্বপ্রকাশসুলভ (সিএসআর) যৌথ কর্মসূচিতে যাচ্ছে গ্রামীণফোন, যার আর্থিক দায়িত্ব গ্রামীণফোনের, এই পত্রিকাগুলোতে গ্রামীণের বিজ্ঞাপন এবং সংবাদ ও সেবা সংক্রান্ত যৌথ কর্মপ্রয়াস আরো বাড়বে, যাতে প্রাথমিকভাবে আর্থিক লাভবান হবে পত্রিকা দুটি। ওপরের ঘটনাটিকে আপনি গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে একটি অপপ্রচারণা হিসেবে মনে করতে পারেন। কিন্তু গুজবটা চালাচ্ছে গ্রামীণফোনের কর্মীদেরই একটি অংশ; এবং সেখানে গুজবটি একটু ঘুরিয়ে প্রচারিত হচ্ছে- “গ্রামীণফোনের কাছ থেকে বেশি টাকা ঘূষ আদায় করার জন্য মিডিয়াগুলো বিভিন্ন জায়গায় গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।” যাতে করে আন্দোলনের সংবাদ পরিবেশন না করার চুক্তিতে আরো বেশি টাকা আদায় করতে পারে গণমাধ্যমগুলো।
আমরা খুব দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এই ব্লগিংয়ের সাথে কোনো মাধ্যম বা ব্যক্তি জড়িত নেই, এটা স্রেফ গ্রামীণফোনের একজন কর্মীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আর ব্লগ তো ব্যক্তিগত ডায়েরী লেখারই জায়গা। আর সেটা অন্যদের সঙ্গে শেয়ারের মাধ্যমে পরস্পরের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাঠামো ও আন্তঃসম্পর্ককে সংহত করাই এর উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয় কিস্তি
রাজা-রাণী-রাজপুত্র-রাজকন্যাদের গল্প
কিছুদিন আগে অভিনেতা আলী যাকের টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠানে গ্রামীণফোনের মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক রুবাবা দৌলা মতিনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিভাবে আপনি কর্মজীবনে এলেন? জবাবে রুবাবা বলেছিলেন, “আমি তখন মাত্র বিবিএ-র পরীক্ষা শেষ করেছি, কোথাও চাকরি করবো তা তখনও ঠিক করিনি। এমন সময় আমার চাচা সাবেক সচিব আসফউদৌলা ফোন করে আমাকে বললেন, গ্রামীণফোনে জয়েন করবে? আমি বললাম, আমি তো গ্রামীণফোনে এপ্লাই-ই করিনি, জয়েন করবো কিভাবে? তিনি জানালেন, যেভাবেই হোক জয়েন করতে চাইলে, আগামীকাল অমুক স্থানে অমুকের সাথে দেখা করো। তারপর থেকেই গ্রামীণফোনে আছি।”
বিস্ময়কর! গ্রামীণফোনের হেড অব মার্কেটিংয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখুন। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ গ্রামীণফোনে খুবই সাধারণ (common) ঘটনা। গ্রামীণফোনে নিয়োগের প্রধান শর্তই হলো- এখানে আপনার কোনো আত্মীয়কে আগে থেকেই থাকতে হবে; অথবা বিটিআরসি, সরকারের টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় অথবা এমন কোনো প্রভাবশালী জায়গায় আত্মীয় থাকলে, আপনি খুব সহজেই গ্রামীণফোনে নিয়োগ পাবেন। শুধু গ্রামীণ নয়, সিটিসেল, একটেল, বাংলালিঙ্ক সহ সব কোম্পানীর অনলাইন জব এপ্লিকেশন ফর্ম-এর একটি অংশ হলো ওই কোম্পানীতে আপনার যেসব আত্মীয় বা বন্ধু আছে, তাদের সম্পর্কে তথ্য দেয়া। যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির চেয়ে অনেক গুণ বেশি নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হয় যোগাযোগের ভিত্তিতে। আর্ন্তজাতিক শ্রম আইন অনুসারে এটা সুস্পষ্টভাবে কর্মী নিপীড়ন।
গ্রামীণফোন এবং অন্যান্য টেলিফোন অপারেটরগুলোতে আপনি বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তানকে দেখতে পাবেন। এদের বাবা-মা বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ইত্যাদি। গ্রামীণফোনে তারা যে বেতন পান, তাদের সপ্তাহান্তের প্রমোদ-ভ্রমণের ট্রান্সপোর্ট কস্ট তার চেয়ে অনেক বেশি। তাদের কয়েকজনকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা এতো অল্প বেতনের জন্য কেন গ্রামীণফোনে কাজ করেন? তারা আমাকে যে উত্তর দিয়েছিল, তার সারমর্ম হলো- এর মাধ্যমে গ্রামীণফোনের সাথে ব্যবসায়িক পার্টনারশিপ-টা ভালো হয় (অর্থাৎ থার্ড পার্টির কাজ-টা তারা সহজে বাগাতে পারেন), দ্বিতীয়ত, সরকার বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে নেগোশিয়েশনে মন্ত্রি-সাংসদ-পুত্ররা ভাল ফল আনতে পারেন এবং সেজন্য তারা বেতন-বর্হিভুত কিছু সুবিধা পান এবং তৃতীয়ত, তারা ওই টেলিফোন কোম্পানী এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সহজে নারী-কর্মীদের সঙ্গ পান। পারিবারিক সম্পর্কের সূত্রে যারা গ্রামীণফোনে নিয়োগ পায় তাদেরকে বলা হয়, রাজকন্যা-রাজপুত্র। তাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে হয়ে যান রাণী বা রাজা। নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে একটা কমন ঘটনা হলো- সিনিয়র কোনো সহকর্মীকে বিয়ে করা এবং খুব তাড়াতাড়ি প্রমোশন পাওয়া, তাদেরকে তখন বলা হয় রাণী।
আপনি এখন সহজেই কল্পনা করতে পারেন, এই রাজপুত্র-রাজকন্যা এবং রাজা-রাণীদের দাপট গ্রামীণফোনে কতোটা! তারা অফিসে তেমন কোনো কাজ-ই করেন না, কিন্তু মাসান্তে ভালো বেতন পান, তাছাড়াও পান বেতনবহির্ভুত অনেক কিছুই। স্বভাবতই যারা অফিসে প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন কিন্তু ভালো বেতন পান না, তারা নিঃসন্দেহে এইসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন। গত কয়েক মাসে তারই প্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
গতকাল একটি প্রসঙ্গে বলেছিলাম, নিচের সারিতে যে বাংলাদেশিরা কাজ করছেন, তাদের একটি অংশ সবসময় যে কোনো উপায়ে টাকা উপার্জনের জন্য বিদেশিদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। একজন জানতে চেয়েছেন, যে কোনো উপায়ে টাকা অর্জন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
যেকোনো উপায়ে টাকা উপার্জন বলতে বোঝানো হচ্ছে বৈধ-অবৈধ যে কোনো পথে। গ্রামীণফোনের বর্তমান পরিণতির জন্য এই কারণটা অনেক বেশি দায়ী। গ্রামীণফোনে এখন যারা থার্ড পার্টি বিজনেস করছেন অথবা থার্ড পার্টি বিজনেস করতে চাচ্ছেন, তাদের একটি বড়ো অংশ এর আগে যুক্ত ছিলেন ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে। গ্রামীণফোনের এমডি, ডিরেক্টর থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত অনেকের বিরুদ্ধেই ভিওআইপি নিয়ে মামলা রয়েছে। সরকার ভিওআইপি-র লাইসেন্স উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর এটা নিয়ে আর একচেটিয়া ব্যবসা করা যাচ্ছে না দেখে, গ্রামীণফোনের এই কর্মকর্তাদের একটা অংশ এখন শুরু করেছেন থার্ড পার্টি ব্যবসা। আর তারই অংশ হলো এই ব্যাপক ছাটাই। (চলবে)