পলকের আজ মনটা বিশেষ ভাল নেই । পকেটে টাকা নাই, হাতেও তেমন কোন কাজ নাই । বাসায় থাকতেও মনটা সাড়া দিচ্ছে না । কিছু না ভেবেই তাই এই ভর দুপুরে পলক বের হয়ে গেল । সে এখন হাঁটবে, অনির্দিষ্ট সময় ধরে অজানা পথে হাঁটার মাঝে একধরণের নেশা কাজ করে । যত এগুবে ততোই এগুতে ইচ্ছে করবে । আজকাল পিছুটানবিহীন এই হাঁটা পলকের খুব একটা খারাপ লাগে না । হাঁটতে হাঁটতে মানুষের গতিবিধি নজরদারী করার মাঝে অনেক অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করা যায় । এইতো সেদিন রিক্সায় করে এই ছেলেটিকেই তো সে যেতে দেখেছিল, কিন্তু তার পাশে সেদিন এক সুন্দরী যুবতী বসেছিল যে আজ নেই । ছেলেটি খুব ব্যাকুল হয়ে মেয়েটিকে কি যেন বুঝানোর চেষ্টা করছিল আর মেয়েটি বারবার তাকে থামিয়ে দিচ্ছিল । রাস্তার লোকগুলোও এমনভাবে সেদিন তাদের দিকে তাকিয়েছিল যেন একটা ছেলে আর মেয়ে কথা বলাটা অন্যায়!! পলকের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করার... আচ্ছা কি জিজ্ঞেস করবে সে? অচেনা মানুষের সাথে কি হুট করেই কথা বলা যায়? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ছেলেটি নিজেই পলককে ডেকে উঠলো, “এক্সকিউজ মি, ভাইয়া প্রফুল্ল রোডটা কোন দিকে?” ছেলেটির জিজ্ঞাসু চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, “হুম!!! জানি না ভাই । আমি আসলে এই এলাকার কেউ না । চলুন একসাথে খুঁজে দেখা যাক ।” পলকের এরকম অদ্ভুত আচরণে ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল । এভাবে সেধে সেধে উপকার করতে আসা লোকজনের কাছ থেকে যে অপকার ব্যতীত উপকার কল্পনা করা যায় না তা যুগের প্রেক্ষিতে সবারই জানা হয়ে গিয়েছে । ছেলেটি যখন পলক সম্পর্কে এসব ভাবছে ততক্ষণে পলক প্রফুল্ল রোডের সন্ধান করে ফেলেছে । সামনের চায়ের দোকানের পাশের গলিটিই প্রফুল্ল রোড । এরকম অন্ধকারাচ্ছন্ন, নোংরা গলির নাম কীভাবে প্রফুল্ল রোড হয় তাই পলক ভেবে পাচ্ছে না । ছেলেটি তখনও পলকের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে । হঠাৎ পলকই বলে উঠলো,
-ভাই আপনার বোধহয় একটা জরুরী কাজ আছে । এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনার দেরি হয়ে যাবে ।
-ওহ হ্যা । তামান্নার বাসা ঐ রোডে । ও আমার উপর অনেক রাগ করে আছে । সকাল থেকে কথা বলছে না । আমি ওর বাসাটাও চিনি না, শুধু জানি প্রফুল্ল রোডের শেষ বিল্ডিংটাতে ওরা থাকে......
ছেলেটি হয়তো আরও কথা বলতো কিন্তু পলক তাকে আর কথা না বলার সুযোগ দিয়েই হাঁটা শুরু করলো । চিন্তাগ্রস্থ মানুষ অকারণে বেশি কথা বলে । কথা দিয়ে তারা তাদের চিন্তাকে সবার সামনে থেকে আড়াল করতে চায় কিন্তু তারা বুঝে না তাদের কথাতেই তারা অন্যের কাছে ধরা খেয়ে যায় । হয়তো ছেলেটি এখনো পলকের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই আছে কিন্তু পলক পিছু ফিরে সেই দৃশ্য দেখতে ইচ্ছুক নয় । মানুষের প্রতি মানুষের মায়া থাকা উচিত কিন্তু তা দেখানো উচিত নয় । ছেলেটির জন্য পলকের খুব মায়া হচ্ছে কিন্তু সে চায় না ছেলেটি তা বুঝুক ।
পলক আবার হাঁটা শুরু করলো । হাঁটতে হাঁটতে পলক এই শহরের অদ্ভুত মানুষগুলোর বিচিত্র চরিত্র নিয়ে ভাবতে লাগলো । সবাই কেমন যেন ছুটছে, যেন তাকে আগে যেতেই হবে! কেন ভাই দুটো মিনিট পরে গেলে কি হয়? সামনের বাস স্ট্যান্ডটা ফাঁকা মনে হচ্ছে । সেখানে বসে বসে এই অদ্ভুত মানুষগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে খুব একটা মন্দ হবে না । এই সময়টাকে ঠিক কি বলা উচিত হবে তা পলক বুঝে উঠতে পারছে না । ঠিক দুপুরও না, আবার বিকেলও না । দুটোর মাঝামাঝি বলা যেতে পারে । পুরো যাত্রী ছাউনির নিচে সে একা বসে আছে । রাস্তায় মানুষজনও হঠাৎ করে কমে গেল । আচ্ছা এই সময়টাতে পলক বাসায় থাকলে সে কি করতো? পলকের তো নির্দিষ্ট কোন সময়সূচী নেই তাই সে ভেবে উঠতে পারছে না সে এই সময়টাতে কি করতো । পায়ের উপর পা তুলে, দেয়ালে হেলান দিয়ে একটু আরাম করে বসা দরকার । সকাল থেকে না খেয়ে থাকার কারণে রাগ করে পেট পলকের সাথে কথা বলছে না । আচ্ছা একদিন হাওয়া খেয়ে দেখা যাক তো পেট ভরে নাকি!! যাত্রী ছাউনির নিচে চোখ তাকাতেই পলক খেয়াল করলো এক জায়গায় পায়খানা পড়ে রয়েছে । আবার সে পায়খানার উপর কার যেন পায়ের ছাপ । মেঝের এক অংশ পুরো লেপ্টে আছে পায়খানাতে । কিন্তু কোন গন্ধ আসছে না কেন ল্যাপ্টানো পায়খানা থেকে । বেশ কয়েকটা মাছি বসে আছে দুর্গন্ধহীন ঐ পায়াখানার উপর । এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পলক একসময় খেয়াল করলো কয়েকটা মাছি ঐ পায়খানা থেকে উড়ে সরাসরি তার গায়ের উপর এসে বসেছে । কি জঘন্য ব্যাপার ভেবেই পলকের গা শিউরে উঠলো । কিন্তু পলক মাছিগুলোকে তাড়ানোর জন্য কোন আগ্রহ দেখালো না । সে ভাবছে মাছিগুলোর ব্যাপারে... এরা কেন তার গায়ের উপর এসে বসলো? এদের মনে কি ভয়-ডর বলতে কিছু নেই? অবশ্য মাছির আবার মন আসবে কোথা থেকে? বাংলা দ্বিতীয় পত্র বই এর ভাবসম্প্রসারণ অনুযায়ী তো মাছির মন না থাকারই কথা । মন থাকবে শুধু মানুষের, অন্য কোন পশু পাখির নয় । প্রাণ থাকিলেই প্রাণি হওয়া যায়, কিন্তু মন না থাকিলে মানুষ হওয়া যায় না......