somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক সমরেশ বসুর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১২ ই মার্চ, ২০১৯ রাত ৮:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


খ্যাতিমান ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু। যাঁদের লেখনী বাংলা গদ্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, বলা যেতে পারে পরিপক্ব করেছে সমরেশ বসু সেই শীর্ষ সারির প্রতিভাবান লেখকদের একজন। বিচিত্র স্বাদের বহু উপন্যাসের জনক তিনি। বাংলা কল্পকাহিনীরও প্রথম সারির লেখক তিনি। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। কালকূট মানে তীব্র বিষ। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', সাম্ব, 'কোথায় পাব তারে'সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। 'কালকূট' ছদ্ম নামে লেখা "সাম্ব" উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০সলের অকাদেমি পুরুস্কার পেয়েছিলেন | বিশিষ্ট এই ঔপন্যাসিক ১৯৮৮ সালের আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। কথাসাহিত্যিক সমেরেশ বসুর মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।


কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত রাজনগর গ্রামে পৈতৃক বাস্তু ভিটায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মোহিনী মোহন বসু। মায়ের নাম শৈবলিণী বসু।সমরেশ বসুর জন্মের সময় বাবার এক মাসিমা সদ্যজাত সমরেশকে দেখতে এসে বলেছিলেন, ‘এযে তড়বড় কইরা আইয়া পড়ল’। এতেই ডাক নাম দাঁড়াল ‘তড়বড়ি’। পরে উচ্চারণ পরিবর্তে তরবরি। বাবার দেওয়া নাম ‘সুরথনাথ’। সমরেশ বসুর শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। ১৯৪৩-৪৯ সাল পর্যন্ত ইছাপুরের কামান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যেও লেখালেখিই ছিল তাঁর একমাত্র পেশা। নিজ আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি তিনি। এক সময় ট্রেড ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি অবৈধ ঘোষিত হলে ১৯৪৯-৫০ সালে তাকে জেল খাটতে হয়েছিল। জেলে অবস্থানকালে তিনি প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ লিখেন। মুক্ত হয়ে সমরেশ বসু লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেন। ২১ বছর বয়সে উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’ লিখেন। তার প্রথম ছোটগল্প ‘আদাব’।


(১৯৬৬-৬৭ সালে দীঘায় স্ত্রী ধরিত্রী বসুর সঙ্গে সমরেশ বসু)
সমরেশ বসু জীবনকে যেমন বহুভাবে বহু দিক থেকে দেখেছেন, তেমনি সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছেন সেভাবে। 'সাহিত্যের যা কিছু দায় সে তো জীবনের কাছেই'-এই ছিল সমরেশ বসুর কথা। তাঁর বই যে খুব বেশি বিক্রি হতো তা নয়। খুব যে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি এমনও বলা যাবে না। তবু কয়েক দশক ধরে সিংহের মতোই তিনি বিচরণ করেছেন সাহিত্যের অঙ্গণে। সমরেশ বসু নিজ নামে এবং কালকূট ছদ্মনামে ২০০ ছোটগল্প এবং ১০০ উপন্যাস রচনা করেন। তার প্রকাশিত গল্প ও উপন্যাস সমূহঃ উত্তরঙ্গ, গঙ্গা, বিবর, প্রজাপতি, দেখি নাই ফিরে, সওদাগর, কোথায় পাবো তারে, নয়নপুরের মাটি, বাঘিনী, চলো মন রুপনগরে, পাতক, মুক্তবেণীর উজানে, টানাপোড়েন, স্বীকারোক্তি, অপদার্থ, সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা, যুগ যুগ জীয়ে, মহাকালের রথের ঘোড়া, শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে, বাঘিনী, বিপর্যস্ত, শাম্ব, বিটি রোডের ধারে, শ্রীমতি কাফে, অবশেষে, আম মাহাতো, কামনা বাসনা, কে নেবে মোরে, খন্ডিতা, গোগোল চিক্কুস নাগাল্যান্ড, ছায়া ঢাকা মন, জঙ্গল মহলের গোগোল, জবাব, তিন পুরুষ, দাহ, নাটের গুরু, নিঠুর দরদী, পথিক, প্রাণ প্রতিমা, বাঘিনী, বিদেশী গাড়িতে বিপদ, ভানুমতী ও ভানুমতীর নবরঙ্গ, মহাকালের রথের ঘোড়া, রক্তিম বসন্ত, শিমুলগড়ের খুনে ভূত, সেই গাড়ির খোঁজে, স্বর্ণচঞ্চু, হৃদয়ের মুখ ইত্যাদি।


" গঙ্গা " সমরেশ বসু রচিত শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম একটি ধ্রুপদী বাংলা উপন্যাস। আর্থ-সামাজিক কাহিনির সঙ্গে প্রচুর উপকথা-মিথের ব্যবহার এই উপন্যাসকে বিশিষ্টতা দান করেছে। এই উপন্যাসটি লেখক তথা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা বলে বিবেচিত হয়। দেশ পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ২৪টি বাংলা উপন্যাসের তালিকাতেও স্থান পায় গঙ্গা। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত নদীকেন্দ্রিক এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয় দক্ষিণবঙ্গ, বিশেষত অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের (মাছমারা) জীবনসংগ্রামের কাহিনি।
কাহিনি-সারাংশঃ


গঙ্গা উপন্যাসের নায়ক তেঁতলে বিলাস (অর্থাৎ, তেঁতুলতলার বিলাস)। তার বাপ নিবারণ সাঁইদার ছিল দুঃসাহসী মালো মাছমারা। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে নিবারণ প্রাণ হারায়। বিলাস তখন মাতৃগর্ভে কিংবা সদ্যোজাত। বড় হয়ে বিলাসের চেহারাও হয় তার বাপের মতো সুদর্শন সুপুরুষ:
কালো কুচকুচে রঙ, পেটানো শরীর। নেহাইয়ের মতো শক্ত। যেন নিমকাঠের কালো রঙ মাখা চকচকে মূর্তি। নাকটি ছোট। চোখদুটি ঈষৎ গোল। ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলে তাকালে মনে হয়, কেউটে সাপ যেন ফণা ধরে আছে। …সবাই জানে, রগচটা আর গোঁয়ার। গায়ে শক্তিও তেমন।
সে মাছ মারতে শেখে তার কাকা পাঁচুর কাছ থেকে। সুন্দরবন অঞ্চল থেকে প্রতি বছর বর্ষায় কলকাতা-সন্নিহিত অঞ্চলে হুগলি নদীতে মাছ ধরতে আসত তারা। এখানে পাইকার দামিনীর সঙ্গে আলাপ হয় বিলাসের। ভালবাসা হয় দামিনীর নাতনি হিমির সঙ্গে। উভয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন ও মাছমারাদের সুখদুঃখের কর্মজীবনের ধারা বেয়ে প্রবাহিত হয় কাহিনি। নদীবক্ষেই মৃত্যু হয় পাঁচুর। মৃত্যুর পূর্বে সে হিমি ও বিলাসের মিলনে সম্মতি জানিয়ে যায়। তারপরেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধেয়ে আসে নদীতে। সেবারের জন্য কপাল খুলে যায় মাছমারাদের। অবশেষে মিলন হয় হিমি ও বিলাসের। কিন্তু বিলাসকে ধরে রাখতে পারে না হিমি। বিলাস বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রযাত্রার উদ্দেশ্যে। উপন্যাস শেষ হয় এইভাবেঃ
ঢেউ লেগেছে রাইমঙ্গল আর ঝিল্লের মোহনায়। কালীনগর গঞ্জ থেকে চাল ডাল নুন তেল যোগাড়যন্ত্র হয়েছে। সাঁইদারের অপেক্ষা।
- সাঁইদার কে?

- বিলেস। তেঁতলে বিলেস।
তেঁতলে বিলেস সমুদ্রে যায়।"


(Sunil Gangopadhyay, unidentified, Dwijendranath Basu,
and Samaresh Basu (London, 1986
)
বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল ক্ষণজন্মা লেখক সমরেশ বসু ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। মৃত্যুকালেও তার লেখার টেবিলে ছিল ১০ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে ’। সমরেশ বসুর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। প্রায় ৫ লাখ শব্দের 'চিরসখা' নামের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু।


বাংলা কথাসাহিত্যে সমরেশ বসুর তুলনা সমরেশ বসুই। আজ বাংলাসাহিত্যের খ্যাতিমান ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক সমরেশ বসুর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৯ রাত ৮:৩৬
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×