ইতিহাসের সবচেয়ে নমনীয় চরিত্রগুলোর অন্যতম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম রাষ্ট্রপতি জন ফিট্জেরাল্ড কেনেডি বা জন এফ. কেনেডি। তিনি ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সালে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। একজন রোমান ক্যাথলিক হিসেবে কেনেডিই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি তিনি কম বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করেন। সবার প্রিয় রাষ্ট্রপতি এফ কেনেডির মৃত্যু হয়েছে ৫০ বছর আগে, অথচ অনেকের কাছে এখনো তিনি অনুসরণীয় আদর্শ যাঁকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বহু প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেছেন, আবার চলেও গেছেন। খুব কমসংখ্যক প্রেসিডেন্টকেই মানুষ মনে রেখেছে। মনে রাখা প্রেসিডেন্টদের তালিকায় বেশ ওপরের দিকেই ঠাঁই করে নিয়েছেন ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই, বানানো হয়েছে চলচ্চিত্র এর পরও যেন তাঁকে নিয়ে জানার তৃষ্ণা মানুষের শেষ হয় না। বেঁচে থাকতে যতটা জনপ্রিয় ছিলেন, মৃত্যুর পরও ততটাই শ্রদ্ধার আসনে আসীন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও সবার প্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির আজ ৯৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬৩ সালের আজকের দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডালাসে আতাতায়ীর গুলিতে নিহত হন। মৃত্যুর শীতল ছায়ায় মানুষটি বিলীন হয়েছেন ৫১ বছর আগে, কিন্তু অনেকের কাছে এখনো তিনি অনুসরণীয় আদর্শ। অনেক কথা অনেক গুঞ্জনের সূত্র ধরে তিনি এখন পৌরাণিক কাহিনিসম ব্যক্তি, ইতিহাসের সবচেয়ে নমনীয় চরিত্রগুলোর একজন, যাঁকে নিয়ে গল্পের কোনো শেষ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
জন ফিট্জেরাল্ড কেনেডি বা জন এফ. কেনেডি (John Fitzgerald Kennedy) ১৯১৭ সালের ২৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের ব্রুকলিনে ৮৩ বিলস স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন। কেনেডির পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন আয়ারল্যান্ড থেকে। তাঁর পিতা জোসেফ প্যাট্রিক কেনেডি এবং মা রোজ ফিটজেরাল্ড।কেনেডির বাবা ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কেনেডি তাঁর জীবনের প্রথম ১০ বছর অতিবাহিত করেন ব্রুকলিনে। সেখানেই শৈশবের পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বরে পরিবারের সঙ্গে কেনেডি পাড়ি জমান নিউইয়র্ক সিটির রিভারডেলে। এর দুই বছর পর তাঁরা বাসা বদল করে চলে আসেন নিউইয়র্কের ব্রোঙ্কসভিলে। এরপর ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি হার্ভার্ড কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৪০ সালে কেনেডি 'আপিসমেন্ট ইন মিউনিখ' শীর্ষক থিসিস এবং গ্রজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পিতা জোসেফ পি. কেনেডি, সিনিয়র, এর উৎসাহ আর সহযোগিতায় তিনি রাজনীতিতে আসেন এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত ডেমক্রেটদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫২ সালে কেনেডি সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির মাঠে তাঁর গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনকেও গুছিয়ে নিতে দেরি করেননি। জ্যাকুলিন লি বেভিয়ার নামের এক মহিলা সাংবাদিককে ১৯৫৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বিয়ে করেন কেনেডি। জন এফ কেনেডির স্ত্রী জ্যাকুলিন লি বেভিয়ার ছিলেন সত্যিকার অর্থেই সুন্দরী ও মোহনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বিয়ের পরবর্তী সময়ে অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো ও প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে জড়িয়ে অনেক কিছু শোনা গেলেও জন ও জ্যাকুলিন ছিলেন স্পষ্টতই সুখী দম্পতি।
(জন এফ কেনিডি এবং ত্রী জ্যাকুলিন লি বেভিয়ার)
১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি সিনেটে ডেমক্রেটদের প্রতিনিধিত্ব করেন। কেনেডির গুণমুগ্ধদের কাছে তিনি ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী। ক্যারিশম্যাটিক নেতা বলতে যা বোঝায়, তা-ই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বাঁচিয়েছেন। বর্ণবাদে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রকে এক সুতোয় গাঁথতে তিনি কাজ করেছেন। ১৯৬০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তৎকালিন উপ-রাষ্ট্রপতি এবং রিপাবলিকান প্রাথী এবং ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির হোতা রিচার্ড নিক্সনকে পরাজিত করে মার্কিনিদের দুঃস্বপ্নের ইতি টেনেছিলেন। একজন রোমান ক্যাথলিক হিসেবে কেনেডিই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি তিনি কম বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করেন। তিনি থিওডর রুজভেল্ডের পর আমেরিকার নির্বাচিত দ্বিতীয় কনিষ্টতম আইরিশ আমেরিকান রাষ্ট্রপতি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কেনেডি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর আগে থিওডোর রুজভেল্ট ৪২ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুবক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন কেনেডি। কেনেডিই একমাত্র আমেরিকান রাষ্ট্রপতি যিনি পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মাত্র তিন বছর পর ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর টেক্সাস স্টেটের ডালাসে ডালাস নগরী দিয়ে ছাদ খোলা গাড়িতে করে সস্ত্রীক যাওয়ার পথে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন ৪৬ বছর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কম বয়সী ও সুদর্শন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। সাবেক মেরিন সেনা লি হার্ভে অসওয়াল্ড নামের এক স্নাইপার তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের বর্ণনায় সেদিনটি ছিল শুক্রবার, ঘটনা ঘটে স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১২টায়। তবে তার এ মৃত্যু নিয়ে মার্কিনিদের মধ্যে রয়েছে নানা কিংবদন্তী। এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশ মার্কিন মনে করে, কেনেডি হত্যার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। এ তত্ত্বটি বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে গঠিত ওয়ারেন কমিশন ওসব কিংবদন্তির কোনো ভিত্তি খুঁজে পায়নি। সর্বশেষ ৫০ বছর পর এক প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক বলেছেন তিনি যা চাক্ষুস দেখেছেন বেশিরভাগ মার্কিনির বিশ্বাসের সাথে তার কোনো মিল নেই। মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মার্ক গ্লিন বলেছেন, ৫১ বছর আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসরাইল জড়িত ছিল। ইরানের ইংরেজি নিউজ চ্যানেল প্রেস টিভিকে দেয়া সাক্ষাতকারে এ কথা বলেছেন তিনি। মার্ক গ্লিন বলেন, অবস্থানগত এবং আনুষঙ্গিক জোরালো আলামত এবং তথ্য-প্রমাণ কেনেডি হত্যাকাণ্ডে ইসরাইলের জড়িত থাকারই প্রমাণ বহন করে। কেবল মার্কিন কংগ্রেস বা নির্বাহী বিভাগ নয় সেইসঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলিতেও ইসরাইলি লবি তৎপর রয়েছে বলেও জানান তিনি। মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে ইচ্ছুক এমন এক প্রেসিডেন্টকে তারা হত্যা করেছে বলেও জানান তিনি। গ্লিন বলেন, মার্কিন সরকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি মহল এ ভয়াবহ কাজে সহায়তা করেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আলামত থেকে বোঝা যাচ্ছে, জন এফ কেনেডি এবং তার ভাই রবার্ট কেনেডির হত্যার সঙ্গে ইসরাইল জড়িত। উল্লেখ্য তাঁর ছোট ভাই রবার্ট এফ কেনেডি ১৯৬৮ সালের ৫ই জুন গুপ্তহত্যার শিকার হন এবং একদিন পর কেনেডি হাসপাতালে মারা যায়। ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন প্রার্থী হওয়াতেই আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন।
মার্কিন সরকারি তদন্তে কেনেডি হত্যার জন্য সাবেক মেরিন সেনা লি হার্ভে অসওয়াল্ডকে দায়ী করা হলেও এ হত্যা রহস্য এখনো পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি। কারণ দুইদিন পরেই জ্যাক রুবি নামক একজনের গুলিতে হার্ভি নিহত হয়। এফবিআই, ওয়ারেন কমিশন এবং হাউস সিলেক্ট কমিটি তদন্ত অনুসারে অসওয়াল্ডই ছিল কেনেডির আততায়ী। তবে তার হত্যাকাণ্ডে যে কেবল মাত্র এক ব্যক্তি জড়িত ছিল তা আজও অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। কেনেডির ইতিহাসভিত্তিক জীবনী নিয়ে পরিচালিত এক জরিপে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদক জিল আব্রামসন বলেন, কেনেডিকে নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে, এর কোনোটাই তাঁর সেরা জীবনী নয়। এখনো তাঁর জীবনের অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেনেডি তাঁর আড়াই বছরের শাসনামলে নাগরিক অধিকার নিয়ে নানা কাজ করলেও ওই বয়সে বড় ধরনের কোনো সামাজিক পরিবর্তন তিনি চাননি। কারণ তাঁর মনে ভয় ছিল, ওই বয়সে এত বড় একটি কাজ করতে গেলে তাঁর দল ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নারীর প্রতি দুর্বলতা তাঁকে রাষ্ট্রের প্রতি আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যখন সর্বতোভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তখন কেনেডি তাঁর সামরিক উপদেষ্টা কমিয়ে ফেলেন। এটা ওই যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার অংশ ছিল, না পালিয়ে আসার উদ্দেশ্যে ছিল, তা স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর জেসি ভেনচারা তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘দে কিল্ড আওয়ার প্রেসিডেন্ট’-এ কেনেডি হত্যার পেছনে ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, কেনেডিকে হয়তো এ কারণে হত্যা করা হয়েছিল যে, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় যেতে চেয়েছিলেন এবং কিউবার সঙ্গে বে অব পিগসের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সেনা কর্মকর্তা-ব্যবসায়ী-আইনপ্রণেতাদের ভয়ংকর লেনদেনের চক্রকে ভাঙতে চেয়েছিলেন।
ভেনচারা তাঁর বইয়ে বলেন, ‘আমি মনে করি, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশজুড়ে কেনেডির যত শত্রু ছিল, তার চেয়ে নিজ সরকারের ভেতরে শত্রুর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।’ তিনি বলেন, জন কেনেডি ছিলেন আধুনিক মার্কিন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। কল্পনা করে দেখুন, কেনেডি বেঁচে থাকলে দুনিয়াটা কত ভিন্ন রকম হতো। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও স্নায়ু যুদ্ধ হতো না। বাজি ধরে বলতে পারে, আজ আমরা দারুণ এক পৃথিবী পেতাম।’ এমন জনপ্রিয় একজন রাষ্ট্রনায়কের মৃত্যুর ক্ষত তাঁর গুণমুগ্ধরা এখনো শুকাতে পারেননি। আজ প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ৫২তম মৃত্যুৃবার্ষিকী। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সাবেক রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১৪