somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিংশ শতাব্দী বাংলা গানের অন্যতম প্রধান গায়িকা উৎপলা সেনের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাঙলা গানের সোনালী যুগে প্রেম এবং বিরহের গানের কিন্নরকণ্ঠী গায়িকা উৎপলা সেন। স্বামী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং অন্য গায়কদের সাথে অনেক জনপ্রিয় ডুয়েটে তিনি প্রেম এবং বিরহের গানে একটি বিশিষ্ট বিষাদের সুর ধরেছেন। উৎপলা সেন প্রথম তালিম পান তার মা হিরণবালা দেবীর কাছে, তারপর উস্তাদ গুল মোহম্মদ খানের কাছে। মা হিরণবালার সঙ্গীতপ্রতিভা বিকাশের কথা, সে যুগে দাঁড়িয়ে যেমন ভাবতে পারেন নি রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার, তেমনি প্রাথমিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি মেয়ে উৎপলার বাইরে গান গাওয়া। এমনকি, উৎপলা যে স্কুলে পড়তেন, সে স্কুল থেকেও গান গাওয়ার জন্য বিতাড়িত হয়েছিলেন উৎপলা। পরে যখন 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় ওঁর গানের ভূয়সী প্রশংসা প্রকাশিত হয়, যেমন গর্ববোধ করেছিলেন রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার, তেমনি উৎপলাকে সাদরে স্কুল কর্তৃপক্ষ ডেকে নিয়েছিল। তিনি প্রথম জনসমক্ষে আসেন ১৯৩৫ সালে তেরো বছর বয়সে ঢাকা রেডিওতে। ঢাকা রেডিওতে সে যুগে আধুনিক গানের প্রচলন ছিল না। চল্লিশের দশকের গোড়ায়, ঢাকা বেতারে আধুনিক গানের নতুন স্রোত এনেছিলেন ফরিদপুর নিবাসী বিখ্যাত গায়ক সুরকার সুধীরলাল চক্রবর্তী। ১৯৪০ সালে, এক সঙ্গীতালেখ্যর পরিচালনা সূত্রে সুধীরলাল সঙ্গে পরিচয় হয় উৎপলার। রেডিওশিল্পী সুকণ্ঠী উৎপলা, স্বভাবতই পড়েন সুধীরলালের নজরে। সেই থেকে উৎপলাকে ছাত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দেন। উৎপলা সেনের প্রথম গানের রেকর্ড হয় ১৯৩৯ সালে। সঙ্গীতকার সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে ১৯৪১ সালে প্রবল জনপ্রিয়তা পেল এক হাতে মোর পূজার থালি গানটি। আরও জনপ্রিয়তা পেলেন মহিষাসুর মর্দিনীর শান্তি দিলে ভরি গানে, যা আজও শোনা যায়। চল্রিশ দশকের গোড়ার দিকে কলকাতা চলে আসেন উৎপলা সে, এবং তার পর থেকে আকাশবাণী (All India Radio)র সঙ্কে যুক্ত ছিলেন বহুদিন। বাংলা সিনেমায়ও গান করেছেন আনেক। ২০০৫ সালের আজকের দিনে পাঁচ বছরের ক্যান্সারাক্রান্ত উৎপলা সেন মারা যান কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালে। আজ তর ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। খ্যাতিমান বাঙালি কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয় রোশনীর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।


১৯২৪ সালের ১২ই মার্চ, ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন উৎপলা সেন। পিতামহ রায়বাহাদুর যোগেশ ঘোষ নাতনির সুন্দর মুখশ্রী দেখে আদর করে নাম রেখেছিলেন 'উৎপলা'। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার ঘোষ। মা হিরণবালা দেবী ছিলেন আনন্দময়ী মা'র অষ্টসখীর এক সখী। হারমোনিয়াম, সেতার, এস্রাজ ও বংশীবাদনে তিনি ছিলেন অনন্যা। গাইতেন ভক্তিগীতিও। আত্মজা উৎপলাকে গানের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিলেন হিরণবালা দেবী স্বয়ং। কিছুটা বড় হলে খগেশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে তালিম নিতে শুরু করেন উৎপলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় একাধিক বিষয়ে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। তিরিশের দশকের শেষদিকের কথা। এরপর, ১৯৩৯ সালে ঢাকা বেতারকেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী হিসাবে যোগ দেন উৎপলা। প্রথম যে গানটি গেয়েছিলেন, সেটি ছিল মা হিরণবালা দেবীর শেখানো। শুধু গান নয়, অভিনয়, আবৃত্তিও করতেন ঢাকা রেডিওতে। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রপ্রয়াণের দিবসে 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'-এর আবৃত্তি প্রচারিত হয়েছিল কিশোরী উৎপলার কণ্ঠে। ১৯৬৯-এর পুজোয়, 'আমি তোমার কাছে বারেবারে নতুন হতে চাই' মেগাফোনে উৎপলা প্রথম রেকর্ড। মেগাফোনে উৎপলার কণ্ঠে প্রকাশিত হল আরও অনেক গান, সত্তর-আশির দশক জুড়ে। একে একে হিট হল 'পাখিদের ওই পাঠশালাতে', 'কিংশুক ফুল হিংসুক ভারী', 'আমরা দুজনে শুধু দুজনার', 'দুখের দিনে কেউ তো থাকেনা', 'ডুবে গেলো চাঁদ মেঘের আড়ালে', ইত্যাদি গান।


(উৎপলা সেন ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়)
ব্যক্তিগত জীবনে দুইবার বিয়ের পিড়িতে বসেন উৎপলা সেন। প্রথম বিবাহ বেণু সেনের সাথে। ১৯৬৫ সালের ১৩ই নভেম্বর, প্রয়াত হন উৎপলা সেনের স্বামী সতীন্দ্রকুমার। তখন পারিবারিক ও সামাজিক সমস্ত আপত্তির বাধা অতিক্রম করে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সঙ্গীতসঙ্গী উৎপলা সেন ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে উৎপলা সেন ছিলেন আদরের রোশনী। রোশনী খেয়ালি, আর সতীনাথ আত্মভোলা। দুইয়ের জুটি ছিল অসম্ভব সুন্দর। প্রতি রবিবার একসঙ্গে যেতেন সিনেমা দেখতে। একবার সিনেমা হলে বিপত্তি। সেজেগুজে উৎপলা বসে আছেন নিজের সিটে, পাশের সিটে মাফলার গলায় সতীনাথ। হঠাৎ দেখেন বারেবারে, খানিক্ষন পর পর কে যেন পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে চলেছে। একী! বিরক্ত হয়ে উৎপলা স্বামীকে বললেন, পরের বার সুড়সুড়ি দিলেই আমি তোমায় চিমটি কাটবো, আর তুমি লোকটাকে ধরবে! কিছুক্ষন পর যথারীতি আবার সুড়সুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সতীনাথকে উৎপলার চিমটি। ওমা! উৎপলা দেখেন সতীনাথ লোকটাকে না ধরে হেসে উঠেছেন! পাশ ফিরে দেখেন পিছনের সিটে ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ! এতক্ষন মজা করছিলেন উৎপলার সঙ্গে! আত্মভোলা হলেও সতীনাথ ছিলেন স্নেহময় পিতা। উৎপলার পিতৃহারা যুবক পুত্র আশীষকে চোখে হারাতেন তিনি। চেয়েছিলেন, একটা ফুটফুটে মেয়ে হোক ওঁদের। কিন্তু তাতে যদি আশীষ আঘাত পায়! তাই পুতুল-কন্যা গার্গীকে নিয়ে থাকতেন সতীনাথ। কাপড়ের গার্গীই ছিল সতীনাথের মেয়ে। দিনের বেলা সে থাকত আলমারিতে। রাতে শুতে যাবার আগে গার্গীকে আলমারি থেকে নামিয়ে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, চুল আঁচড়ে, আবার ফিরিয়ে দিতেন তার আলমারি-বিছানায়। অভিমানী উৎপলার এক বার সহ্য হয়নি গার্গীর প্রতি এই আদর - তুমি কেবলই তো গার্গীকে নিয়ে আছ! আমার দিকে ফিরেও তাকাও না! ছিঁড়ে কুটি কুটি করে বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন গার্গীকে। গার্গীকে হারিয়েও আদরের রোশনীকে আঘাত করতে পারেন নি মরমী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।


১৯৯২ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সেদিনই সন্ধ্যেবেলা আদরের রোশনীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। বড় একা হয়ে পড়েছিলেন উৎপলা সেন, সতীনাথের প্রয়াণের পর থেকে। ইতিমধ্যে উৎপলার ক্যান্সার ধরা পরে। দুবার অপারেশন হয়। শেষরক্ষা আর হয়নি। স্বামীর মৃত্যুর ১৩ বছর পরে ২০০৫ সালের ১৩ই মে পাঁচ বছরের ক্যান্সারাক্রান্ত উৎপলা সেন কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতাল থেকে সুরলোকে গমন করেন উৎপলা সেন। রেখে গেলেন বেশ কিছু ক্লাসিক পর্যায়ের গান যা আজও প্রায়ই শোনা যায়, যেমন ময়ুরপঙ্ক্ষী ভেসে যায়, পাখি আজ কোন সুরে গায় বা ঝিকমিক জোনাকির দ্বীপ জ্বলে শিয়রে। তবে তাঁর ৬০০০ এর বেশি সিনেমা এবং রেকর্ডের গানের অধিকাংশই আজ বিস্মৃতপ্রায়। ইদানিং কালে দুই বাঙলাতেই পুরানো দিনের গানের চর্চা বাড়ছে - কিছু গান 'রিমেক' মাধ্যমে আবার শোনা যাচ্ছে - এবং উৎপলা সেনের নাম আবার জনসমক্ষে শোনা যাচ্ছে। আজ কিন্নরকণ্ঠী গায়িকা উৎপলা সেনের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। খ্যাতিমান বাঙালি কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয় রোশনীর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নূর মোহাম্মাদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:২৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×