সিস্টার লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট (Lucy Helen Francis Holt) । মানবকল্যাণই যার জীবনের উদ্দেশ্য এবং আদর্শ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক বিদেশি নাগরিকের অবদান সম্পর্কে আজ আমরা সবাই কম-বেশি জানি। অসীম সাহসিকতার সঙ্গে একেকজন বিদেশি নাগরিক স্বাধীনতার জন্য, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এ দেশের মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে গেছেন ইংল্যান্ডের লুসি হল্ট তাদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা এই নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন অনেক প্রতিকূল পরিবেশে। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে ইংল্যান্ডের নিশ্চিত সুখের জীবন ছেড়ে চলে এসেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। উন্নত দেশের সব সুযোগ-সুবিধা দু’পায়ে ঠেলে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত এক জাতির সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। একটি জাতিকে কীভাবে একজন নেতা স্বাধীনতার মানে বুঝিয়েছেন, যেভাবে একটি দেশের সমস্ত জনগণকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন, সেটি দেখে তার প্রতি লুসির সম্মান আরো বেড়ে যায়। তাই তো তিনি লন্ডনে তার পরিবারের কাছে পাঠানো চিঠিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করে তার মুক্তির আশা ব্যক্ত করেছেন। ভালোবাসা দেওয়া আর পাওয়াই তার জীবনের লক্ষ্য। বাংলাদেশকে তিনি ভালোবাসেন, আর তাই তো কাকতালীয় ভাবে লুসি আর বাংলাদেশের জন্মদিন একই দিনে- ১৬ই ডিসেম্বর। ১৯৩০ সালের আজকের দিনে তিনি ইংল্যান্ডের সেইন্ট হেলেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। আজ লুসি হল্টের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী। হৃদয়ে বাংলাদেশকে লালন করা এক বিদেশিনী মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি সেনানী লুসি হল্টের ৮৯তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
লুসি হল্ট ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের সেইন্ট হেলেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জন হল্ট ও মাতা ফ্রা্ন্সিস হল্ট। দ্বাদশ শ্রেণির পড়া শেষ করে ১৯৬০ সালে মানবিক কাজে অংশগ্রহণের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। যখন এসেছিলেন, ছিলেন নিতান্তই ত্রিশ বছর বয়সী এক যুবতী। এদেশে এসে প্রথমে তিনি বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন চার্চের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। এ দেশে আসার পর এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মানুষের সারল্যে তিনি এতটাই আবিষ্ট হন যে, এরপর আর কখনও তিনি তার নিজের দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যাননি। ১৯৭১ সালে যশোরের ক্যাথলিক চার্চে তিনি ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব পালন করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চার্চ বন্ধ হয়ে যায় এবং লোকজনকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। লুসি সেখানে থেকে চলে যেতে অস্বীকৃতি জানান এবং আহত মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ জনগণকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন। যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় অবস্থান করে আহতদের চিকিৎসা আর সেবা দিয়ে আমাদের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। লুসি সেই নির্দেশ অমান্য করে থেকে যান এ দেশেই। পাকিস্তানি সামরিক-জান্তার নির্দেশে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ত্যাগ না করে মুক্তি-পাগল বাঙালির পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চার্চ বন্ধ হয়ে যায় এবং লোকজনকে সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়। পাকিস্তানি সামরিক-জান্তা অবশ্য তাকে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই নিরাপত্তার অজুহাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। লুসি সেখান থেকে চলে যেতে অস্বীকৃতি জানান এবং আহত মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ জনগণকে চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু করেন। যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় অবস্থান করে আহতদের চিকিৎসা আর সেবা দিয়ে আমাদের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর চরম অত্যাচার, নির্যাতন দেখেও দমে যাননি, বুক ভরা সাহস নিয়ে চিকিৎসা আর সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষকে। ১৯৭১ সালে তার মা আর বোনকে পাঠানো চিঠিতে তিনি এদেশে ঘটে চলা অত্যাচার-জুলুমের কথা লিখতেন। কীভাবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালি মুক্তিকামী জনগণের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাচ্ছে, তা বর্ণনা করতেন। এহেন অত্যাচার বন্ধ করতে তারা যেন ব্রিটিশ জনগনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার এবং সহানুভূতি আদায়ের উদ্যোগ নেয়, একথাও তিনি তার চিঠিতে লেখেন।
যুদ্ধ শেষ হলে তিনি আগের মতো মানবতার কল্যাণে কাজ করে যেতে থাকেন। লুসি একাধারে দীর্ঘ ৫৯ বছর ধরে নীরবে-নিভৃতে সেবা করে যাচ্ছেন এ দেশ আর তার মানুষের। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর, সিস্টার লুসি আপন মনে নীরবে-নিভৃতে তার কাজ করে গেছেন। কখনও কোনো স্বীকৃতি, প্রতিদান বা সম্মান চাননি। এমনকি এসব চিঠিপত্রও তিনি তুলে রেখেছিলেন নিজের কাছে, কাউকে কখনো দেখাননি। ২০০৪ সালে অবসর লাভ করলেও নিজকে ছুটি দেননি, বরিশালের মানুষের প্রেমে পড়া এই মহিলা সেখানেই শুরু করেছেন শিশুদের ইংরেজি শিক্ষা দেয়া এবং তাদের মানবিক গুণাবলি উন্নয়নে সাহায্য করা। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে চিঠি লিখে শুভেচ্ছা জানান, আর সঙ্গে নিজের হাতে অ্যাম্ব্রয়ডারি করা একটি রুমাল পাঠান উপহার হিসেবে। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সে সময় ব্যস্ত থাকায় তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা সেই চিঠির জবাবও পাঠান, যাতে তিনি তার মায়ের পক্ষ থেকে লুসিকে ধন্যবাদ দেন। ২০১৭ সালে তাকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ পায়। প্রকাশ হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মানুষের জন্য লড়াই করা এক সেনানীর নীরব জীবনের কথা। আরও জানা যায়, তার জীবনের একটা ইচ্ছার কথা। সেই ইচ্ছা হল, বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে এ দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা। অবশেষে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সিস্টার লুসি হল্ট বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পান। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে তার হাতে নাগরিকত্ব সনদ তুলে দেন। এর আগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরিশালের একটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রী তার হাতে ১৫ বছরের মাল্টিপল ভিসাসহ পাসপোর্ট তুলে দিয়েছিলেন। তিনি এখন পুরোপুরি বাংলাদেশী। এ নিয়ে তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, ধন্যবাদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী আর দেশের জনগণকে। নাগরিকত্ব প্রদান অনুষ্ঠানে লুসি বলেন, এটি (বাংলাদেশের নাগরিকত্ব) আমার একটি দীর্ঘদিনের স্বপ্ন! আমি এদেশ এবং এদেশের মানুষকে ভালোবাসি।
লুসি হল্ট বর্তমানে অসুস্থ। বার্ধক্যজনিত জটিলতা আর তার বাসস্থানের লাগোয়া উঠোনে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। সরকার তার চিকিৎসার সব খরচ বহন করার দায়িত্ব নিয়েছে। লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট এক নিঃস্বার্থ মানুষের নাম। যার জীবন মানুষের সেবায় কেটে গেছে। মানবকল্যাণই যার জীবনের উদ্দেশ্য এবং আদর্শ। আর মৃত্যুর পরে বাংলার মাটিতেই সমাহিত হবার ইচ্ছা, সংসারের বন্ধনে না জড়ানো এই নারীর। আজ লুসি হল্টের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী। হৃদয়ে বাংলাদেশকে লালন করা এক বিদেশিনী মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি সেনানী লুসি হল্টের ৮৯তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৪৬