somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তেভাগা আন্দোলনের ‘জনক’ হাজী মোহাম্মদ দানেশের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৮ শে জুন, ২০২০ দুপুর ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের কৃষকনেতা ও রাজনীতিক হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ব্রিটশ বিরোধী আন্দলনে নেতৃত্বদানকারী যে ক'জন বরেণ্য ব্যক্তির নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তাঁদের মধ্যে হাজি মোহাম্মদ দানেশ অন্যতম। তিনি ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাকে তেভাগা আন্দলোনের 'জনক' হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। এছাড়াও তিনি পূর্ব বাঙ্গলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ঠাকুরগাঁও তথা বৃহত্তর দিনাজপুরের মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আজীবন নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এই বিপ্লবী নেতা। তার নামে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুরের কৃষি কলেজ ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এ উন্নীত হয়। আজ হাজী মোহাম্মদ দানেশের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৬ সালের আজকের দিনেতিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের একজন কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।


হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জুন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে এক মুসলিম কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল মৌলভী সালামত উদ্দীন। নিজ গ্রামে শৈশবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হলে সেতাবগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশেআলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে এম.এ এবং ১৯৩২ সালে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঠাকুরগাঁও আদালতে প্রথম উকিল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। হাজী দানেশ ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন কৃষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং উত্তরবঙ্গে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তাঁর নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। আন্দোলনকালে তিনি গ্রেফতার হন এবং কারাভোগ করেন (১৯৩৮)। নীলফামারি জেলার ডোমারে ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হাজী দানেশ। সম্মেলনের পরপরই তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। বর্গাচাষীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান অব্যাহত রাখার কারণে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।


হাজী দানেশ তেভাগা আন্দোলনের নেতা হিসেবেই সমধিক পরিচিত। উত্তরবঙ্গই ছিল তেভাগা আন্দোলনের সুতিকাগার। উত্তরবঙ্গে এই আন্দোলনের উদ্ভব হওয়ার কারণ ছিল উত্তরবঙ্গ বরাবর জোতদার প্রধান তথা জোতদার শাসিত এলাকা। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আন্দোলনকে সার্থকতার উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়ার মরণপণ সংগ্রাম করেন সেই নেতারা অধিকাংশই ছিলেন উত্তরবঙ্গবাসী। তারা হলেন দিনাজপুরের হাজী মো. দানেশ, রিপন রায়(পার্বতীপুর থেকে), গুরুদাস তালুকদার, বরদা চক্রবর্তী, রূপনারায়ন রায়, হেলেকেতু সিং প্রমুখ বিপ্লবী নেতারা ছিলেন আন্দোলনের স্বাপ্নিক রূপকার। তার মধ্যে তেভাগা আন্দোলনের সর্বাধিক ত্যাগী ও তেজস্বী নেতারূপে হাজী মো. দানেশের নামটি ‘প্রবাদ পুরুষে’ পরিণত হয়। বর্গাচাষীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন। ঐ বছরই তিনি বঙ্গীয় সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৭ সালে মুক্তিলাভ করেন। এরপরই তিনি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে হাজী দানেশ গণতন্ত্রী দল নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে গণতন্ত্রী দল যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়। যুক্তফ্রণ্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে হাজী দানেশ ১৯৫৪ সালে দিনাজপুর থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৬ সালে মুক্তিলাভ করেন।


১৯৫৭ সালে গণতন্ত্রী দল বিলোপ করে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি কারারুদ্ধ হন। হাজী দানেশ ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৫ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে পদত্যাগ করে মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। হাজী দানেশ ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে (বাকশাল) যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। বাকশাল সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন পুনরুজ্জীবিত করেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে এই দল বিলোপ করে হাজী দানেশ গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে গণতান্ত্রিক পার্টি জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে একীভূত করা হয়। হাজী দানেশ জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন জাতীয় কৃষক পার্টির প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি দিনাজপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী কিংবদন্তি কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন ভোর ৪টা ২৫ মিনিটে তিনি ঢাকার পিজি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। রাজনীতিক এই প্রাণ পুরুষের এক ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে ছেলে ফারুক দানেশ ও দুই মেয়ে ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। এক মেয়ে সুলতানা রেদওয়ানা রানু (৭২) শারীরিকভাবে অসুস্থ। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। পূর্বে এটি কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছিল। আজ হাজী মোহাম্মদ দানেশের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। তেভাগা আন্দোলনের ‘জনক’ হাজী মোহাম্মদ দানেশের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল :-& ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২০ দুপুর ১২:২৪
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×