somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গানের বুলবুল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৭ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ৮:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আজ ১২ ভাদ্র ১৪২৬ বঙ্গাব্দ, সোমবার দ্রোহ ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩তম প্রয়াণবার্ষিকী। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে চির অভিমানী বিদ্রোহী কবির মহাকাব্যিক জীবনের অবসান ঘটে। দীর্ঘদিন চেতনাহীন নির্বাক থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে ঢাকায় থেমে যায় বাংলাদেশের জাতীয় কবির প্রাণের স্পন্দন। তবে প্রাণের স্পন্দন থেমে গেলেও সৃষ্টির আলোয় আজো অমর হয়ে আছেন এই কবি। ক্ষুরধার লেখনির আঁচড়ে স্থান করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্য তথা পুরো বিশ্বসাহিত্যে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস কিংবা সঙ্গীত-সাহিত্য ও শিল্পের সব শাখায় তাঁর আগমন ছিল ধূমকেতুর মতো। নজরুল তার অন্যান্য সৃষ্টিকর্মের মধ্য থেকে সঙ্গীত নিয়ে বেশি আশাবাদী ছিলেন। তাই গান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী নজরুল অকপটে বলে গেছেন, 'আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে' কিংবা 'আমায় নহে গো ভালোবাসো, শুধু ভালোবাসো মোর গান'। কতখানি আত্মবিশ্বাসী হলে এমন কথা বলা সম্ভব। নজরুল তার জাদুস্পর্শী ছোঁয়ায় বাংলা সঙ্গীতের ভাণ্ডারকে কানায় কানায় পূর্ণ করে গেছেন। বাংলা গান এবং সুরকে পর্বতসম উচ্চতা দিয়ে বিশ্বের দরবারেও পরিচয় করিয়ে গেছেন। আপন সৃষ্টির আলোয় নতুন দিনের আগমনী বার্তা দিয়ে এঁকে দিয়েছিলেন নবদিগন্তের উজ্জ্বল রেখা। শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় আজো তিনি ‘উন্নত মম শীর’। দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা কাব্য ও সংগীতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন তিনি তাঁর অনন্য প্রতিভায়। নিপীড়িতের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি কিংবা প্রেম ও মানবতার বাণীতে আজো তিনি সমুজ্জ্বল। প্রেম, দ্রোহ ও মানবতার কবির প্রয়াণ দিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, দ্রোহ ও প্রেমের বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪মে ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। তারা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া"। দাুখু মিয়া ছাড়াও তার অনেক নাম ছিলো যেমনঃ নজর আলি, নাজির আলি। নামগুলো আসলে নামহীন-গোত্রহীন এক জীবনের তুচ্ছতার কথা বলে। পরে তিনি নেন ‘নাজিরুল ইসলাম’ ও ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নাম। কি মুসলমান কি হিন্দু, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহল এমন কেতাবি নাম ছাড়া কাউকে সম্মান করতো না। নামের বিবর্তন থেকে বোঝা যায়, দিনে দিনে তিনি অনামা থেকে ‘নাম-করা’ সারিতে উঠে আসছেন। কিন্তু দুঃখের দহনে পোড়া ‘দুখু মিয়া’র জীবন আগের মতোই দুঃখেরই থেকে গেছে। রুটির দোকানের কর্মী, দারোগার বাড়ির ফরমাশ-খাটা বালক থেকে হাবিলদার হয়েছেন সেনাবাহিনীর। হয়েছেন লেটোর গানের দলের স্যাঙাত, দূরদেশের রণাঙ্গনের সৈনিক, হয়েছেন সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং কারাভোগী বিপ্লবী। নজরুলের জীবন তাঁর সাহিত্যের মতোই চমক লাগানো। এত পরিচয় সত্ত্বেও বাঙালির মনে দুখু মিয়া অতি চেনা কবিয়ালের রূপে স্থায়ী হয়েছেন। তিনি স্থানীয় মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বাঁধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জ্জনে।এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকর্মকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে।


মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল 'লেটো'দলে যোগ দেন। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল। এরপর তিনি ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে আর্থিক সমস্যা তাকে বেশী দিন পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ'র' সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন।


১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছিলেন। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্‌ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্‌দম্‌। এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।এ ছাড়াও নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের বিপুল বিশাল ভাণ্ডারটি তিনি গড়ে দিয়ে গেছেন। বাঙালীর চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতকে নাড়া দিয়েছেন ভীষণভাবে।


(কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্ত দেবী)
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্ত দেবীর সাথে যার সাথে কবির বিয়ে হয়েছিল। প্রমিলার ডাকনাম ছিল দুলি। তাদের এই বিয়ে প্রেমের বিয়ে নয় বরং পারিবারিক সন্মতিতেই হয়েছিল। তবে কুমিল্লায় থাকাকালে নজরুল প্রমিলার প্রতি অনুরক্ত ছিল। তার এ প্রেমের কথা কবি তার “বিজয়িনী” কবিতায় প্রকাশ করেন। তাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে। এতে বাধা হিসেবে ছিল একটাই বিষয় তা হল ধর্ম। পরে যে যার ধর্ম পরিচয় বহাল থাকার শর্তে বিয়ে করেছিলেন। তখন প্রমিলা দেবীর বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের বয়স ছিল ২৩।


কবির জীবনে রয়েছে আরও অনেক নারীর ছোয়া। “রানু সোম” তিনি বুদ্বদেব বসুকে বিয়ে করে প্রতিভা বসু নামে খ্যাত হন। সংগীতঞ্জ দীলিপ কুমার রায় রানুকে নজরুলের গান শেখাতেন। তার কছেই তিনি রানুর নাম শোনেন। পরে তিনি তার কাছ থেকে রানুর ঠিকানা নিয়ে নিজেই তার বাড়ি খুজে বের করেন। শুরু করেন গান শিখানো। কিন্তু পারার যুবকদের সহ্য হয়নি তাদের এ গুরু শির্ষ্য সম্পর্ক। রানুর বাড়ি থেকে একদিন নজরুল বের হওয়ার পর যুবকরা আক্রমন করে তাকে। সেও তো আর কম না উল্টো আক্রমন করল ওদের। ব্যাপারটা তখন পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। শিল্পী কানন দেবিকেও গান শিখাতেন তিনি। রটানো হয়েছিল যে কবিকে কোথাও পাওয়া না গেলে তাকে পাওয়া যাবে কানন দেবির বাড়িতে। গান শেখানোর সময় রাত হলে থেকে যাওয়ার ব্যাপারটা অনেকেই ভাল চোখে দেখত না।


(রানু সোমের সাথে কবি)
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে।পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা 'আনন্দময়ীর আগমনে' প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর কবিকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এক জবানবন্দী প্রদান করেন। তার এই জবানবন্দী বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেনঃ
"আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...। ”
৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।


১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। সেখানের চিকিৎসকরা জানায় কবি পিক্‌স ডিজিজ নামক একটি নিউরন ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায় যা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব। এই প্রেক্ষিতে কবি নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। কবির সাথে যারা ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা সবাই ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রোম থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।


১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ উদ্যোগ ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি কবি কাজী নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর গান, কবিতা সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে দেশের মুক্তিকামী মানুষকে। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।


এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ই ভাদ্র (১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট) তারিখে ঢাকার তদানীন্তন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েন কবি।
মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার সাম্যের কবি, গানের বুলবুল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

নূর মোহাম্মাদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ৮:২৫
১৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×