ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী একটা জেলা থেকে ঢাকায় আসবো । তুমুল বৃষ্টির মাঝে বাসের জন্য অপেক্ষা করার পর অবশেষে দ্বিগুণেরও একটু বেশি ভাড়া দিয়ে অনেক হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠলাম । বাসের চিত্র এককথায় খুবই ভয়াবহ । কাদাপানিতে ডুব দিয়ে এসে বোধহয় লোকে বাসে চড়েছে । কিছুদূর চলার পর হেলপার সাহেব সম্মান করে জানালার পাশে আমাকে একটা আসন দিলো । আহ!!! যাক এবার বাহিরে তাকিয়ে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া যাবে । কিন্তু আমার সে আশায় যেনো গুঁড়েবালি । পাশে বসা লোকটির দিকে তাকিয়ে আমি জাস্ট চুপষানো বেলুনের মতো হয়ে গেলাম । এই বর্ষায় লোকটি একটি পাটের বস্তার মতো মোটা শাল গায়ে জড়িয়ে বসে আছেন আর একটু পর পর যক্ষ্মা রোগীর মতো কাশছেন । ব্যাপারটা এতটুকু পর্যন্ত হলে ঠিক ছিল কিন্তু যখন দেখলাম তিনি যতবার কাশছেন ততবার আমার উপর দিয়ে গিয়ে জানালায় থু থু করে একগাদা কফ ফেলছেন তখন নিজের ভিতরটা কেমন যেনো শিরশির করে উঠলো । এমনিতেই চলন্ত বাসে থুথু ফেললে তা চারিদিকে ছড়িয়ে যায় তাই এই ভয়ে আমি বেশ ভীত ছিলাম কখন না জানি আমার গায়ে এসে পড়ে!! অগত্যা আর কোন উপায় না পেয়ে জানালার পাশের আসনের মায়া ত্যাগ করতে হলো । কানে চুপচাপ এয়ারফোন গুঁজে বাকি রাস্তাটুকু কাটিয়ে দিবো এই সিদ্ধান্ত নিলাম । কিন্তু প্রবাদে আছে অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায় । বীজগণিতের নিয়মানুযায়ী মনে করি আজকের অভাগা হলাম আমি । আর প্রবাদের সত্যতা প্রমাণ করতেই যেনো পাশের আসনের বাচ্চা মেয়েটা গাড়ির মধ্যে গড়গড় করে বমি করা শুরু করে দিলো । ভুলে একবার সেই বমির দিকে চেয়েছিলাম আর ঐ ভুলের মাশুল আমাকে গুণতে হলো নিজের মাথা চক্কর দেওয়ার মধ্য দিয়ে । বাসের হেলপার বমি পরিষ্কার করার আগ পর্যন্ত আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল । এরপর বেশ কিছুটা পথ কোনরকম ধকল ছাড়াই কেটে গেলো । কিন্তু কপালে বোধহয় আজ আমার সুখ লিখা ছিল না । সামনের আসনের লোকটা তার জুতোজোড়া খুলে পা’দুটো ভাঁজ করে উঠে বসলেন । খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা বলতেই পারেন যদি না আপনি সেখানে তার মোজা থেকে আসা গন্ধ নাকে পেতেন । পুরো বাসের মধ্যে অতি দ্রুত ব্যাপন প্রক্রিয়ায় সেই চিকামরা গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো । আমি পারলে বাস থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ে যেতাম কিন্তু তার আগেই এক সাহসী ভদ্রলোক ঐ মোজাওয়ালা লোকটিকে জুতো পড়ার অনুরোধ করেন দেখে বেঁচে গেলাম । এক দিনে এত ধকল নেওয়ার মতো সহ্যক্ষমতা কীভাবে আমার হলো তাই বুঝতে পারছিলাম না । বেশ ক্লান্ত হয়ে যখন ঢাকায় প্রবেশ করলাম তখন ঢাকার চিরচেনা ট্রাফিক জ্যাম আমাকে তার প্রেমে সাড়া দিতে বললো । প্রেম হবে আর তার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক থাকবে না এ কি করে হয় বলুন? আবার আসি পাশের সেই লোকটির কাছে । জ্যামে বদ্ধ বাসে বসে বোধহয় তিনি বেশ অশান্ত হয়ে গিয়েছিলেন । তাই বুকপকেট থেকে একটা বড় চায়নিজ মোবাইল বের করলেন । ভাবলাম বাড়িতে বউ-বাচ্চা রেখে এসেছেন তাদের সাথে বোধহয় কথা বলবেন । কিন্তু তিনি নিজ দায়িত্বে পুরো বাসের বিনোদনের জন্য যে কাজটি করলেন তা হচ্ছে লাউডস্পিকারে যাত্রাপালার গান ছেড়ে দিলেন । আহা সে কি লাইন রে বাবা... অবচেতন মনে এখন পর্যন্ত গানের লাইন বেজেই চলছে-
“মনের দহনে হইলাম পুইড়া ছাড়খার,
ও বন্ধু তুমি ফুঁ দিয়া নিভাইয়া যাও এ আগুন ।”
শেষ পর্যন্ত আর কোন অঘটন না ঘটিয়ে বাস স্টেশনে পৌঁছালো । যাবজ্জ্বীবন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বাদ আমি পাই নি, নির্বাসনের পর আপন গৃহে আসার আনন্দও আমি পাই নি কিন্তু আমি আজ বাস থেকে নেমে যে সুখ পেয়েছি তা এগুলোর থেকে কোন অংশে কম নয় বলে আমি দাবি করতে দ্বিধাবোধ করবো না ।
আমরা সাধারণ জনগন নিয়মিতই পাবলিক বাসে চলাচল করি । তাই নূন্যতম মানবিক এবং সাধারণ জ্ঞান থেকে যদি আমরা অন্যদের ডিস্টার্ব হয় এমন কাজ না করি তাহলে হয়তো বাস ভ্রমণের অভিজ্ঞতাগুলো এত ভয়াবহ হতো না ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:৩৩