somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী নেতা মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

২৫ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দক্ষিণ বাংলার প্রাণ পুরুষ আধুনিক বরিশালের রূপকার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী নেতা, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক এবং লেখক মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত। অশ্বিনীকুমার দত্ত আমৃত্যু রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বরিশালবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। ১৮৮৪-১৯২৩ সাল পর্যন্ত আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদেরই মানুষ করেন নি, বরং সমাজের অনেক অশিক্ষিত, অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাণ্ডুলে স্বভাবের বখাটে মুকুন্দদাসকে তিনিই দিনের পর দিন বাড়িতে ডেকে এনে আদর স্নেহ ভালবাসার সহচর্য দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুললেন। যার কারণে মুকুন্দদাস একসময় চারণ সম্রাট হতে পেরেছিলেন। ১৯২১ সালে বরিশালে স্টিমার ধর্মঘটের সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং এ অবস্থায় তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের যাবতীয় কাজ দেখভাল করেন। বরিশালে বিভিন্ন সামজহিতৈষী ও কল্যানমূলক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী প্রথম বরিশালে এসে অশ্বিনীকুমার দত্তকে জেলার অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। আজ এই মহান ব্যক্তিত্বের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৫৬ সালের আজকের দিনে তিনি পটুয়াখালী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী নেতা অশ্বিনীকুমার দত্তের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।


১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত তৎকালীন বরিশাল জেলার পটুয়াখালী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলাধীন বাটাজোর গ্রামে। তার পিতা ব্রজমোহন দত্ত এবং মাতা মায়ের নাম প্রসন্নময়ী। বাবা ব্রজমোহন দত্ত কর্মজীবনের শুরুতে পটুয়াখালীর বানারীপাড়ায় শিক্ষকতা করেন। এরপর দেওয়ানী আদলতে কিছুদিন ওকলাতি করেন। তারপর মুন্সেফ হন। মুন্সেফ থেকে জজ হওয়ার মধ্যবর্তী সময় তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি একজন সাহিত্যানুরাগী ও মানবতাবাদী দেশপ্রেমিক ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত ছিলেন। ব্রজমোহন দত্ত ও প্রসন্নময়ীর পরিবারে ৪টি ছেলে ও ২ টি মেয়ের জন্ম হয়। অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন ওই পরিবারের বড় ছেলে। অশ্বিনীকুমার দত্তের পড়শুনার হাতেখড়ি গুরুমশাইয়ের কাছে। তিনি তাদের বাড়িতে পড়াশুনা করাতেন। পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনা তাঁকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সম্পন্ন করতে হয়। তারপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে আইন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ২৩ বছর বয়সে বিএ এবং এক বছর বাদে এমএ বিএল ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৮৮০ সালে অশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশালে আসেন। এ সময় তিনি আইন ব্যবসার যুক্ত হন। ঠিক সেই সময় বরিশালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয় তা থেকে বরিশাল ছিল বিচ্ছিন্ন। গুটিকয়েক জমিদার ও সরকারি কর্মচারীর পরিবার ছাড়া বরিশালের প্রায় গোটা সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। ১৮৮২ সালে তিনি ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন। এ সময় তিনি বরিশালের ছাত্রসমাজের উন্নতির জন্য নিরলস কাজ করতে শুরু করেন। বরিশালের যুবসমাজ অশ্বিনী কুমারের সত্য প্রেম পবিত্রতার আদর্শ গ্রহণ করে। ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে সেবক দল গঠন করা হয়। এই নবজাগরণের ফলে ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় চিন্তা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটে।


১৮৮৪ সালে বরিশালে হাজারে মাত্র ৭ জন শিক্ষিত ছিল। তখন সমগ্র জেলায় ১৫ জনের মতো গ্রাজুয়েট ছিল। সমাজ জীবনে বিশেষত: অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মধ্যে দুর্নীতি, ব্যাভিচার, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অনৈতিকতা জেঁকে বসেছিল। অশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশালের এই দুর্দশা দেখে মর্মাহত হন এবং এসব প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। বরিশালের শিক্ষা ক্ষেত্রেও অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য অবদানঃ
১। ১৮৮৪-তে 'ব্রজমোহন স্কুল' প্রতিষ্ঠা করেন।
২। ১৮৮৬-তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য 'পিপলস্‌ অ্যাসোসিয়েশন' স্থাপন করেন।
৩। ১৮৮৭-তে তাঁর প্রচেষ্টায় বরিশাল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড স্থাপিত হয়।
৪। ১৮৮৭-তে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য 'বাখরগঞ্জ হিতৈষিণী সভা' এবং একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং
৫। ১৮৮৯ ব্রজমোহন কলেজ স্থাপন করেন।

অশ্বিনীকুমার দত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ও চেতনায় আস্থাবান ছিলেন। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সারা জীবন লড়াই করেছেন। জনগণই ক্ষমতার উৎস এবং জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে- এ দাবির সমর্থনে তিনি ১৮৮৫-৮৬ সালে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক জনসভা করেন এবং আইনসভা বা পার্লামেন্ট গঠনের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। এ সময় তিনি ৪০ হাজার বরিশালবাসীর স্বাক্ষর জোগাড় করে আইনসভা প্রতিষ্ঠার জন্য তা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন। অশ্বিনী কুমারের আন্তরিকতাপূর্ণ কথাবার্তা এবং উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতায় ও সমাজ-সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে তিনি অল্পদিনে লোকমানসে স্থান করে নিলেন। ক্রমে ক্রমে তার প্রচেষ্টা সফল হতে থাকে। তিনি নানাবিধ দুর্নীতি, অসামাজিক কার্যকলাপ, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা ও সংগীতের পাশাপাশি জনসাধারণের প্রতিনিধি সভা সংগঠিত করেন। ১৮৮৯ সালে ৯ বছর ওকালতির করার মাথায় মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বলে তিনি আইন ব্যবসাকে ত্যাগ করেন। ১৯০৫-০৮ সাল পর্যন্ত বরিশালে অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন গড়ে উঠে তা বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি বাংলার বাইরেও অনেক প্রদেশে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে। অন্যান্য প্রদেশের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জনসভায় অশ্বিনীকুমার ও বরিশালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উদাহরণ দিতেন। অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে স্বদেশবান্ধব সমিতি শহরে ও গ্রামে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করত। এই সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সরকার অশ্বিনীকুমারসহ ৯ জন নেতাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন আইনে গ্রেফতার করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। এ সময় অশ্বিনীকুমারকে রাখা হয় লক্ষ্ণৌ জেলে।


অশ্বিনীকুমার দত্ত তার জীবদ্দশায় বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ ১। ভক্তিযোগ, ২। কর্মযোগ, ৩। প্রেম, ৪। দুর্গোৎসবতত্ত্ব, ৫। আত্মপ্রতিষ্ঠা ও ৫। ভারতগীতি প্রভৃতি। তিনি বেশকিছু দেশাত্ববোধক গানও রচনা করেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা শতাধিক। ১৯১০-২৩ সাল পর্যন্ত মূলত অসুস্থ্য ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। এ সময়কালে তিনি রোগের সঙ্গে নিয়ত বোঝাপড়া ও দেশ পর্যটনে সময় কাটিয়েছেন। ১৯২২ সালে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন অশ্বিনীকুমার দত্ত এবং দিন দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। আজ এই মহান ব্যক্তিত্বের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী নেতা অশ্বিনীকুমার দত্তের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল
ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৫১
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রম্য: টিপ

লিখেছেন গিয়াস উদ্দিন লিটন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৫




ক্লাস থ্রীয়ে পড়ার সময় জীবনের প্রথম ক্লাস টু'এর এক রমনিকে টিপ দিয়েছিলাম। সলজ্জ হেসে সেই রমনি আমার টিপ গ্রহণ করলেও পরে তার সখীগণের প্ররোচনায় টিপ দেওয়ার কথা হেড স্যারকে জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈশাখে ইলিশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৪০



এবার বেশ আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে । বৈশাখ কে সামনে রেখে ইলিশের কথা মনে রাখিনি । একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে যে ইলিশকে কিঞ্চিত হলেও ভুলতে পেরেছি । ইলিশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×