অনেক কাল আগে আমরা কয়েকজন ছেলে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার আমরা একটু দূরে কোথাও ঘুরতে যাব। আমাদের প্ল্যান ছিল আমরা সাগর আর পাহাড় দেখতে যাব কিন্তু এক্সাক্টলি ঠিক কোন কোন জায়গায় যাব সেটা আমরা ঠিক জানতাম না। তবে তখন নীলগিরি জায়গাটা খুব হিট ছিল কারণ টিভিতে 'নীলগিরি না ফিলগিরি' এইরকম একটা এড প্রচার হইত। সেকারণে নীলগিরি যাওয়ার ব্যাপার টা মোটামুটি কনফার্ম ছিল। এছাড়া আমার চট্টগ্রাম আর রাঙ্গামাটি যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল আগেই। সেই সূত্রে আমরা খসড়া একটা প্ল্যান করলাম যে রাঙ্গামাটি, নীলগিরি, সাগর দেখতে কক্সবাজার আর যদি টাকায় কুলায় তাহলে সেন্টমার্টিন যাব। এদিকে আমাদের টাকারও তখন বেশ টানাটানি তাছাড়া বেশিরভাগই ছাত্র সেরকম কোন ইনকাম সোর্স নাই তাই মেলা কষ্টে একেকজন ৪-৫ হাজার টাকা করে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিলাম। আমাদের প্ল্যান হইল আমরা খরচ বাঁচিয়ে যত বেশি সম্ভব জায়গায় ঘুরব৷ মুরাদের তো রীতিমতো মসজিদে থাকারও প্ল্যান ছিল যদি একান্তই টাকা পয়সা শেষ হয়ে যায় তাহলে।
এইভাবে খসড়া প্ল্যান নিয়েই আমরা বাড়ি থেকে বের হইলাম। খরচ বাঁচানোর জন্য আমরা বগুড়া থেকে টিকিট কাটা বাসে না উঠে তথাকথিত মফিজ গাড়িতে ১২০ টাকা করে মিটিয়ে ঢাকায় এসে এয়ারপোর্টে নামলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যেতে হবে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। কাউন্টারে গিয়ে জানলাম টিকিট নেই। কিন্তু আমাদের তো যাওয়া লাগবে। ইতোমধ্যে ট্রেন এসে থামলো। ট্রেনে মারাত্মক ভীড়। কাউন্টার থেকে বলল স্ট্যান্ডিং টিকেট নিতে। কিন্তু আমরা ট্রেনের আনসারদের সাথে দরকষাকষি করতে লাগলাম আমাদের কে যেন ১০০ টাকার বিনিময়ে সিটের ব্যবস্থা করে দেয়। এই ব্যাপার টা আমি শিখছিলাম পাইলট () ভাইয়ের কাছ থেকে। একবার ভাইয়ের সাথে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার সময় এভাবে আনসারদের সাথে কন্ট্রাক্ট করে ঢাকায় আসছিলাম। কিন্তু এইবারে বিধি বাম। এত ভীড়ের দিনে এত কম টাকায় উনারা সিট দিতে রাজি হলেন না। তবে বললেন আপনারা ট্রেনের নামাজ ঘরে যেতে পারবেন। আমরা তাতেই রাজি কারণ আমাদের তো টাকা বাঁচানো দিয়ে কথা। আমরা হইহই করতে করতে ট্রেনের নামাজ ঘরে চলে গেলাম। আমরা ১১-১২ জন লোক সেখানে গাদাগাদি করে রইলাম। রাত গভীর হলে একেকজন ঘুমে টলমল হয়ে গেলাম কিন্তু আমরা না পারতেছিলাম শুইতে আর না পারতেছিলাম বসতে। কোনমতে ট্রেনের দেয়ালে হেলান দিয়ে পা টান করে বসে আধো ঘুমে আধো জাগরনে চট্টগ্রাম পৌঁছে গেলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রাঙ্গামাটি।
চট্টগ্রাম পৌছানোর পরে আমরা খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। তারপর বিআরটিসি বাসে করে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। রাঙ্গামাটি তো আমার কাছে হোম গ্রাউন্ড লাগে কারণ ওখানে বাবলুর বাসা। একারণে বাবলুর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। বাবলু তখন সিঙ্গাপুরে। এদিকে আমরা বাসে করে যাচ্ছি। নেটওয়ার্ক এর অবস্থা এখনো অনেক খারাপ আর তখন তো আরও খারাপ ছিল। ফলে বাবলুর সাথে যোগাযোগ করা গেল না। এদিকে প্রথম বার পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায় সবার অবস্থা খুবই খারাপ। রাঙ্গামাটি পর্যন্ত যেতে খালি আমি আর শোয়েব ভাই ছাড়া মোটামুটি আর সবাই বমি করে শেষ। যাই হোক দুপুর গড়ানোর পরে আমরা কোনমতে রাঙ্গামাটি পৌঁছে গেলাম। এবার আমাদের হোটেলে খোজার পালা। কিন্তু এখানেও সেই ভীড় আর প্রচুর ভাড়া। আমাদের ধারণা ছিল ভীড়বাট্টা থাকবে না এবং আমরা মোটামুটি ২-৩ শ টাকার হোটেলে উঠে যাব। কিন্তু ৮০০-১০০০ টাকার নিচে কোন হোটেল নাই। ইতোমধ্যে বাবলুর সাথে যোগাযোগ হইল, হোটেলের ভাড়া শুনে সেও অবাক। যাই হোক পরে আমরা সম্ভবত ১২০০ টাকায় তিনটা রুম নিছিলাম। কিন্তু সস্তার হোটেল খুঁজতে গিয়ে আমাদের এত ঘোরাঘুরি করা লাগছে যে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সেই বিকেল এবং সন্ধ্যায় আমরা রাঙ্গামাটি শহরের ঝুলন্ত ব্রিজ আর শহরের ভিতর ঘুরাঘুরি করলাম। আর বিভিন্ন লোকের কাছে জিগ্যেস করলাম আর কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। বেশিরভাগ লোকজন বললো চাকমা রাজবাড়ী, রাজবন বিহার আর শুভলং ঝর্ণায় যেতে। এছাড়া বোটের মাঝি এবং গাইডদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা কার্ড থেকে পেদা টিং টিং সহ আরও কয়েকটা স্পটের নাম শিখে গেলাম। রাতে হোটেল রুমে শুয়ে বসে কার্ড খেলতে খেলতে এইসব স্পটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
পরের দিন অনেক সকালে উঠে আমরা এইসব স্পটে ঘোরার জন্য এক্টা নৌকা নিলাম। বলাই বাহুল্য নৌকা নিলাম শেয়ারে তবে আমরা ছাড়া আর কয়েকজন মাত্র স্থানীয় লোক ছিলেন। সেই নৌকায় করে আমরা রাজবন বিহার, চাকমা রাজবাড়ী দেখে শুভলং ঝর্ণা দেখতে গেলাম। সকালে একবার আব্বুর সাথে ফোনে যোগাযোগ হইছিল। আব্বু হিল ট্র্যাক্টস এ থাকার সময় এদিকে ছিলেন। উনি তো বারবার নিষেধ করে দিছেন শুভলং গিয়ে ঝর্ণার উপর না উঠতে। পিতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য মেনে প্রথমে ঝর্ণার উপরে ওঠা থেকে বিরত ছিলাম, এছাড়া লোকমুখে জানলাম আমরা আসার কিছুক্ষণ আগেই উপর থেকে পড়ে একটা ছেলে মারা গেছে। এমনকি আমাদের দলেরই ছোট ভাইরা যখন উপরে উঠতে শুরু করল তখনও আমি আর মুরাদ উপরে ওঠা থেকে বিরত ছিলাম। কিন্তু আরেকটু পরে যখন দেখলাম কয়েকজন মেয়ে গুটিগুটি পায়ে উপরে উঠে যাচ্ছে তখন আমাদের পৌরুষ এমনভাবে জেগে উঠলো যে পিতৃ আজ্ঞা বা একটু আগের মৃত্যু সংবাদ সব কর্পূরের মতো উবে গেল। ফলাফল হিসেবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সকলকেই ঝর্ণার উপরে উঠে গোসল করতে দেখা গেল। যাই হোক আমরা কোন বিপদাপদ ব্যতিরেকেই হোটেলে ফিরে আসলাম এবং গোসল টোসল করে হোটেল থেকে চেক আউট করে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম। সাধারণত ১২ টার পরে চেক আউট করলে আরেক দিনের ভাড়া দিতে হয় কিন্তু আমরা আগে থেকেই বলে নিছিলাম যে আমাদের দেরি হতে পারে একারণে আর ভাড়া দেওয়া লাগে নাই।
আমরা ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে লোকাল বাসে করে বান্দরবান চলে আসলাম। এসবই আমরা করলাম খরচ বাঁচানোর কথা মাথায় রেখে এবং স্থানীয় লোকজন কে জিগ্যেস করে করে। এই যাত্রাটা বেশ ভালো ছিল। পথে একটা ফেরিও ছিল তবে আমরা যে ঠিক কোন পথে গেছিলাম তা আর এখন মনে নাই৷ আর সেসময় সেভাবে লক্ষ্যও করা হয় নাই। আমরা বান্দরবান পৌঁছাতে পৌঁছাতে আবারও সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো। আবার আমরা হোটেল খোজাখুজি শুরু করলাম। এবার আমরা উঠলাম সাঙ্গু হোটেলে। এই হোটেল রাঙ্গামাটির তাজমহল হোটেলের তুলনায় ভালো একারণে ভাড়াও বেশি। ফলে আমরা তিন রুমের বদলে সম্ভবত এক হাজার টাকায় দুই রুম নিছিলাম। তবে শর্ত আগের মতই। আমরা চেক আউট করতে দেরি করতে পারি এবং সেক্ষেত্রে এক্সট্রা চার্জ করা যাবে না। রাতে হোটেলের বাইরে ঘুরাঘুরি আর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে পরের দিনের ট্যুর প্ল্যান ঠিক করে আমরা ঘুমাতে গেলাম।
পরের দিন সকালে উঠে আমরা নীলগিরির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। যেহেতু আমাদের মধ্যে কেউই চিনতাম না কাজেই লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে যেতে হয়েছিল। চান্দের গাড়িতে করে আমরা নীলগিরি তে গেলাম। তারপর ফিরে এসে শৈলপ্রপাত আর স্বর্ণমন্দির দেখে সেদিন বিকেলেই কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সাঁতার না জানার কারণেই কিনা কে জানে তানিম আর আমাদের সাথে না গিয়ে ঢাকায় ফেরত আসলো।
কক্সবাজারে আমরা যখন পৌছুলাম তখন ইতোমধ্যে রাত হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের কারও মধ্যে হোটেল খোজার তাড়া দেখা গেল না। আমরা বরং বিচেই ঘোরাঘুরি করলাম। সমস্যা হইল ছোটদের নিয়ে। বিশেষ করে রনি তো কিছুক্ষণ পরপরই হারিয়ে যায়। পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েও ছোট রা কিছুক্ষণ পরপর হারিয়ে যাওয়াতে নিয়ম করা হইছিল হাঁটার সময় ছোটরা সামনে থাকবে। কিন্তু বিচে এসেও হারানো ঠেকানো গেল না।
যখন মাঝরাত পার হয়ে গেল মুরাদের বুদ্ধিতে আমরা তখন হোটেল খুঁজতে বের হলাম। মুরাদের ধারণা আগের বারগুলোতে হোটেল খুঁজতে আমি ভালো দরকষাকষি করতে না পারায় খরচ বেশি পড়ে গেছে। কাজেই এবার আমাকে আগেই বলে নিল যে "তুই কিন্তু কোন কথা কবু না"। তারপর দেখলাম মুরাদের নেগোসিয়েশন পাওয়ার। যে হোটেলের ভাড়া চায় ৩০০০ টাকা সেই হোটেলের ভাড়া মুরাদ অবলীলায় ২০০ টাকা বলতেছে এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হইল আমরা ১০০০ টাকার মধ্যেই তিনটা রুম নিয়ে নিছিলাম।
সেই রাত আমরা কক্সবাজারে থেকে ঠিক করলাম পরের দিন সেন্টমার্টিন যাব। কিন্তু জাহাজ ভাড়া তো অনেক বেশি কাজেই লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে টেকনাফ গেলে আমরা ৮০ টাকায় ট্রলারে সেন্টমার্টিন যেতে পারব। কথামতো আমরা লোকাল বাসে করে টেকনাফ গেলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ট্রলার ভাড়ায় চায় জনপ্রতি ১৫০ টাকা। এবার আবারও আমরা লোকজনের সাথে পরামর্শ করলাম এবং জানতে পারলাম শাহপরীর দ্বীপে গেলে আমরা জনপ্রতি ৫০ টাকায় সেন্টমার্টিন যেতে পারব। বাধ্য হয়ে আমরা ৪০০ টাকায় একটা জিপ ভাড়া করলাম। সেই জিপের ইঞ্জিন কিছুক্ষণ পরপরই বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমরা ঠেলা দিয়ে স্টার্ট করি। এরপর একসময় জিপ একেবারে থেমে গেল এবং আমাদের জানানো হলো জিপ আর যাবে না কারণ সামনে রাস্তা কাটা। তবে বললো সামান্য একটু হাঁটলেই শাহপরীর দ্বীপের জেটি ঘাট। আমরা হাঁটতে লাগলাম এবং প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটার পরে শাহপরীর দ্বীপের জেটি ঘাটে পৌছলাম।
জেটিতে গিয়ে শুনলাম সেদিনের মতো সব লোকাল ট্রলার ছেড়ে গেছে। আমাদের তো মাথায় বাড়ি। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে এবং আমাদের দুপুরে খাওয়া হয় নাই। আমরা কোনমতে কলা রুটি খেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং এমন একটা ভাব নিলাম যেন আমাদের কোন তাড়া নাই। কারণ একটা ট্রলারের সাথে আমাদের কথা হচ্ছিল এবং সে ৪০০০ টাকা ভাড়া চাচ্ছিল কিন্তু আমরা স্বভাবতই অত টাকা দিয়ে যাব না কারণ আমাদের বাজেট জনপ্রতি ৫০ টাকা এবং সেজন্যই আমাদের এত দূর আসা।
জেটি ঘাটে এক ভাইয়া এবং তার গার্লফ্রেন্ড/ওয়াইফ ছিলেন। উনারাও সেন্টমার্টিন যাবেন এবং ট্রলারে ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। কাজেই উনারাও আমাদের সাথে যাবেন। উনারা মোটামুটি চার হাজার টাকাতেই যেতে রাজি৷ আমরা (বিশেষ করে মুরাদ) দরকষাকষি করে ট্রলার ভাড়া ২২০০ টাকায় নামিয়ে নিয়ে আসলো এবং ঠিক হইল সেই ভাইয়া আর আপু ১৫০০ টাকা দিবেন এবং আমরা ১০ জনে ৭০০ টাকা দিব। এই চুক্তিতে আমরা ট্রলারে উঠে গেলাম হইহই করতে করতে।
ট্রলারে ওঠার কিছুক্ষণ পরে ট্রলার যখন খোলা সাগরে গিয়ে পড়ল তখন দুলুনির চোটে সবার অবস্থা বেগতিক হয়ে গেল। বিশেষ করে আমাদের দলের ছোটরা তো ভয়ে গামছা দিয়ে নিজের চোখ মুখ বেঁধে চুপচাপ শুয়ে রইলো। আমরা বড়রা অবশ্য ঠিকই ছিলাম। সন্ধ্যার আগে আগে আমরা সেন্টমার্টিন পৌঁছে গেলাম।
কক্সবাজারে গভীর রাতে হোটেল খোঁজার উদ্দেশ্য ছিল যে হোটেল ওয়ালা চিন্তা করবে অত রাতে নিশ্চয়ই কেউ হোটেল খুঁজতে আসবে না কাজেই যা ভাড়া পাবে তাই লাভ ভেবে কম ভাড়ায় রুম দিয়ে দিবে কিন্তু সেন্টমার্টিন এ আর লোক আসার কোন সম্ভাবনা নাই। জাহাজে যারা আসছে তারা ইতোমধ্যেই হোটেল বা কটেজ নিয়ে নিছে। কাজেই আমরাই শেষ মানুষ জন হিসেবে ৫০০ টাকায় দুই রুমের একটা কটেজ নিয়ে নিলাম। তবে শর্ত হইল যে আমাদের রান্নার জন্য বাসনকোসন দিতে হবে। সব আয়োজন করে আমরা সন্ধ্যার পর পর্যন্ত বিচে কাটালাম।
সেন্টমার্টিন গিয়ে সবাই বারবি কিউ করে টরে খায় এখন নিতান্তই শখের বশে কিন্তু আমরা নিজেরা রান্না করে খেতে চেয়েছিলাম নিজেদের খরচ বাঁচানোর জন্য এবং সেই রাতে এবং পরদিন সকালে এবং দুপুরে আমরা শুধু নিজেদের রান্না করা খিচুড়ি খেয়েই ছিলাম। রাতে অবশ্য কিছু ছোট সামুদ্রিক মাছ ধরছিলাম কিন্তু বিষাক্ত হতে পারে ভেবে খাই নাই ভয়ে।
পরদিন হেঁটে হেঁটে সেন্টমার্টিন ঘুরে আর ট্রলারে ফেরার হিম্মৎ হলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম জাহাজেই ফিরব। কিন্তু আমাদের যেহেতু টিকেট ছিল না কাজেই আবারও জাহাজের লোকদের পটিয়ে সম্ভবত জনপ্রতি ৫০ টাকায় টেকনাফ চলে আসলাম। টেকনাফ থেকে বাসে একেবারে চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে এসে ঢুকতে ঢুকতেই রাতের শেষ ট্রেন টা ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেল। আমরা তো বাসে যেতে পারব না কারণ অত টাকা আমাদের সাথে নাই। ঠিক হইল রাতটা স্টেশনে কাটিয়ে সকালের ট্রেনে ঢাকায় যাব। রাতে স্টেশনে চাদর বিছিয়ে আমরা কার্ড খেলতে লেগে গেলাম। আস্তে আস্তে একজন একজন করে ঘুমিয়ে যেতে লাগলাম এবং এরমধ্যেই কখন যেন আমাদের মধ্যকার একজনের মোবাইল ফোন চুরি হয়ে যায়। ফোন চুরি যাওয়ায় সকালে তো আমাদের খুব মন খারাপ। এছাড়া ট্রেন মিস করার কারণে আমাদের খাওয়ার খরচ বাড়ছে এবং আমাদের কাছে বেশি টাকা নাই কাজেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা এবার ট্রেনের ভাড়া দিব না এবং টিটিই এসে জিজ্ঞেস করলে বলব যে আগের স্টেশন থেকে উঠছিলাম।
এভাবে আমরা সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে থেকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে আসলাম। ভাগ্যের ব্যাপার হইল টিটিই একবারও টিকেট চেক করতে আসে নাই এবং আমাদের ভাড়াও দেওয়া লাগে নাই। কিন্তু গোল বাঁধলো এয়ারপোর্ট স্টেশনে নামার পরে। কথা ছিল আমরা কেউ মেইন গেট দিয়ে বের হব না। সবাই হাজী ক্যাম্পের ওখানের রেল গেট দিয়ে বের হব। কিন্তু আমাদের দুই ছোট ভাই মেইন গেট দিয়ে বের হয়ে আটকে যায় এবং আমরা তাদের ভৈরবের ভাড়া দিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করি।
এখানে একটা কনফেশন আছে। সেটা হইল ট্রেনে টিকেট ছাড়া ভ্রমণ করাটা অবশ্যই খুব খারাপ কাজ হইছে। তবে আগের রাতে ফোন হারিয়ে যাওয়ার রাগে ভাড়া না দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের ঐক্যমত্যকে আরও বুস্ট আপ করছে। কিন্তু আসল ব্যাপার হইল কেউ আমার কাছ থেকে ১০ টাকা চুরি করে নিয়ে গেছে বলেই আরেকজনের ৩ টাকা চুরি করা আমার জন্য জায়েজ হয়ে যায় নাই। কাজেই বিনা টিকেটে রেল ভ্রমণের সেই ব্যাপার টা এখনো আমার মনে একটা বড় অনুশোচনা হিসেবে রয়ে গেছে। আশা করি পাঠক আমাদের অল্প বয়সের এই ত্রুটি মার্জনা করবেন।
যাই হোক স্টেশন থেকে বের হয়ে আমাদের আর খাওয়ার ইচ্ছে হলো না এবং খাওয়ার টাকাও ছিল না। আমরা জনপ্রতি ৮০ টাকা করে একটা মফিজ গাড়িতে মিটিয়ে উঠে রাত দশটার পরে এলাকায় এসে নেমে যার যার বাসায় চলে গেলাম।
পরদিন সকালে বের হয়ে আমাদের যাওয়ার সময়ের সাথে মিলিয়ে দেখলাম যে রোদে পুড়ে চেহারা আর চেনা যায় না। এরপর হিসাব নিকাশ করে দেখলাম আমাদের জনপ্রতি ৪৩০০ টাকার মতন খরচ হইছিল। এভাবেই আমাদের ৬ রাত ৭ দিনের ট্যুরটা শেষ হইছিল। এরপর জীবনে অনেক বার অনেক জায়গায় ট্যুর দিছি কিন্তু এই ট্যুরের মত থ্রিলিং কোনটাই হয় নাই আর কোনদিন হবে বলে মনেও হয় না।