somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বরেন্য শিক্ষাবিদ, কবি এবং লেখক আবু হেনা মোস্তফা কামালের ৮৩তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

১৩ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশেল বরেন্য শিক্ষাবিদ, কবি এবং লেখক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। 'অনেক বৃষ্টি ঝরে/ তুমি এলে যেন এক মুঠো রোদ্দুর/ আমার দু'চোখ ভরে' এরকম অনেক চমত্‍কার গানের গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ বাল্যকালেই গানের চর্চা শুরু করেছিলেন তিনি ৷ হতে চেয়েছিলেন গায়ক ৷ মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজেকে বোঝার ক্ষমতা বাড়ে ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালও পরে বুঝেছিলেন গাওয়া নয়, লেখার প্রবণতায় বাঁধা তাঁর জীবনের তার ৷ লেখালেখির শুরুতে তাই কবিতা ও গান রচনার প্রতি ছিল তাঁর মত্ততা ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই রচনা করেছেন অনেক কালজয়ী গান ৷ গীতিকার হিসেবে ওই বয়সেই পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন প্রয়াত শিল্পী ও সুরকার আনোয়ারউদ্দিন খান এবং কবি, সঙ্গীতশিল্পী ও ক্রীড়াবিদ আসাফউদদৌলা ৷ বন্ধু ছিলেন অকালপ্রয়াত সুরকার ও কন্ঠশিল্পী আবু বকর খান ৷ এদের অনুপ্রেরণা তাঁকে সঙ্গীতমগ্ন করেছে ৷ পরবর্তীকালে তাঁর অনেক গানে কন্ঠ ও সুর দিয়েছেন আনোয়ারউদ্দিন খান ৷ এছাড়া শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কন্ঠেও তাঁর অনেক গান দারুণ সফল হয়ে উঠেছে ৷ আবু হেনার গানের সুরকারদের মধ্যে আছেন আব্দুল আহাদ, কাদের জামেরী, আবেদ হোসেন খান, মশিহ-উল-আলম, আবু বকর খান, মীর কাসেম খান, মনসুর আহমেদ, শেখ মোহিতুল হক, খোন্দকার নূরুল আলম, শেখ সাদী খান, অজিত রায়, রাজা হোসেন খান, প্রনব ঘোষ, দেবু ভট্টাচার্য, অনুপ ভট্টাচার্য, সমর দাস, জালাল আহমেদ, সৈয়দ আনোয়ার মুফতী ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা অনেক গান তখনও যেমন রেডিও, টেলিভিশন ও গ্রামোফোনে শোনা যেত এখনও তেমন শোনা যায় ৷ ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো গান তিনি লেখেননি ৷বেঁচে থাকতে গানের কোনো সংকলন করেননি আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ মৃত্যুর পর ১৯৯৫ সালে তাঁর দুই শতাধিক গান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রকাশ করে 'আমি সাগরের নীল' গ্রন্থ ৷ তাঁর গানের সংখ্যা আরও অনেক বেশি ৷ দুই হাজারের মতো গান লিখেছেন তিনি ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের অনেক গানের বিষয় হয়েছে প্রেম ৷ প্রেমের বহুবিচিত্র অনুভূতিকে গীতিময়তার পাশাপাশি কাব্যের সংমিশ্রণে গানে গানে ফুটিয়ে তুলেছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। আজ এই কবি ও লেখকের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৩৬ সালের আজকের দিনে তিনি পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বরেন্য শিক্ষাবিদ, কবি এবং লেখক আবু হেনা মোস্তফা কামালেরজন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।


আবু হেনা মোস্তফা কামাল ১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ পাবনা জেলার পাবনা থানার গোবিন্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ৷ তার বাবা এম. শাহজাহান আলী ছিলেন প্রথম জীবনে স্কুলশিক্ষক, পরে কোনো অফিসের হেডক্লার্ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন ৷ অকালেই মারা যান তিনি ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের মা খালেসুননেসা দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন ৷ গান ভালো গাইতেন ৷ ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালরা ছিলেন তিন ভাইবোন ৷ সবার বড় বোন সাবেরা খাতুন শামসুন আরা ৷ সাবেরা খাতুনের স্বামী খ্যাতিমান সাংবাদিক কেজি মুস্তফা ৷সেই সূত্রে সাবেরা খাতুন সাবেরা মুস্তফা নামেই পরিচিত ৷সাবেরা মুস্তফা অধ্যাপক এবং মঞ্চ ও বেতারের অভিনেত্রী ছিলেন ৷তাঁর পরে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ভাইবোনদের মধ্যে ছোট আবুল হায়াত্‍ মোহাম্মদ কামাল ৷ বাংলাদেশ বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন ৷ গীতিকার হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ৷পাবনা জেলা স্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাস করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ১৩তম স্থান অধিকার করেন তিনি ৷ ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ৭ম স্থান লাভ করেন ৷ ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেনতিনি ৷ একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন ৷ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ পরে ১৯৬৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং (১৮১৮-১৮৩১)' শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি


গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের (মাঝখানে) সঙ্গে আবু হেনা মোস্তফা কামাল (ডানে)
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৯ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে প্রভাষক হিসেবে ৷ তারপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন ৷ ১৯৬০ সালে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে ৷ দুই বছর সেখানে ছিলেন ৷ ১৯৬২ সালে তিনি প্রাদেশিক সরকারের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক হয়ে ঢাকায় চলে আসেন ৷ ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ৷ একই পদে স্থায়ী নিয়োগ পেয়ে ১৯৬৫ সালে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ৷ পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণার জন্য ১৯৬৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তিনি ৷ সেখানে অধ্যাপক টিডব্লিউ ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে 'দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং' শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ৷ ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার পর তিনি রিডার পদে উন্নতি লাভ করেন ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর ৷ সেখানে ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হন আবু হেনা ৷ ১৯৭৮ সালে ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি ৷ ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি ৷১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশের মতোই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শিকার হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও৷ ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে হত্যা করে, কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালকেও তারা ধরে নিয়ে যায়৷ আবু হেনাকে অস্ত্রের মুখে রাজশাহী বেতার কেন্দ্র থেকে তাদের পক্ষে কথিকা লিখতে বাধ্য করে৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু সহকর্মীর প্ররোচনায় পাকিস্তানের পক্ষে কথিকা লেখার দায়ে আবু হেনাকে গ্রেফতার করা হয়৷ সেটা ছিল ১৯৭২ সালের জানুয়ারি৷ অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য৷ খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী, অধ্যাপক সালাউদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তাঁকে মুক্ত করার জন্য ওই সময় সক্রিয় হয়েছিলেন৷ তাঁর ভগ্নিপতি সাংবাদিক কে. জি. মোস্তফার সুপারিশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি আদেশে তাঁকে দুই-তিন দিনের মধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়৷ আবু হেনা মোস্তফা কামাল কষ্টে ও ক্ষোভে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দেন এবং ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন


বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানে যেসব গানকে আমরা চিরসবুজ বলতে পারি সেসব গানের মধ্যে আবু হেনা মোস্তফা কামালের অনেক গান আছে ৷ যেমন: ১) 'তোমার কাজল কেশ ছড়ালো বলে/ এই রাত এমন মধুর/ তোমার হাসির রঙ লাগল বলে/ দোলে ঐ মনের মুকুর' ২) 'সেই চম্পা নদীর তীরে/ দেখা হবে আবার যদি/ ফাল্গুন আসে গো ফিরে' ৩) 'হাতের কাঁকন ফেলেছি খুলে/ কাজল নেই চোখে/ তবু তোমার কাছে যাবো/ যা বলে বলুক লোকে' ৪) 'আমি সাগরের নীল/ নয়নে মেখেছি এই চৈতালি রাতে/ ফুলকঙ্কন পরেছি দখিন হাতে' ৫) 'ভ্রমরের পাখনা যতদূরে যাক না ফুলের দেশে/ তুমি তবু গান শুধু শোনাও এসে' ৬) 'নদীর মাঝি বলে: এসো নবীন/ মাঠের কবি বলে এসো নবীন/ দেখেছি দূরে ঐ সোনালি দিন' ৭) 'ওই যে আকাশ নীল হলো আজ/ সে শুধু তোমার প্রেমে' ৮) 'মহুয়ার মোহে গেল দিন যে/ তোমার কাছে আমার কত ঋণ যে/ সে কথা না হয় হলো নাই বলা/ ঝরা পাতার কান্না শুনে আজকে আমার পথ চলা' ৯) 'অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা/ সেই থেকে শুরু দিন বদলের পালা' ১০) 'তুমি যে আমার কবিতা, আমার বাঁশির রাগিনী' ১১) 'পথে যেতে দেখি আমি যারে' ১২) 'যায় যদি যাক প্রাণ, তবু দেবো না দেবো না দেবো না গোলার ধান' ১৩) 'এই পৃথিবীর পান্থশালায় গাইতে গেলে গান' ৷১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া আবু হেনা মোস্তফা কামালের গান দিয়ে ৷ গানের কথা ছিল, 'ওই যে আকাশ নীল হ'লো, সে শুধু তোমার প্রেমে' ৷ চলচ্চিত্রের জন্যও অনেক গান লিখেছেন আবু হেনা ৷ বাংলাদেশের যেসব চলচ্চিত্রে তাঁর গান ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'দর্পচূর্ণ', 'যোগবিয়োগ', 'অনির্বাণ', 'সমর্পণ', 'অসাধারণ' ও 'কলমীলতা' ৷ এর মধ্যে 'অসাধারণ' চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও তাঁর রচনা ৷ চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন মুস্তফা আনোয়ার ৷আবু হেনা মোস্তফা কামাল নিজের লেখা নিয়ে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ৷ শুরুতে তিনি লিখতেন কবিতা ও গান ৷ গানের কথা আগেই বলা হয়েছে ৷ পঞ্চাশের দশকে শুরু করলেও প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় প্রায় দুই দশক পর ৷ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আপন যৌবন বৈরী' ৷ তাঁর প্রবন্ধ ও সমালোচনায় যুক্তিবোধ ও সহিষ্ণুতার প্রকাশ মেলে ৷ 'আপন যৌবন বৈরী' কাব্যগ্রন্থের 'ইস্তাহার সাম্প্রতিক' কবিতা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে ৷ রোমন্টিকতা ও কল্পনাবিলাসে পরিপূর্ণ অথচ সংযত এই কবিতাটি মাত্র পাঁচ লাইনের ৷ 'স্বৈরিণী তোমাকে ভালোবাসি ব'লে/ এ-পাড়ার স্বাস্থ্যরক্ষী মহোদয়গণ/ সম্প্রতি আমার নামে নিন্দার পোস্টার/ এঁটেছেন দেয়ালে দেয়ালে ৷ আর তাঁদের শ্লোগান:/ এটা ভদ্রপাড়া, এখানে নিষিদ্ধ সব কোকিলের গান'।


আবু হেনা মোস্তফা কামালের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'যেহেতু জন্মান্ধ' প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের দশ বছর পর অর্থাৎ‍ ১৯৮৪ সালে ৷ এর চার বছর পর (মৃত্যুর এক বছর আগে) ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ 'আক্রান্ত গজল' ৷ তিনটি গ্রন্থে মোট কবিতা আছে শতাধিক ৷ এর বাইরে তাঁর আরও অনেক কবিতা অপ্রকাশিত থেকে গেছে ৷ গান দিয়ে যেমন শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিলেন তেমনি কবিতা দিয়েও পাঠকের চিত্ত জয় করেছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ সমালোচকরাও তাঁর কবিতার প্রশংসা করেছেন ৷কবিতায় আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রধান অবলম্বন প্রেম ও নারী ৷ কবিতার ছন্দের ক্ষেত্রে আবু হেনা মোস্তফা কামাল গুরুত্ব দিয়েছেন কবিতাটির মেজাজকে ৷ যে কবিতার মেজাজ যে রকম ছন্দও হয়েছে সেরকম ৷ গদ্যছন্দে লিখেছেন অনেক ৷ স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তে লেখাও কম নয় ৷ তবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের স্বাধীনতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন পুরোপুরি ৷ তাঁর কবিতা পড়ে মনে হয়েছে, অক্ষরবৃত্তই ছিল তাঁর সহজাত ছন্দ ৷ তাঁর কবিতায় শব্দ ব্যবহারে একটা মার্জিত ব্যাপার আছে ৷ শব্দ প্রয়োগ, নতুন শব্দ ও বাক্য তৈরি, ইংরেজি শব্দের ব্যবহার, বিদ্রূপ বা উপহাস, চিত্রকল্প ও অন্যান্য অলঙ্কারের ব্যবহার- এসবের কোনো ক্ষেত্রেই তিনি এমন কিছু করেননি যা তাঁর কবিতাকেই ক্ষুণ্ন করতে পারে ৷ কবিতার পাশাপাশি আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন একজন উত্‍কৃষ্ট মানের প্রাবন্ধিক ৷ কবিতা দিয়ে সাহিত্যে তাঁর যাত্রা শুরু হলেও প্রবন্ধ ও সমালোচনায় ছিলেন সবচেয়ে সফল ৷ বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে সাহিত্যের মননশীল ধারায় তাঁর বিচরণ ৷ তাঁর মননশীল রচনাগুলোতে বহুবিধ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে ৷ গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, সময়, সমাজ, সমকাল- এরকম বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁর মননশীল রচনাগুলো ৷ প্রাবন্ধিক আবু হেনার ঝোঁকের একটা জায়গা ছিল উনিশ শতক। আবু হেনা মোস্তফা কামালের জীবদ্দশায় প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ দুটি ৷ প্রথমটি সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন 'শিল্পীর রূপান্তর' ৷ এই গ্রন্থের আটটি প্রবন্ধের মধ্যে চারটিরই বিষয় উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ ও সাহিত্য ৷ এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে ৷ অন্যটি সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন 'কথা ও কবিতা' ৷ এটির প্রকাশকাল ১৯৮১ ৷ এই গ্রন্থের মোট ১১টি প্রবন্ধের মধ্যে তিনটিরই পটভূমি উনিশ শতক ৷ এছাড়া ১৯৭৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তাঁর ইংরেজি অভিসন্দর্ভ 'দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং' এর বিষয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকের সাময়িকপত্র ও সৃষ্টিশীল সাহিত্য ৷প্রাবন্ধিক হিসেবে আবু হেনার সবচেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল বিশ্লেষণে ৷ প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য উদ্ঘাটনের চেয়ে বিশ্লেষণের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি ৷ মূলত বিশ্লেষণের পথ ধরে তাঁর প্রবন্ধে উদ্ভাবনের ঘটনা ঘটেছে ৷


আবু হেনার প্রবন্ধ চর্চার একটা ধারাবাহিকতা আছে ৷ প্রবন্ধ লেখা তিনি শুরু করেছিলেন আধুনিক বাংলাসাহিত্যের গোড়ার সময়টুকু ধরে। উনিশ শতকের শুরুর সময়টিকে আধুনিক বাংলাসাহিত্যের ভিত্তি ধরে নিয়ে সেটিকে গভীরভাবে বুঝতে চেয়েছেন তিনি ৷ এরপর ক্রমে এগিয়ে এসেছেন বিশ শতকের দিকে ৷সমাজ ও সমকাল নিয়ে আবু হেনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক কলাম লিখেছেন ৷ 'দৈনিক বাংলা' পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন 'অমত্‍সর' ও 'দ্বিতীয় চিন্তা' নামে ৷ সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বিচিত্রা'য় লিখতেন 'অবান্তর কথকতা' ৷ 'চিত্রালী উপহার' পত্রিকায় লিখতেন 'অতিথির কলাম' ৷ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত 'ধান শালিকের দেশ' পত্রিকায় 'ইছামতীর সোনালী-রূপালী' শিরোনামে নিজের ছেলেবেলার নানা ঘটনা লিখেছেন ৷ আলবেয়ার ক্যামুর 'ক্যালিগুলা' নাটকটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন তিনি ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের বিভিন্ন ধরনের গদ্য নিয়ে তাঁর মৃত্যুর পর ২০০০ সালে 'কথাসমগ্র' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে সময় প্রকাশন ৷নিজের লেখা সংরক্ষণ করা হয়ে উঠত না আবু হেনার ৷ সংরক্ষণের চেয়ে লিখে যাওয়ার ব্যাপারেই তিনি বরাবর বেশি নিবেদিত ছিলেন ৷ 'শিল্পীর রূপান্তর' ও 'কথা ও কবিতা'- এই দুটি প্রবন্ধগ্রন্থের বাইরে আবু হেনার আরও অনেক প্রবন্ধ অগ্রন্থিত রয়েছে ৷
বাংলা কবিতা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য আবু হেনা মোস্তফা কামাল বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন ৷ তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার সমূহঃ
১। আলাওল পুরস্কার(১৯৭৫)
২। সুহৃদ সাহিত্য স্বর্ণপদক(১৯৮৬)
৩। একুশে পদক(১৯৮৭)
৪। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্বর্ণপদক(১৯৮৯)
৫। সাদত আলী আকন্দ স্মৃতি পুরস্কার(১৯৯১)


১৯৫৬ সালের ২৫ অক্টোবর হালিমা খাতুনকে (ডাক নাম টুলু, পরবর্তীতে হালিমা মোস্তফা) নিয়ে দাম্পত্যজীবন শুরু করেন ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও হালিমা মোস্তফা দম্পতির পাঁচ সন্তান ৷ সন্তানদের মধ্যে কাবেরী মোস্তফা (শিখা) কম্পিউটার প্রোগ্রামার, বর্তমানে সফট্ওয়্যার ব্যবসায়ী , কাকলী মোস্তফা (কেকা) ইতিহাসবিদ ও শিক্ষক, সুজিত মোস্তফা (বিদ্যুত্‍) আধুনিক, সেমি ক্ল্যাসিক্যাল ও নজরুল সঙ্গীতের খ্যাতিমান শিল্পী, শ্যামলী মোস্তফা (পাখি) চিকিত্‍সক, বর্তমানে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এবং সৌমী মোস্তফা (পিনু) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ সমাপ্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত আছেন ৷ বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক থাকাকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩ টা ৪৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর ৷ ঢাকার আজিমপুর নতুন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি ৷বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রতুল্য সৃজনশীল ও মননশীল এই বরেণ্য লেখকের আজ ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। বরেন্য শিক্ষাবিদ, কবি এবং লেখক আবু হেনা মোস্তফা কামালের
জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা


নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:০৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×