
এক সময় দুর্নীতি ছিল নিন্দিত, ঘৃণিত—একটি লজ্জাজনক কাজ। সমাজে কেউ যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হতো, তাহলে সে মাথা নিচু করে চলতো। সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে তাকে দূরে রাখা হতো, তার পাশে বসা যেত না, এমনকি অনেক সময় আত্মীয়তা করতেও কেউ রাজি হতো না। কিন্তু আজ? দৃশ্যপট বদলে গেছে। দুর্নীতি যেন এখন একধরনের অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতিবাজরা আর সমাজচ্যুত নন, বরং তারা এখন সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন।
আজকাল দুর্নীতি করা এতটাই সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, শত কোটি টাকার নিচে কেউ যেন দুর্নীতিকে ‘সার্থক’ বলে ভাবতেই চায় না। দুর্নীতি এখন আর চুপিসারে, গোপনে হয় না। বরং প্রকাশ্যে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, সামাজিক ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে!
এক সময় দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করা হতো, আজ তাদের জন্য সমাজের মাঝখানের চেয়ারে সংরক্ষিত আসন রাখা হয়। আগে দুর্নীতিবাজদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাওয়া ছিল বিব্রতকর, এখন সেই বাড়িতেই সমাজের ইমাম সাহেবেরা উপস্থিত হয়ে দুই হাত তুলে তাদের জন্য কাঁদেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করেন! এর চেয়ে বড় নৈতিক বিপর্যয় আর কী হতে পারে?
এক সময় সমাজের সচেতন মানুষ দুর্নীতিবাজ ও সুদখোরদের চিনিয়ে দিতেন, দূরে রাখতেন। এখন মানুষ আত্মীয়তা গড়ার আগে দেখে নেয়—লোকটা কত টাকা রোজগার করে, সে কতটা ‘পাওয়ারফুল’, এবং দুর্নীতির টাকায় গড়া প্রাসাদে বাস করে কিনা। দুর্নীতিই যেন এখন সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার একটি সূচক হয়ে গেছে!
দুর্নীতি নতুন কিছু নয়—পৃথিবীর সব সমাজেই দুর্নীতি কমবেশি ছিল, থাকবে। তবে পার্থক্য এই যে, আগে দুর্নীতি ছিল গোপন, সংকুচিত এবং লজ্জাজনক; এখন তা হয়েছে দম্ভিত, গর্বিত এবং উৎসবমুখর। দুর্নীতির ‘পরিমাণ’ নয়, বরং ‘পদ্ধতি’ এবং ‘প্রভাব’ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এখন দুর্নীতি কেবল ব্যক্তি নয়, পুরো প্রজন্মকে কলুষিত করছে।
আসলে এই সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য আমরাই দায়ী। দুর্নীতিবাজকে সম্মান দিলে সে সাহস পায়। সামাজিকভাবে যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাকে দমানো যায় না। আমাদের নীরবতা, আমাদের মেনে নেওয়া, আমাদের দাওয়াতে আমন্ত্রণ জানানো—সবই দুর্নীতির পক্ষে একেকটি স্বীকৃতি।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থে দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করতে চাই, তাহলে আমাদের আগে সামাজিক ও নৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।
দুর্নীতিবাজকে ঘৃণা করা, সামাজিকভাবে একঘরে করা, তার ওপর সামাজিক চাপ তৈরি করা—এটাই হতে পারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হয়তো জটিল, কিন্তু সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা আমাদের হাতেই।
দুর্নীতিকে ‘সামাজিক স্বীকৃতি’ না দিয়ে, তাকে আবারও ‘সামাজিক ঘৃণার প্রতীক’ বানাতে হবে। আমাদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২৫ বিকাল ৩:১৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




