লেখাটি আমার না, গ্রামীণফোনে কর্মরত নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মীর-----
গ্রামীণফোনে তিনমাসের মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার তৃতীয়বারের মতো কর্মীবিক্ষোভ হয়েছে। বরাবরের মতো এবারের ঘটনাটাও গণমাধ্যম এবং শ্রম-অধিকার নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের নজর এড়িয়ে যাবে, এমনটাই আশা (!) করছি। কেননা নিজের চোখে দেখা আজকের ঘটনাটা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই বদলে গেল; অফিসিয়ালি আমাদেরকে যে ব্রিফ দেয়া হলো, তা প্রকৃত ঘটনার পুরো উল্টো।
অধস্তন কর্মীদের সাথে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চিরকালীন একটা বিরোধ আছে, কিন্তু গ্রামীণফোনের মতো প্রতিষ্ঠান যাদের কর্মী-ব্যবস্থাপনা তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধস্তন কর্মীদের হাতে লাঞ্জিত হবে, সেই ঘটনার প্রেক্ষাপট নিঃসন্দেহে অনুসন্ধানের দাবি রাখে। আমি নিজের চোখে দেখে এলাম, অধস্তন কর্মীরা ঊর্ধ্বতনদের পেটাচ্ছে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটা হয়ে গেল অধস্তন কর্মীদের মারামারি। এর আগের বার তো ঘটনা পুরোপুরি ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। আমি নিজেই তার সাক্ষী। ঘটনাচক্রে ওইদিন সন্ধ্যায় কয়েকটা মিডিয়া হাউজে যেতে হয়েছিল আমাকে, প্রত্যেক হাউজেই শুনলাম আপনাদের অমুক জিএম তমুক ডিরেক্টর আমাদের মতি ভাইকে, অমুক ভাইকে ফোন করে নিউজটা যেন না যায় সে অনুরোধ করেছেন। এবারের ঘটনাও কি সেই পরিণতিই নেবে??
কিন্তু কথা হল বার বার এ কর্মী অসন্তোষের কারণ কী? যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের যে স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসে ইকবাল কাদির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রামীণফোন, সেই স্বপ্নীল একটি প্রতিষ্ঠানের আজ এই দশা কেন? কেন এই প্রতিষ্ঠানের অপর উদ্যোক্তা নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ইউনুস বার বার এই প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি-সহায়ক অংশীদার টেলিনরের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙের অভিযোগ আনছেন?
বিশদ অনুসন্ধানের আগে আজকের ঘটনাটি সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলা যাক। অর্থ উপার্জনের দিক থেকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণফোনের কর্মীশোষণ বর্তমানে অত্যন্ত জঘন্য পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। শীর্ষস্থানীয় প্রায় সবকটি পদে রয়েছে ইউরোপীয়রা। মাঝে মাঝে তাদের আনা হয় বিশেষজ্ঞ হিসেবেও। এমনও নজীর আছে, মাত্র ৩ মাসের জন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে ৩০০ কোটি টাকা সম্মানী নিয়েছেন। নিচের সারিতে যে বাংলাদেশিরা কাজ করছেন, তাদের বৃহৎ একটি অংশ সবসময় যেকোনো উপায়ে টাকা উপার্জনের জন্য এই বিদেশিদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। এবং এটা নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অত্যন্ত নোংরা। সম্প্রতি গ্রামীণফোনের শীর্ষ পর্যায় থেকে কয়েকজন হেভিওয়েট কর্মকর্তার পদচূ্তি তার একটি নজির।
বর্তমানে গ্রামীণফোনে অনিয়মিত(পার্ট-টাইম ও কন্ট্রাক্ট) কর্মী আছেন কয়েকশ। তাদের মাসিক বেতন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। তবে পার্টটাইমার হলেও তাদের কাজ করতে হয় নিয়মিত কর্মীদের চেয়ে বেশি, ঘণ্টায় ১০০ টাকা হিসেবে সাধারণত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৯ ঘণ্টা কাজ তারা পান ৮০০ টাকা । ৯ ঘণ্টা কাজ করে ৮ ঘণ্টার বেতন কেন পান? এর ব্যাখ্যা হলো, এই কর্মীদের খাওয়া ও বাথরুম করাতে ১ ঘণ্টা অপচয় হয় বলে মনে করে গ্রামীণফোন। সাধারণত নিয়মিত কর্মীদের মতো সপ্তাহে ৫দিন অফিস করলেও তারা নিয়মিত কর্মীদের কোনো সুবিধাই পান না। ২০০৫ সালে গ্রামীণফোন তার পার্টটাইমার কর্মীদেরকে ঘণ্টায় ১০০ টাকা বেতন দিতো। ৩ বছর পরও ওই পার্টটাইমার ওই ১০০ টাকাই পাচ্ছে। যদিও এ তিন বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ।
১০-১৫ হাজার টাকা হয়তো বাংলাদেশের অনেকের কাছেই অনেক বেতন মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার, গ্রামীণফোনের পার্টটাইমার কর্মীটিকে কিন্তু প্রতিদিন তার শার্ট ধুতে হয়, ইস্ত্রি করতে হয়, জুতায় কালি লাগাতে হয়, শেভ করতে হয়, শার্টে যেন ভাঁজ না পরে সে জন্য ভিড়ের বাস এড়িয়ে কম ভিড়ের যানবাহনে যাতায়াত করতে হয়, গায়ের গন্ধ আর চুলের পাট ঠিক রাখার জন্য নানাবিধ প্রসাধনী ব্যবহার করতে হয় এবং এই সবকিছু ঠিক রেখে ঠিক ৮টায় অফিসে আসতে হয়।
অনিয়মিত কর্মীদের সংখ্যাটা কয়েকশ না বলে কয়েক হাজার বলা যেত, যদি গত কয়েক মাসে ব্যাপক গণছাটাই না হতো। কর্মী অসন্তোষের প্রধান কারণ হচ্ছে ছাটাই। তিন বছর আগে গ্রাজুয়েশন করা যে ছেলে বা মেয়েটি গ্রামীণফোনে অনিয়মিত কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিল, তারা আশা করেছিল একটি নির্দিষ্ট সময় পার করার পর গ্রামীণফোন তাদেরকে নিয়মিত কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করবে। কিন্তু ৩ বছর পর অকস্মাৎ এই ছাটাই তাদেরকে ক্ষুব্ধ করেছে। অকস্মাৎ গ্রামীণফোনের এতো কর্মী ছাটাইয়ের কারণ কী? সহজ উত্তর থার্ড পার্টি। গ্রামীণফোনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রায় সবাই গ্রামীণফোনের সাথে আলাদা আলাদা ব্যবসায় জড়িত। কেউ গ্রামীণফোনে গাড়ি সরবরাহ করে, কেউ গ্রামীণফোনে নির্মাণ কাজ করে, কেউ গ্রামীণফোনের ছাপাখানার কাজ করে, কেউ সাইনবোর্ড লেখেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা প্রত্যেকেই গ্রামীণফোনের নিজস্ব কাজগুলো সম্পর্কে অত্যন্ত সম্যক জ্ঞান রাখেন। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, গ্রামীণফোনের কাস্টমার সার্ভিসে কল সেন্টার রাখবেন না। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি পর্যায়ে কল সেন্টারের লাইসেন্স দিয়েছে, তাই তারা এই লাইসেন্স নিয়েছেন এবং এখন তারা গ্রামীণফোনকে প্রস্তাব দিয়েছেন- কম খরচে তারা গ্রামীণফোনের কল সেন্টার পরিচালনা করবেন। অনিয়মিত কর্মীদের বলে দেয়া হয়েছে, তোমরা যদি ৬ হাজার টাকা বেতনে কল সেন্টারে চাকরি করতে চাও, তাহলে অমুক এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ কর। না হলে অন্য কোথায় নিজেদের ঠিকানা খুঁজে নাও। (পুরো ব্যাপারটি যে উপরের ঘটনার হুবুহু, তা নয়, তবে ঘটনাটা এই রকমই)
এই অবস্থায় কর্মীদের ক্ষুব্ধ হওয়াটা কী অযৌক্তিক?
অনিয়মিত কয়েকশ কর্মীর বাইরে গ্রামীণফোনের রয়েছে, নিজস্ব কিছু সহায়ক কর্মী। যেমন ড্রাইভার, নিরাপত্তা কর্মী ইত্যাদি। এই কর্মীদের বেতন গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। সুযোগ-সুবিধা ক্রমাগত কমিয়ে দেওয়া এবং ছাটাইয়ের খড়গ পড়েছে তাদের ওপরও। আজকের ঘটনার নায়ক আসলে তারাই। থার্ড পার্টির ওপরে ক্রমাগত নির্ভরশীলতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারাও। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোপূর্বে ২ দিন কর্মবিরতি দিয়ে তারা দাবি আদায়ের চেষ্টা করেছেন। আজ সকালে কাজে এসে যখন কিছু কর্মী দেখলেন, তাদের আর চাকরি নেই, স্বভাবতই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। আর তারই রোষে পড়েন প্রশাসনের অংশ হিসেবে প্রতীকীভাবে চিহ্নিত কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০০৮ রাত ১১:২৯