এই কিস্তির লেখায় আমি উদাহরণস্বরূপ বেশ কিছু তথ্য ও উপাত্ত উল্লেখ করছি যার মাধ্যমে আমরা সবাই কিছু না জানা বিস্ময়কর ও মজার অভিজ্ঞতা অর্জন করবো।
আমরা সবাই এই হিসেবটি কি জানি স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কতগুলো শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা লাভের পর কিছু দিন যেতে না যেতেই সিক ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে মোট কত টাকা ইনভেস্ট মার গেছে (যার একটা বড় অংশ ব্যাঙ্কের যা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে)? অনেক কঠিন হিসেব এবং এর সঠিক তথ্য সরকারের কাছে ও আছে কিনা সন্দেহ। যদিও একবার সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল (গত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ৯৭ সালের শেষের দিকে)। “রুগ্ন শিল্প পুনর্বাসন প্রকল্প” নামে একটি বিশেষ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল যেখানে FBCCI এর মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করা হয়েছিল বিশেষত সেই সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান দের কাছ থেকে যাদের অসীম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অনিবার্য কারনে সিক হয়ে ধুঁকছিল বিপুল খেলাপি ঋণ নিয়ে। সারা বাংলাদেশ থেকে অনেক আবেদন গৃহীত হয়েছিল এবং আমি এই কার্যক্রমের সঙ্গে স্বল্প মাত্রায় জড়িত থাকায় শেষের দিকে যতটুকু জেনেছিলাম বলা যায় একটা ভীতিকর পরিসংখ্যান আমার সামনে উপস্থিত হয়েছিল। এরপরে প্রকল্পের অবস্থা বাংলাদেশের আর দশটা প্রকল্পের মতোই কোথায় যে হারিয়ে গেলো, আলাদিনের চেরাগের যাদুর দৈত্য ও মনে হয় সেটা আর খুঁজে বের করতে পারবেনা। সেটাতো অনেক আগের কথা, এর পর পনের বছর কেটে গেছে এবং গত পনের বছরেও নিজের চোখেই দেখলাম কত ইন্ডাস্ট্রি সিক হয়ে গেলো।
এখন আমার মূল আলোচ্য বিষয়ে আসি। কেন ইন্ডাস্ট্রি গুলো সিক হয়ে যাচ্ছে বা যায়? একজন উদ্যোক্তা তো ভালো ভাবে জেনেবুঝে এনালাইসিস করে তার উদ্যোগ শুরু করেন/ ব্যাংক ও সঠিক যাচাই বাছাই করে ঋণ অনুমোদন করে ( সব ব্যাংক ঋণ এর কথা বলছিনা বিশেষ করে যেগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাবে অপাত্রে ঘি ঢালা হয়।) তারপর ও ব্যবসায়ে মার খেয়ে যান কেন? ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতা? বাজারজাতকরনে অদক্ষতা? আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিক ভাবে করতে না পারা ? চলতি মূলধনের ঘাটতি?
উপরে বর্ণিত যেকোনো একটি কারনেই একটি ইন্ডাস্ট্রি সিক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারী পর্যায়ের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গুলোর ক্ষেত্রে উপরোক্ত কারন গুলোর আগে আরেকটি রহস্য (রহস্য শব্দটি আমার মতে যুৎসই) বিরাজ করে যেটা কিনা এমন জটিলতা তৈরি করে যা সহজে অনেকে অনুধাবন করতে পারেননা এবং পরবর্তীতে দেখা যায় যে উপরে বর্ণিত যেকোনো একটি কারনের উদ্ভব ঘটছে। একটা কথা আমরা কম বেশী সবাই জানি , যুদ্ধ ও ব্যবসায় স্ট্রেটেজি আর লজিস্টিকস্ সাপোর্ট দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ যা একমাত্র মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বা বৃহদায়তনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গুলোর প্রয়োজনাতিরিক্ত থাকে যা তারা দরকারের সময় কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানদের পক্ষে সেরকম চিন্তা ও করা যায় না। এখন একটা উদাহরণ তথা কেস স্ট্যাডি উল্লেখ করি। আশা করছি এর মাধ্যমে আমি যে রহস্যের কথা বলছিলাম সেটা মোটামুটি ক্লিয়ার হবে সবার কাছে।
কেস স্ট্যাডি
অটোপার্টস ম্যানুফেকচারিং কোঃ (প্রাইভেট) লিঃ , ফৌজদারহাট শিল্প এলাকা, চট্টগ্রাম। ১৯৮৬ সনে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করে উৎপাদনে যায় ১৯৮৯ সনে। প্রাইভেট লিঃ কোম্পানি, মালিক ছিলেন দুইজন ৫০% শেয়ার বেসিস। একজন তৎকালীন রোডস্ এন্ড হাইওয়েজ এর নাম করা কন্ট্রাক্টর, অন্যজন শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব যিনি অবসর প্রস্তুতিকালিন ছুটিতে গিয়েছেন মাত্র। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিতব্য পণ্য ছিল অটোমোবাইলস স্পেয়ার পার্টস যার বাজার চাহিদা তুমুল কিন্তু পুরোটা আমদানি হয়। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন কন্ট্রাক্টর সাহেব যিনি তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় একজন পাকিস্তানী কনসালটেন্ট এর মাধ্যমে পুরো প্রোজেক্ট দাড় করান অতঃপর পূর্ব পরিচয়ের সুত্রে যুগ্মসচিবকে বিজনেসে এনগেজ করেন। দুজন মালিকের কারোরই এই প্রোজেক্ট বা এর টেকনিক্যাল নো হাউ সম্পর্কে কোন ন্যূনতম ধারণা ছিলনা। একটা নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে পাকিস্তানী সেই কনসালটেন্ট সবকিছু সম্পন্ন করে দেন তথাঃ ইন্ডিয়ার একটা কোম্পানি থেকে ম্যাশিনারি সংগ্রহপূর্বক তা প্রতিস্থাপন, ম্যানুফেকচারিং প্রসেস সম্পর্কে কর্মীদের প্রশিক্ষণ, ট্রায়াল প্রোডাকশন ইত্যাদি। টোটাল ফিক্সড কস্ট ছিল প্রায় ১.৫ কোটি টাকা। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন ডলারের মূল্য ছিল ৩৮ টাকা। শেষের দিকে টাকার টান পরে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ব্যাংকের দারস্থ হতে হয় এবং ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল মিটআপ করার জন্য যেটার ইন্টারেস্ট রেট ছিল ১৮.৫%, এক বছরে পরিশোধ যোগ্য, মাসিক কিস্তি প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির প্রোডাকশন কেপাসিটি যা ছিল তার ৫০% ইউটিলাইজ করতে ও মাসে খরচ দাঁড়াত প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো ( কষ্ট অব প্রোডাকশন+এডমিনিস্ট্রেটিভ এন্ড সেলিং এক্সপেন্স)। কোম্পানিটির প্রোজেক্টেড যে হিসাব ছিল তাতে তদের পার ইউনিট প্রোডাক্টের র-ম্যাটেরিয়াল কস্টিং ছিল ৪৫%(বেস অব সেলিং প্রাইস)। অর্থাৎ যেটা দেখা যাচ্ছে উক্ত কোম্পানিকে যদি প্রতি মাসে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে ও থাকতে হয় তাহলে প্রতি মাসে কমপক্ষে উৎপাদন ও বিজনেস করতে হবে প্রায় ১৮ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি তার জীবদ্দশায় এই পরিমান তো দূরের কথা এর ৫০% ও বিজনেস করতে পারেনি উৎপাদন যাই হোক। এর মধ্যে অনেক কেচ্ছা কাহিনী হয়েছে সব যদি বর্ণনা করতে যাই তাহলে ৫০ পৃষ্ঠা লিখতে হবে। এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত করুন। ১৯৯৮ সাল, ব্যাংকে দেনার পরিমান দাঁড়ালো ১.৫ কোটি টাকার উপর ( চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ সহ আসল, এই কবছরে কয়েকবার রিশিডিউল করা হয়েছিল এবং প্রায় ৪৩ লাখ টাকা রিপেমেন্ট ও করা হয়েছিল)। তার পর যা হবার তাই হয়েছে দেনার দায়ে মর্টগেজ করা সব সম্পদ আদালতের নির্দেশে নিলাম হয়েছে মালিকের বাসস্থান সহ। এই এত গুলো বছরে কোন মাসেই কোম্পানি প্রফিট তো দূরের কথা খরচই তুলতে পারেনি। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে সেই কোম্পানির প্রোডাক্টের কোয়ালিটি এবং প্রাইস যথেষ্ট আকর্ষণীয় ছিল। এখনো অনেক দোকান্দার/কাস্টমার APM SUPERIOR ব্র্যান্ডের কথা স্মরণ করে।
এখন আসুন পুরো বিষয়টা আমরা একটু এনালাইসিস করি । খোঁজ নিলে দেখা যাবে দেশের বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠান যে সিক হয়ে যায় তার কাহিনী অনেকটাই উপরোক্ত বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে মিলে যাবে কিছু ব্যাতিক্রম বাদে। ধরা যাক প্রতিষ্ঠানটির ফিক্সড কস্ট যদি হতো ৫০লাখ টাকা। অবাক হবেন না সেটা সম্ভব তখনো এবং এখনো। কিভাবে ? ওই পাকিস্তানী ব্যাটাতো কোন মতে প্রোজেক্ট গছিয়ে তার পাওনা টাকা নিয়ে চলে গেছে। সাধারণত এটাই হয় কারন আমরা যখন কোন ইন্ডাস্ট্রি করতে চাই তখন বাধ্য হয়েই বিদেশের কনসালটেন্ট দের সাহায্য নিতে হয় মোটা টাকার বিনিময়ে টেকনোলজি আর মেশিনারির জন্য। আর ওই ব্যাটারাও আমাদের অজ্ঞতার সুযোগ পেয়ে আমাদের যতবড় আইক্কাওয়ালা বাঁশ দিতে পারবে তত তাদের টাকা নেওয়ার পরিমান ও বাড়বে। তাদের তো আর চিন্তা করার দরকার নেই যে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু, কতটুকু খেয়ে আমরা হজম করতে পারব। আমরা প্রথমেই ১০০ টন প্রোডাকশন কেপাসিটির কথা চিন্তা না করে যদি ১০ টনের কথা চিন্তা করি তাহলে কি সুবিধা আমরা উপভোগ করবো। প্রথমত ফিক্সড কস্ট কম পড়বে, দ্বিতীয়ত মাসিক খরচ কম পড়বে , তৃতীয়ত মার্কেটে আস্তে আস্তে নিজের জায়গা মজবুত করতে পারব সব মিলিয়ে সারভাইভ করাটা সহজসাধ্য হবে। বর্ণিত প্রতিষ্ঠানটির কথা আরেকবার চিন্তা করি, যেটা বলছিলাম যদি তাদের ফিক্সড কস্ট ৫০ লাখ টাকা হতো তাহলে তাদের ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। প্রতি মাসে যে বিশাল খরচের বোঝা ছিল সেটা থাকতো না এবং আমি যতটুকু ইনফরমেশন জানি তারা জীবনভর যে উৎপাদন/ সেল করেছে তাতে প্রতি মাসে তাদের ১.৫ লাখ টাকা প্রফিট থাকত। যারা বুদ্ধিমান তারা আশা করি বুঝতে পারছেন রহস্যটা কি। এখন নিশ্চয় প্রশ্ন শুরু হবে আমরা তো কিছু জানিনা বুঝিনা আমরা কিভাবে কম টাকায় টেকনোলজি, মেশিন এসব ব্যবস্থা করবো ? এর উত্তর আমি পরের লেখায় দেবার চেষ্টা করব।
এখন সব চেয়ে মজার তথ্যটা দিয়ে দেই। আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আমার জীবনের প্রথম শেষ এবং একমাত্র চাকরি করি ওই প্রতিষ্ঠানে যার বর্ণনা দিয়েছি। এখন আমার নিজের মালিকানাধীন ওই টাইপের একটা ছোটখাটো ইন্ডাস্ট্রি আছে যেটার সব কিছু আমি নিজেই করেছি এবং যার ফিক্সড কস্ট মাত্র ৭ লাখ টাকা। চায়না থেকে বস্তার দামে প্রোডাক্ট এসে বাজার ভরতি। আমি তার চেয়েও ২৫% কম দামে বাজারজাত করছি। এরপর ও আমার সব খরচ বাদ দিয়ে নেট মার্কআপ থাকে ৩০%। জী না পাগলের প্রলাপ বকছি না বাস্তব সত্য। আজকে আপাতত শেষ করছি।
যেহেতু আমি লেখক নই তাই বাক্য গঠন বা বানান ভুলের জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।