একটা গল্প লিখবো বলে জমাট স্তূপ করে রাখা বইয়ের তাক থেকে ধুলোর আস্তরণ জমে থাকা লাল মলাট করা ভারী খাতাটা টেনে নিলাম । কলমের মাথাটা দাঁত দিয়ে চিবোতে চিবোতে ভাবছিলাম কি লিখবো । হঠাৎই মনে পড়ে গেল আজিজের কথা । তেজগাঁও রেললাইনের পাশের বস্তিতে থাকা সেই ছেলেটি কি এখনো সেখানেই আছে নাকি ট্রেনে করে সে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে আমি জানি না! তার ইচ্ছে ছিল এই রেল পথের শেষ সীমান্ত দেখা । আমি তাকে বলেছিলাম এর কোন শেষ নেই কারণ পথের শেষে আবার শুরুতেই ফিরে আসবে! কিন্তু একরোখা ছেলেটি আমার কথা মানতে নারাজ!!! সে এই পথের শেষ দেখেই ছাড়বে!!! তার বড্ড ঘুড়ি উড়ানোর শখ ছিল... উড়ন্ত ঘুড়ির দিকে চোখ রেখে রেলের পাতের উপর দিয়ে তার অভিজ্ঞ পদযুগলের যাত্রা ছিল অনেকটা সার্কাস দেখার মতো! ছোট ছোট পায়ে সে হেঁটে যেত মাইলের পর মাইল ।
আমি তার লাশ দেখতে গিয়েছিলাম । একদিন ঘুড়ি উড়াতে গিয়েই সে রেলে কাটা পড়েছিল । আজিজের ছোট্ট নিথর দ্বিখণ্ডিত দেহ আমাকে কাঁদাতে পারে নি কারণ আমি কাপুরুষের মতো লুকিয়ে সেখান থেকে চলে এসেছিলাম । তার আর রেললাইনের শেষটা দেখা হয় নি । হয়তো আজিজ বেঁচে থাকলে একদিন রেলের শেষ সীমান্ত বের করে আমার যুক্তিকে হারিয়ে দিত...
আমি ১৪ বছরের সেই কিশোরীর কথা বলবো । টিনের দরজা দিয়ে চেহারাটা একটু বের করে আমার দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ফরিদা বোধহয় আমাকে সেদিন কিছু বলতে চেয়েছিল! তার অসহায়ের মতো সেই চাহনিতে আমি সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম । নির্বাক হয়ে, অপলক দৃষ্টিতে আমি তার চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম । সে কি আমাকে কিছু বোঝাতে চেয়েছিল? বোঝাতে চাইলেও এখন আর তা বোঝানো সম্ভব নয় । সেদিন তার মা বললো ফরিদার পেটের বাচ্চাটি উল্টে গিয়েছে! পাষণ্ড স্বামীর অমানসিক নির্যাতনে হয়তো তার খুব ক্ষোভ এই পৃথিবীর প্রতি! আমার একবার খুব ইচ্ছে করে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে কিন্তু পরক্ষনেই আমি নিজেকে সেই ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে আনি । থাকুক না যে যার মতো আছে সেখানেই...
আমার রুদ্র নামের সেই যুবকটির কথা মনে পড়ে গেল যার ঝাঁকড়া চুল আর পাঞ্জাবিতে এক বিদ্রোহী ভাব ফুটে উঠতো । কিন্তু সে বলত চুল কাটার পয়সা নেই বলেই তার চুলের এই দশা, নাহয় মাথায় কে এই উটকো জঙ্গলের বোঝা নিয়ে ঘুরে! তার ডান কাঁধে ঝোলানো পাটের থলেতে কি আছে তা আমি কখনো দেখতে পারি নি । একবার টঙে বসে আমরা রংধনু দেখছিলাম । রুদ্র আমাকে বলেছিল সৃষ্টিকর্তা নিজে রংধনু সেজে পৃথিবীর মানুষগুলোকে দেখতে আসে । আর তাই তার সৃষ্ট মানুষগুলো রংধনুর মতো বর্ণিল এবং বৈচিত্রময় । আমি তার কথার কোন প্রত্যুত্তর দেই নি, কারণ আমি তখন রংধনুর সৌন্দর্য্য অবলোকনে ব্যস্ত ছিলাম । অনেকদিন রুদ্রর কোন দেখা নেই । তবে ভাবছি তার দেখা পেলে রংধনু নিয়ে তার সাথে আবার কথা বলবো । দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে রুদ্র হয়তো তার অদ্ভুত যুক্তি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু...
ভেবেছিলাম গল্প লিখবো কিন্তু এসব কি শুরু করে দিলাম! জীবন আমার দিকে তার মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে অট্টিহাসি হাসছে । নির্মম বাস্তব আর জাগতিক নানা অসংগতি আমাকে গল্প লিখতে বাধা দিচ্ছে আর সেই সুযোগে প্রকৃতি নিজেই আমাকে নিয়ে গদ্য লিখায় মেতে উঠেছে! আমি হেরে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি.....