somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আষাঢ়স্য প্রথম কদম ফুল করিনু দানঃ বর্ষ পরিক্রমায় আবার এলো বর্ষা

১৫ ই জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জ্যৈষ্ঠ শেষ আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ। প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের রুদ্র দহন ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিক সূচনা হলো প্রিয় ঋতু বর্ষার। আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হযেছে আষাঢ় মাস ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। কাগজে কলমে বর্ষা ঋতুর চলে আসার দিন। তবে অলিখিতভাবে আরো কয়েক দিন আগে থেকেই বর্ষা কালবৈশাখীকে সঙ্গী করে তার স্বভাবসুলভ তেজের ছটা দেখিয়ে গেছে। প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের রুদ্র দহন ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিক সূচনা হলো প্রিয় ঋতু বর্ষার। তৃষিত হৃদয়ে, পুষ্পে-বৃক্ষে, পত্র-পল্লবে নতুন প্রাণের নতুন গানের সুর নিয়ে বর্ষা সমাগত। বর্ষা কবিদের ঋতু। বর্ষা নিয়ে কবিরা লিখেছেন অসংখ্য কবিতা-গল্প-গান। ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান” বর্ষা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই আবেগময়, প্রেমসিক্ত গান যেন সে কথাই বলে। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, বাংলা সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত বহু কবিই বর্ষার রূপ-ঐশ্বর্যে মোহিত ও মুগ্ধ, বর্ষার আবাহনে উচ্ছ্বসিত ও মুখর। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন, 'ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি'। প্রকৃতি পরিবেশের পাশাপাশি মানুষের হৃদয়েও নানাভাবে ক্রিয়া করে বর্ষা। মন মেঘের সঙ্গী হতে চায়। কবিগুরুর ভাষায়: মন মোর মেঘের সঙ্গী,/উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে/রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম...। বর্ষায় মন কখনো ‘ময়ূরের মতো নাচে রে।’ আবার কখনো বেদনায় বেদনায় ডুবায়। তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...। প্রিয়জন ছাড়া যেন কাটতে চায় না দিন। কারও কারও বুকে বাজে হারানোর ব্যথা। বর্ষায় সে যন্ত্রণার কথা কথা জানিয়ে কবি লিখেন: চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে,/অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদরে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা...। আরও বহুকাল আগে রিক্ত বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছিলেন: এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/মাহ ভাদর/শূন্য৬ মন্দির মোর...। এখানেই শেষ নয়, মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন। এসব বিবেচনায় বিরহের ঋতু বটে বর্ষা। বাদল দিনে বিরহকাতর হয়ে ওঠা বাঙালী মনের ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে সমকালীন কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপা-ব! হয়তো এ কারণেই বর্ষায় বিরহ বেড়ে যায়।মহাকবি কালিদাস তার ‘মেঘদূত’ কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহ কাতর যক্ষ মেঘকে দূত করে কৈলাশে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয়ার কাছে। বৃষ্টির শব্দে যক্ষের মতোই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের হৃদয় যেন এক অজানা বিরহে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তাই রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের উদ্দেশে লিখেছিলেনঃ ‘কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে/ কোন পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/ লিখেছিলে মেঘদূত। মেঘমন্দ্র শ্লোক বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক/রাখিয়াছ আপন আঁধার স্তরে স্তরে/ সঘন সংগীত মাঝে পূঞ্জীভূত ক’রে।’ বর্ষার সৌন্দর্যে বিমোহিত মধ্যযুগের কবি জয়দেবের কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়েছে- ‘মেঘৈর্মে দুরম্বরং, বণভুব শ্যামাস্ত মালদ্রুমৈ।’ সে যা হোক বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন পহেলা আষাঢ়। যদিও তার আগেই দেশে প্রবেশ করেছে বর্ষা। তবু ঋতুচক্রের নিয়মে আষাঢ় মাসের শুরু মানেই বর্ষার শুরু। আপাতত আষাঢ়, শ্রাবণ বর্ষাকাল। বৃষ্টিতেই কাটবে জীবন। এদিন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে খুব ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি না হলেও বৃষ্টি হয়েছে। কয়েক পশলা বৃষ্টি। মেঘলা আকাশ। এভাবেই কেটেছে দিনটা। বাংলার চিরায়ত বর্ষার রূপ-রস এবং সৌন্দর্য্য ও প্রকৃতির বিচারে বলা যায়, তাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরা নববর্ষার বারিধারায় সিক্ত হওয়ার দিন। বাঙালীর অতি প্রিয় এই ঋতুর আগমনে প্রকৃতি তার রূপ ও বর্ণ বদলে ফেলে। কেতকীর মনমাতানো সুগন্ধ, কদমফুলের চোখ জুড়ানো শোভা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছ্বল নৃত্যের আবাহন থাকে এই আষাঢ়েই। গাছপালা, তরুলতা, সবকিছুই যেন গ্রীষ্মের দহন থেকে মুক্তি পেয়ে বারিধারায় স্নান করে সজীব হয়ে ওঠে। প্রকৃতি ও উদ্ভিদরাজিও যেন ফিরে পেতে চলেছে শান্তি স্বস্তি ও জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। বৃষ্টির শব্দে যক্ষের মতোই বাঙালির হূদয় এক অজানা বিরহে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কেতকীর মনমাতানো সুগন্ধ আর কদম ফুলের চোখ জুড়ানো শোভা অনুসঙ্গ হয়ে আছে আষাঢ়ের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘হূদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মত নাচেরে, আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে..।


আষাঢ়ে প্রকৃতি রূপ-রঙে হয়ে ওঠে ঢল ঢল। তাপদাহে চৌচির মাঠ-ঘাট খাল-বিল বনবিথিকায় জেগে ওঠে নবীন প্রাণের ছন্দ। চারিধারে অথৈ থৈ থৈ পানিতে আবহমান বাংলার রূপ হয় অপরূপ রূপবতী সলিল দুহিতা। আষাঢ় মানেই সময়-অসময়ে ঝমাঝম বৃষ্টি, কর্দমাক্ত পথঘাট, খাল-বিলে থৈ থৈ পানি, নদীতে বয়ে চলা ছবির মতো পাল তোলা নৌকার সারি। বর্ষার নতুন জলে স্নান সেরে প্রকৃতির মনও যেন নেচে ওঠে। ফুলে ফুলে শোভিত হয় প্রকৃতি। তাল তমাল শাল পিয়াল আর মরাল কপোতের বন বীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়াসহ অসংখ্য ফুল। অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য উপকারের- এমনটি বলা যাবে না। ভারি বর্ষণে, পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয় সে-ও বর্ষা! অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার মানুষ এ সময় বন্যার আশঙ্কায় থাকে। কখনও কখনও কৃষকের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। শাহ আবদুল করিমের ভাষায় : আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/ গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়...। একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকোটি ঘাটে সব সময় ফিরতে পারে না! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্প তো প্রতিদিনের। বর্ষার কাছে কবিগুরুর তাই প্রার্থনা করে বলেন, এমন দিনে সকলের সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধারায়,/বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা...। এবার দেশে ভাল বর্ষার পূর্বাভাস রয়েছে। গত দু-বছরের মতো স্বাভাবিক বর্ষার হ্যাটট্রিক হবে এবার। দুই দশক আগেও ঘটেছিল এমনই বর্ষা। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট আউটলুক ফোরামের পর্যালোচনা অনুযায়ী, ২০২১ সালের দক্ষিণ এশিয়ায় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্ষাবিহীন বাংলাদেশ ভাবাই যায় না। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে নকশীকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে বর্ষার অপরূপ রূপ বর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত ও চিরকালীন হয়ে আছে। প্রতি বছর নানা আয়োজনে বর্ষাকে বরণ করে নেয় বাঙালী। ঢাকায় ছায়ানট, উদীচী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রিয় ঋতুর বন্দনা করে। তবে এবার করোনার দুঃসহকালে বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ। এ কারণে চারুকলার বকুলতলায় বা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে কোন আয়োজন থাকছে না। ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ দিয়ে প্রণয় নিবেদন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি নজরুল ইসলামের কাছে বর্ষাকে মনে হয়েছে ‘বাদলের পরী’। তিনি লিখেছেন: ‘রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে।’ বর্ষার আবাহনে চলমান তাপিত গ্রীষ্মের অবসান হবে সেই প্রত্যাশায় আষাঢ়স্য প্রথম কদম ফুল করিনু দান। আষাঢ়ের প্রথম দিনে সামুর শ্রদ্ধেয় মডারেটর, সম্পাদক, সূধী লেখক, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের সকলের জন্য বরষার শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২১ রাত ৮:০৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×