.
আমি শেয়ার মার্কেটের কিছুই বুঝিনা। আমার কোনো বিনিয়োগ ও ছিল না এই মার্কেটে। তারপরও পারিবারিক বনধনের খাতিরে আমাকে নিজের উপার্জন বিসর্জন দিতে হয়েছে আমার পরিবারকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। সেক্ষেত্রে আমিও শেয়ার মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্থদের একজন। পেপার পত্রিকায় অনেক লেখা দেখি, টিভি চ্যানেলে অনেক অনুষ্ঠান দেখি। রাজপথ আন্দোলনে সোচ্চার হতে দেখি। বিরোধি দলগুলোর শেয়ার বাজার নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য দেখি না, সহানুভুতি ছাড়া। সবাই দেখি বিরাট মিটিং করেন কিন্তু আসল দোষী কে/কারা, কাদের বিচার হওয়া উচিৎ এটা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন দেখি না। যেহেতু সবাই সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন, দেখে দেখে ধারনা হয়ে গেছে সরকার প্রধান এর জন্য দায়ী। ঠিক এই অবস্থায়, একটি প্রবন্ধ পেলাম ইন্টারনেটে। পড়ে অবাক হয়ে গেলাম! এত দিন ধরে এত তদন্ত করা হল, উপসংহার টানা হল, তিন/চার মাস পর তদন্তকারিরা গতকয়েকদিন আগে আবার সংবাদ সম্মলেন করলেন, প্রমাণ করার জন্য তারা তাদের কাজ করেছেন, সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। কিন্তু একবারের জন্যও এই তদন্ত দল বা কোনো একটা পত্রিকা কি টিভি চ্যানেল আসলে দোষী কারা এটা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন করলেন না। জনসম্মুক্ষে এই চোরদের চিনিয়ে দেয়ার কোনো পন্থা পরিলক্ষিত হলনা! আমরা যারা সব হারালাম আমাদের সামনে সামনের নির্বাচন ছাড়া আর কোনো উপায় যে নেই এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। যারা দোষী তাদের বিরোধিদলও সমীহ করে।
কিন্তু কারা এই গুটিকয় মানুষ যাদের সবাই ভয় পায়? কারো কোনো সাহস নেই এদের পরিচয় এবং কু-কীর্তি দিনের আলোয় নিয়ে আসার? যে প্রবন্ধটা আমি পড়েছি তাতে সরাসরি কাউকে চিনিয়ে না দেয়া হলেও শিক্ষিত লোক মাত্র ধারণা পেয়ে যাবেন আসলে চোরদের চিহ্ণিত করাটা মোটেই কঠিন কিছু না। এবং খুব বেশি মানুষও এই খেলার জন্য দায়ীনা। গুটিকয় লোক তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে আমাদের পথে বসিয়েছে। লেখাটা পড়ে একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল:
আমাদের দেশে কেউ ৩শ টাকা চুরি করলে সে গণপিটুনি খাবে, ৩হাজার করলে তার কোমরে দড়ি পড়বে, ৩লক্ষ করলে তদন্ত কমিটি হবে, ৩হাজার কোটি করলে প্রধানমন্ত্রী তাদের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন।
পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলা চোরদের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র বানাবেন, কারন আসলে এরা এদের টাকাতেই চলে। আগের রাজপুত্ররা অবশ্য 5% খেয়ে ছেড়ে দিতেন। এবার কি হবে? অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে??? আর আমরা কি খালি স্বপ্ন দেখতে থাকব কোনো এক তৃতীয় পক্ষের?
নিচে মূল লেখাটার অনুবাদ করে দিলাম এবং লিংক দিলাম। আমি ফাইনান্স তেমন বুঝি না, এজন্য অনুবাদে ভূল হলে মার্জনা করবেন। আর সবার সুচিন্তিত মতামত আশা করব।
সাম্প্রতিক শেয়ার বাজার ভেঙ্গে পড়া - দায়িত্বশীল শিবির যখন ভূল সংকেত প্রদান করে মার্কটের সুচকে বুদবুদ সৃষ্টি করে।
যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে শেয়ার বাজার অর্থনীতির উন্নয়নের লক্ষে নিবেদিত অন্যতম আর্থিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে। ক্ষুদ্র, বৃহৎ এবং ব্যক্তি পর্যায়ের কয়েক মিলিয়ন উদ্যোক্তার সম্মিলিত বিনিয়োগ বিলিয়ন ডলার সমপরিমান পুঁজিতে রুপান্তরিত হতে পারে এই শেয়ার বাজার থেকে। উন্নত বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত শেয়ার বাজারের কার্যক্রম গুলো পর্যালোচনা করে এ যাবত বেশ কতগুলো অর্থনৈতিক তত্ত্বের ভিত্তি সাফল্যজনকভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো শেয়ার বাজারের সাফল্য দক্ষ, সৎ এবং যোগ্য তথ্য ব্যবস্হাপনার উপর নির্ভর করে কারন পুরো বাজারটাই পরিচালিত হয় দ্রুত এবং সহজলভ্য তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে। শেয়ারের বাজার দর এইটির সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য ধারণ করে এবং এই বাজার মূল্য পরিবর্তন নতুন তথ্য প্রাপ্তির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। বিগত কয়েক বছরের বাজারের অস্বাভাবিক উত্থানের পিছনে বিগত দিনগুলোতে শেয়ারের দ্রুত বর্ধমান চাহিদা একটি অন্যতম কারন। কেন হঠাৎ করে বাজারের চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেল এর কারন যদি আমরা খুঁজতে যাই তবে পর্যায়ক্রমে নিচের বিষয়গুলোই প্রকাশিত হয়:
1. মিউচুয়াল ফান্ড সহ ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাজারে সরাসরি অংশগ্রহণ তদুপরি মার্জিনে বাণিজ্যের জন্য BO a/c গ্রাহকদের ঋণ প্রদান বাজারে ক্ষুদ্র এবং ব্যক্তি পর্যায়ের কয়েক মিলিয়ন উদ্যোক্তার আমদানি করেছে। তাদেরকে (মার্চেন্ট ব্যাংক) এবং ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোতে শাখা অফিস খোলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে যা প্রকারান্তরে শেয়ার বাণিজ্যকে সাধারনের জন্য সহজতর এবং আকর্ষণীয় একটি বাজারে তৈরি করেছে। যার ফলে দেশে রাতারাতি BO অ্যাকাউন্টের সংখ্যা পাঁচ লাখের নিচে থেকে ৩৩ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই BO a/c ধারকগণ দেশের সমস্ত কোণ থেকে তাদের বন্ধু/পরিবার/আত্নীয়দের intermediaries হিসেবেও কাজ করেছিল এবং তাদেরকে তাদের ব্যাংকের সঞ্চয় a/cs এবং সরকারি বন্ড এর চেয়েও উচ্চতর লাভের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। স্বভাগতভাবে মানুষ মাত্রই অনেকটা গবাদি পশুর মতন আচরন করে বিশেষ করে যদি তাদের সামনে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাবার মতন কোনো মূলা ঝুলানো হয়।
2. উত্থানের শুরুটা হয় মূলত দুই বছর আগে যখন Grameen Phone বেশ মোটাতাজা একটা IPO (চার হাজার কোটি টাকারও বেশি) বাজারে প্রস্তাব করে যা ছিল তাদের Tk. 10 face value'র চেয়ে অনেক বেশি। তার পরেও এই IPO (চার হাজার কোটি টাকারও বেশি) প্রস্তাব তাদের মোট পুঁজির মাত্র 10% ছিল। Grameen Phone যখন এই অস্বাভাবিক IPO নিয়ে বাণিজ্য শুরু করল যা কিনা তাদের মোট পুঁজির মাত্র 10%, DSE index এক লাফে 1000 সুচক লাফ দিল। এই ত্রুটিপূর্ণ index বিনিয়োগকারীদের ভুল সংকেত দিয়েছে এবং সেই থেকে সুচকের ঊর্ধ্বাভিমুখী গতি অব্যাহতই ছিল ।
3. সুচক যখন 3000 থেকে কয়েকমাসে 6000 ছুঁল, সাংবাদিকরা মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি খুব দ্রুত তা নাকচ করে দেন যে বাজার overheated না। ঠিক একই সময়ে কিছু বিদেশি কোম্পানি মার্কেটে প্রবেশ করে এবং সূচক আরো উর্দ্ধমুখি করে দেয়। যেহেতু শেয়ার বাজারে লভ্যাংশের উপর কোনো capital gain tax ছিল না এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এরও কোনো বিধিনিষেধ ছিলনা এরা এই লভ্যাংশ দেশের বাইরে স্থানান্তর করে কার্ব মার্কেট থেকে ডলার সংগ্রহ করে।
4. আমাদের হিসাববিজ্ঞান ব্যবস্থার একটা ত্রটিপূর্ণ/দুর্বল দিক, book building পদ্ধতি যার সুযোগ গ্রহণ করেছিল কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যারা এই book building পদ্ধতি মার্কেটে প্রয়োগ করে এবং উচ্চতর মূল্যমানের IPOs এর মূল্য উত্তোলন করতে সক্ষম হয় যা কিনা তাদের P/E ratio'র সাথে সংগতিপূর্ন নয় (Grameen Phone এর পথ অনুসরন করে)। পন্চাশটির মত কোম্পানি খেলায় অংশগ্রহন করার প্রস্তুতি নিয়ে নেয় যখন DSE সভাপতিকে একটি প্রেস কনফারেন্সে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়, আসল ধংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগের দিন। যে দেশে কোম্পানিগুলো নিয়মিত হিসাব পরিসংখ্যান পরিবর্তন করে ব্যাবসায়িক মুনাফা লাভের আশায় এবং অডিট যেখানে পরিচালিত হয় কেবল আনুষ্ঠানিকতার মত করে book building পদ্ধতিতে মালিকপক্ষের সন্তুষ্টি লাভ করার নিমিত্তে, ম্যানিপুলেশন সেখানে স্বাভাবিক।
5. সংকটের শেষ দুই সপ্তাহ বাংলাদেশ ব্যাংক ICB'র মাধ্যমে শেয়ার ক্রয় করার মধ্যে দিয়ে মূল্য উপরে ধরে রাখতে Tk 200+200 crore সরাবরাহ করেছিল। সেটা এই শেষ মুহুর্তের সুযোগ সন্ধানী কোম্পানীগুলোকে সংকেত দিয়েছিল যে এরকম "bail out" ফান্ড হয়ত আরো আসছে। তা আর আসেনি এবং মার্কেটে মুক্তপতন অব্যাহত ছিল সার্কিট ব্রেকারের অকৃতকার্যতার দরুন শেষ দিন পর্যন্ত যা শেষ হয় টানা চার দিন মার্কেট বন্ধ থাকার মধ্য দিয়ে। বেশি বৃহত্তর bailout funds হয়ত দেয়া যেত কিন্তু তার প্রতিকূল প্রভাব হত আরো ভয়ংকর।
6. উপরে উল্লিখত উপায়ে একটা সম্প্রসারনশীল বুদবুদের মত তৈরি হয়েছিল যা কিনা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের চুষে টেনে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল যখন কিনা সরকারি নীতিনির্ধারকরা বারবার সাধারন বিনিয়োগকারিদের ক্রমাগত আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে বুদবুদ একটা সময়ে বিস্ফোরিত হয়। সেইটি একসময় ঘটেছিল এবং ভেতরে থাকা লক্ষ লক্ষ জনগণের পূঁজি পারমানবিক বিস্ফোরনের মত ছারখার হয়েছে।
7. মার্কেটে যে পুঁজি পাম্প করা হয়েছিল যেহেতু তা ছিল সারা দেশে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট পূঁজির সমন্বয়, দ্বিতীয়বার আবার তাঁদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করা একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে যেহেতু তাদের বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। এবং এর ফলে জনগনের ব্যয়ের উপর একটা প্রতিফলন পড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের বেকারত্বের একটা ঘটনা ঘটবে যারা এই মার্কেটে জড়িত ছিলেন। 1930 এ আমেরিকা'র পূঁজিবাজার ধ্বসের পর 10 বছর লেগেছিল তা থেকে বেরিয়ে আসতে। একইরকম ঘটনার পর 2008 এর পর থেকে এখনও আমেরিকার বেকারত্বের হার 10% এরও বেশি বিলিয়ান ডলার bail- out প্যাকেজ দেয়া সত্ত্বেও। BD ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী উদ্ধার করতে বিশাল bail- out প্যাকেজের প্রয়োজন কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে? এবং এর সাথে নৈতিক অর্থনৈতিক সংকটের একটা ব্যাপার জড়িয়ে আছে। তদুপরিও যদি এটা করা হয়, হয়ত কয়েকবছর পর আবার একই ধরনের আরেকটা বুদবুদ তৈরি হতে পারে।
উপসংহার: বিনিয়োগকারীদের সামনে ভুল তথ্যের সমাবেশ, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধভাবে অংশগ্রহণ, দুর্বল হিসাববিদ্যা ফাংশন শেয়ার মার্কেটের সংকটে মূল কারণ যার ফলে বিলিয়ন টাকা নিমিষে বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে। কেবল মাত্র হাইকোর্টের দ্বারা একটি বিচার বসিয়ে এই সংকট থেকে উত্তরণ পাওয়া যাবে না, অসংখ্য নিষ্পাপ বিনিয়োগকারিদের ক্ষতিপুরণ দিয়ে তাদের আত্নবিশ্বাস ফিরিয়ে এনে তাঁদের পুনরায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হয়ত কঠিন হয়ে পড়বে। সেইসাথে প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে কারা আমাদের অর্থনৈতিক শাসনের দায়িত্বের ভারপ্রাপ্ত আসনে আসীন হয়ে আছেন।
লেখার মূল লিংক:
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫০