somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আধুনিক কবিতার কবি আবুল হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৯ শে জুন, ২০২০ রাত ১১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক নন্দিত কবি আবুল হোসেন। তিনি বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক কবি। স্বতন্ত্র কাব্য ভাষায় তিনি বাংলা কাব্যে তাঁর স্থান করে নিয়েছিলেন। 'নব-বসন্তের' কবি হিসেবেও তাঁকে অভিহিত করা হয়। ত্রিশের দশকে অবিভক্ত ভারতে তার লেখালিখির সূত্রপাত। আবুল হোসেনের কবিতার স্বপ্নভুবন, গদ্যের ভারিক্কিবোধ আর অনুবাদের বিশ্ব-অন্বেষা চিন্তায় তিনি কেবল নিজেকেই হাজির করেননি; সত্য-সুন্দর আর পৃথিবীর আবেগ-বাস্তবতার মেলবন্ধন নির্মাণ করতে চেয়েছেন অবিরাম। ১৯৪০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে “নববসন্ত” নামক প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ। ১৯৪০-এর দশকে শীর্ষ বাঙালি মুসলমান কবিদের তালিকায় ছিলেন কবি আবুল হোসেন। বাংলাভাষার প্রধান কবিমণ্ডলী রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদদীনের সঙ্গে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়; জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যের প্রথম সমালোচকও ছিলেন তিনিই। নজরুল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম কাব্য নববসন্ত প্রকাশের লগ্নেই। তাঁর কবিতা প্রকাশিত হচ্ছিল সে-সময়কার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে পরিচালিত বাংলাভাষার সেরা পত্রিকাগুলিতে। নিজেই জানিয়েছেন পরিশীলনের উৎসাহ তিনি পেয়েছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে। বোধ হয় পরিশীলনের প্রতি এতটা গুরুত্ব দেয়ার জন্যেই হয়তো আবদুল মান্নান সৈয়দ বা অন্যরা তাঁকে আমাদের প্রথম আধুনিক কবি হিশেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ পরিশীলন আধুনিকতা অর্জনেরই অন্যতম উপায়।বাংলা সাহিত্যের কবিতা শাখায় তার অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। পেশাগত জীবনে সরকারি আমলা হলেও কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রকাশিত। তার অন্যান্য পরিচয় কাব্য প্রতিভায় আড়াল হয়ে গেছে। কবি হিসেবে স্বতন্ত্র কাব্য ভাষায় তিনি বাংলা কাব্যে স্থান করে নিয়েছিলেন। আজ আধুনিক কবিতায় কবি আবুল হোসেনের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের আজকের দিনে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নন্দিত কবি আবুল হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীহতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।


কবি আবুল হোসেন ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট খুলনা জেলার ফকিরহাটের আড়–ডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এস. এম. ইসমাইল হোসেন এবং মাতা মরহুমা মেহেরুন নেছা। তার পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে ২৪ এপ্রিল বাগেরহাটে পাকিস্তানিরা সৈন্যদের হাতে নিহত হন। কবি আবুল হোসেনরা তিন ভাই তিন বোন। খুলনায় তাঁর দুই ছোট ভাই থাকেন। তার ছোট ভাই আমজাদ হোসেন একসময় পাকিস্তানের মন্ত্রী ছিলেন। আবুল হোসেনের শৈশব কেটেছে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণ নগরে, যৌবন কলকাতায় আর পরবর্তীতে বাংলাদেশে। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও পরে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি কলকাতা বেতারে কাজ করেন। সেখানে তাঁর সহকর্মী ছিলেন চল্লিশের দশকের শ্রেষ্ঠতম কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪), আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫) ও সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২)। তাঁদের পরস্পরের মধ্যে গভীর হৃদ্যতা ও সৌহার্দ ছিল। ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান ও আবুল হোসেন এ তিন কবিকে একসময় ‘ত্রয়ী কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভিন্ন ধারা নির্মাণে এ ত্রয়ী কবির ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। নববসন্ত কবিতাগ্রন্থ খ্যাত আধুনিক কবি আবুল হোসেন বৈশাখের ঝড়ের ভিতর বিদ্রোহ-আন্দোলনের বারতা অনুভব করেছেন। ফরাসি-রুশ-বাঙালির জেগে ওঠায় তিনি বৈশাখের প্রমত্ততার সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। তাঁর প্রত্যাশা, বৈশাখ যেন তার রাগ-আক্রোশ আর ঘৃণা দিয়ে জোচ্চোর সমাজটাকে ভেঙে-চুরে পাল্টে দেয়, যেন সমাজের সকল আবর্জনাকে ডাস্টবিনে কিংবা দূর পথপ্রান্তের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে। কর্মজীবনে কবি আবুল হোসেন সম্পাদক ছিলেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রবীন্দ্র পরিষদের, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যকরী পরিষদ, পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের কার্যনির্বাহী পরিষদ ও বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন, বাংলা একাডেমীর ফেলো ছিলেন। প্রথম যৌবনে লেখক হিসেবে দাঁড়িয়ে-পড়া এই শিল্পী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্মসচিব পদ থেকে অবসর নিয়েছেন ১৯৮২ সালে।


কবি আবুল হোসেন আজীবন নিরলসভাবে সাহিত্য-চর্চা করে গেছেন। কবির প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৩টি। কবিতার বই ১১টি, অনুবাদগ্রন্থ ৩টি এবং আত্মজীবনী চার খন্ড।তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ
কবিতাঃ নববসন্ত (১৯৪০), বিরস সংলাপ (১৯৬৯), হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২), দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে (১৯৮৫), এখনও সময় আছে (১৯৯৭), আর কিসের অপেক্ষা (২০০০), রাজকাহিনী (২০০৪), আবুল হোসেনের ব্যঙ্গ কবিতা ও গদ্যের বই দুঃস্বপ্নের কাল (২০০৭), প্রেমের কবিতা ও কালের খাতায় (২০০৮), গদ্য স্বপ্ন ভঙ্গের পালা (২০০৯)।
অনুদিত কাব্যঃ ইকবালের কবিতা, আমার জন্মভূমি ও অন্য ক্ষেতের ফসল।
স্মৃতিকথাঃ আমার এই ছোট ভুবন (২০০০) ও আর এক ভুবন (২০০৫)।
অনুদিত উপন্যাসঃ অরণ্যের ডাক।
ভ্রমণ কাহিনীঃ পার্বত্যের পথে।
সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮০ সালে একুশে পদক পান। এছাড়া তিনি জাতীয় কবিতা পুরস্কার নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, পদাবলী পুরস্কার, কাজী মাহবুবুল্লাহ পুরস্কার ও স্বর্ণপদক, আবুল হাসানাৎ সাহিত্য পুরস্কার, জনবার্তা স্বর্ণপদক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, জনকন্ঠ গুণীজন সম্মাননা ও জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক সংবর্ধনাসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।


ব্যক্তিগত জীবনে কবি আবুল হোসেনের পরলোকগত স্ত্রীর নাম সাহানা। ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের কছে তাঁর স্ত্রীর নামে রাখা ‘সাহানা’ নামের বাড়িতে কবি আবুল হোসেন বসবাস করতেন তাঁর দুই ছেলের সাথে। শতবর্ষের কাছাকাছি গিয়েও শতবর্ষী হতে পারেননি তিনি। ২০১৪ সালের ২৯ জুন ৯২ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রবীণতম কবি আবুল হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছিলেন। এদিন রাতে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে স্বজনেরা তাঁকে রাত পৌনে ১১টার দিকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। চল্লিশের দশকের পঞ্চপ্রধান মুসলিম কবি ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, তালীম হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান এবং আবুল হোসেন। ১৯৮৫ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে প্রথম চার কবি ইন্তেকাল করেন। তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ কবি আবুল হোসেন ৯২ বছর বয়সে বিদায় গ্রহণ করলেন। চল্লিশের বর্ণাঢ্য ও গৌরবময় কাব্য-জগতের শেষ দীপ-শিখাটিও নির্বাপিত হলো। আজ আধুনিক কবিতায় কবি আবুল হোসেনের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের আজকের দিনে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নন্দিত কবি আবুল হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীহতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল :-& ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০২০ রাত ১১:৪৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×