somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবাদপ্রতীম ভারতীয় হিন্দু বাঙালি অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল এক অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী। গত শতকের পঞ্চাশ থেকে আশির দশক-যে সময়টাকে ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ বলা হয় সে সময়কার বড় অভিনেত্রীদের মধ্যে সুপ্রিয়া দেবী অগ্রগণ্য। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা হোক কিংবা ‘দেবদাস’–এর চন্দ্রমুখী, কিংবা ‘দুই পুরুষ’-এর বিমলা কিংবা ‘বন পলাশীর পদাবলী’র পদ্মা, প্রত্যেকটি সিনেমায় তাঁর উপস্থিতি যেন উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে বাঙালি দর্শকের কাছে। উত্তম কুমার থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলার তাবড় অভিনেতাদের সঙ্গে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। এই অভিনেত্রী বাংলা চলচ্চিত্রে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় করেছেন। সুপ্রিয়া দেবীর উল্লেখযোগ্য ১০ টি সিনেমা হলোঃ ১। মেঘে ঢাকা তারা, ২। বিলম্বিতলয়, ৩। মন নিয়ে, ৪। শুন বরনারী, ৫। সবরমতী, ৬। সোনার হরিণ, ৭। কাল তুমি আলেয়া, ৮। চৌরঙ্গী, ৯। উত্তরায়ণ এবং ১০। সব্যসাচী। এর মধ্যে মেঘে ঢাকা তারার নীতা হিসেবে সুপ্রিয়ার অভিনয় তাঁকে অমর করে রাখবে। দক্ষ অভিনয়, অনবদ্য কৌশল এবং তার মুন্সিয়ানার জন্য অসংখ্য পদক আর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। সুপ্রিয়া দেবী ২০১১ সালে বঙ্গভূষণ পুরস্কার অর্জন করেন, যা পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ অসামরিক উপাধী। এছাড়া ২০১৪ সালে বাংলা চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য ভারত সরকার সুপ্রিয়া দেবীকে, ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “পদ্মশ্রী” তে ভূষিত করেন। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রে দিয়ে ফেরার আগে কিছুদিনের জন্য ছায়াছবি থেকে অবসর গ্রহণ করেন সুপ্রিয়া দেবী। আজ এই চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর ২য় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৮ সালের আজকের দিনে তিনে কলকাতায় মৃতবরণ করেন। বাংলার রূপালি পর্দায় ব্রহ্মদেশের বেণুর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


সুপ্রিয়া দেবী ১৯৩৮ সালের ৮ জানুয়ারি বার্মার (মায়ানমার) সুন্দর-দুর্গম এলাকা কাচিন প্রদেশের রাজধানী মিয়িৎকিনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম কৃষ্ণা এবং ডাকনাম বেনু। তার বাবা তাঁর বাবা বিখ্যাত আইনজীবী গোপাল চন্দ্র ব্যানার্জি ও মা কিরণবালা ব্যানার্জি। ব্যানার্জি দম্পতির আগেই তিনটি ছেলে ও সাতটি মেয়ে ছিল। শেষ সন্তানটি ছেলে হবে আশা করে বেণু যখন এল, বাবা-মা কেউ খুশি নয়। বেণুর সাড়ে তিন বছর বয়সে তাঁর বড় ভাই মারা গেলেন। মা বললেন, ‘ওই মেয়েটা অপয়া, ওর জন্যই আমার ছেলেটা মরে গেল। ওকে তাড়াও। নইলে ও সবাইকে খাবে।’ মেজদিই বেণুকে মায়ের আদর দিয়ে বড় করেন। পরিবার পরিজনদের সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। বাবা, কাকা, জ্যাঠামশাই তিনজনই স্কলারশিপ নিয়ে বিএ পাশ করেছিলেন। বিলেত গিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল বাবার। পরিবারের কারণে ইচ্ছে পূরণ না হওয়ায় সুদূর বর্মা-মুলুকে পালিয়ে গেলেন। বেণুদের বার্মার সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বার্মায় বসবাসরত অনেক ভারতীয় ভারতে চলে আসেন। বেণুর পরিবারকে বার্মা ছাড়তে হলো। তরুণ সুপ্রিয়া এবং তার পরিবারকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পায়ে হেঁটে কলকাতায় ফিরে আসতে বাধ্য করে। তারা কিছুদিন নারায়ণগঞ্জ, কিছুদিন মধুপুর, মুজফফরপুর হয়ে শেষতক কলকাতার গিরীশ মুখার্জি রোডে বসবাস শুরু করেন সুপ্রিয়া দেবীর পরিবার। সুপ্রিয়া দেবী ছোটবেলা থেকে নৃত্যের প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন, এমনকি তিনি থাকিন নু থেকে একটি পুরস্কারও অর্জন করেন। তার অভিনয়ে অভিষেক ঘটে মাত্র সাত বছর বয়সে, তার বাবা’র পরিচালিত দুইটি নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে


তার প্রথম চলচ্চিত্র নীরেন লাহিরী পরিচালিত ‘নাগপাশ’, প্রথম নায়ক অসিতবরণ। সেই চলচ্চিত্রে দেয়া তার প্রথম ডায়লগ ছিল ‘দাদা, ইনিই সে দিন আমাকে গুন্ডার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।’ ১৯৫২ সালে নির্মল দে’র পরিচালনায় সুপ্রিয়া দেবীর প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, নাম ‘বসু পরিবার’। চলচ্চিত্রে চরিত্রটির নাম ছিল সুজাতা, আর ভাই হিসেবে ছিলেন উত্তমকুমার। এ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পরিচিতি পান তিনি। এ চলচ্চিত্রেই সর্বপ্রথম তার নাম পরিবর্তন করে সুপ্রিয়া দেবী রাখা হয়। ১৯৫৯ সালে উত্তমকুমারের বিপরীতে ‘সোনার হরিণ’ তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তারপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রে ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’- এই আকুতি সুপ্রিয়া দেবীর অভিনয় দক্ষতায় এক অনন্য মাত্রা যোগ করে। এছাড়া তিনি সোনার হরিণ, শুন বরনারী, উত্তরায়ন, সূর্য্যশিখা, সবরমতী, মন নিয়ে, শেষ ঠিকানা, দেবদাস, কাল তুমি আলেয়াসহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেন। আপ কি পরিছাঁইয়া, দূর গগন কি ছাঁও মে, বেগানা, লাল পাথর নামে হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন তিনি।


ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৫৪ সালে ‘বসু পরিবার’ ছবিতে অভিনয় করার পর সুপ্রিয়া দেবীর বিয়ে হয়ে যায় বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জির সঙ্গে। বিয়ের পর অভিনয় ছেড়ে দেন তিনি। কিন্তু বিশ্বজিতের সঙ্গে তার দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি। একমাত্র সন্তান সোমার জন্মের পর তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি আবার রূপালিভুবনে ফিরে আসেন। উত্তম কুমারের সাথে কিছু হিট সিনেমায় কাজ করার পর, তাদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক তৈরী হয়। ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় উত্তম-সুপ্রিয়া জুটির ব্যবসাসফল ছবি ‘শুন বরনারী’। সহশিল্পী হিসেবে দুজন মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব।দুজনেরই ব্যক্তি জীবনের শূন্যতা থেকে হয়তো, জন্ম নেয় প্রেম। বড় প্রেম দূরে ঠেলে দেয় –কথাটি যেমন অনেক ক্ষেত্রে সত্যি তেমনি সব বাধা পায়ে দলে কাছে টেনে আনে দুজন মানুষকে –সেটিও সত্যি। মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর সেরা পথ নাকি পাকস্থলীর ভিতর দিয়ে। এটা সুপ্রিয়া দেবীর বেলায় খুব সত্যি। নিত্য নতুন রান্না করতে ভালোবাসতেন তিনি। আর মহানায়ক ভালোবাসতেন সেসব খেতে। সুপ্রিয়ার হাতের রান্নার দারুণ ভক্ত ছিলেন তিনি।ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেওয়ার পথে সমাজ, সংসারের কোনো বাধাই মানেননি মহানায়ক। ১৯৬৩ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর গিরীশ মুখার্জি রোডের পৈতৃক বাসভবন থেকে উত্তম কুমার চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ময়রা রোডের ফ্ল্যাটে। লোকনিন্দা, অপবাদ সবকিছু মাথা পেতে নিয়েও জীবনের সতেরটি বছর একসঙ্গেই বসবাস করে গেছেন উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী। আইনত বিয়ে করতে পারেননি কিন্তু বিবাহিত দম্পতির মতোই পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন তারা। বেণু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সুপ্রিয়া ব্যানার্জি, সুপ্রিয়া চৌধুরী হয়ে সুপ্রিয়া দেবী—এই চলচ্চিত্রযাত্রার নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে তিনি শুধুই উত্তমকুমারের একান্ত ‘সুপ্রিয়া’। দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি এবং উত্তম কুমার একসাথে বসবাস করেন। উত্তম কুমারের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পাশে ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে সাক্ষী ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী।২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি, ভারতের ৬৯ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের ভোরে নিজ বাসভবনে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান বাংলা চলচ্চিত্রের অত্যন্ত বর্ণময় এক চরিত্র, সুপ্রিয়া দেবী। তিনি দীর্ঘদিন যাবত বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুতে টালিগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে আসে। আজ এই চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর ২য় মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলার রূপালি পর্দায় ব্রহ্মদেশের বেণুর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল
ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×