আমার মেয়েটা প্রচন্ড অভিমানী।ঠিক বাবার মতো রাগীও। তবে চারপাশের বাস্তবতার অনেক কিছু সে বুঝতে পারে।আমি অনেকক্ষণ মেয়েটাকে ডাকাডাকি করলাম৷ সে কিছুতেই সাড়া শব্দ করে না। এমন করে প্রায় আঁধাঘন্টা হয়।সে রুমের ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ করে না।
পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর ছোট্ট মনেও ভাবনার নিজস্ব পৃথিবী আছে।
এই বয়সে সে বেশ পরিশ্রমী ও।তবে অভিমান এসে গেলে অদ্ভুত খামখেয়ালিতে চলে।কাউকেই সে পরোয়া করে না। তাঁর এমন সব একরোখা আচরণের কারণে এই বয়সেই বাবার হাতের মার খায়।
আমি কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিলাম। সে কিছুতেই দরজা খুলল না।কিছুটা সময় এমন করেই গেল।
কিন্তু আমি জানি এক দেড় ঘন্টা পর সে নিজেই বের হয়ে আসবে। তারপর কিছুই হয়নি ভাব নিয়ে বলবে," মা, ক্ষুধা লেগেছে।নতুন কিছু বানাও তো।"
আমি এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে কেমন জানি অভ্যস্থ হয়ে গেছি। তাই পরবর্তী ঘটনা আমার জানা হয়ে গেছে।কিন্তু প্রায় এক ঘন্টা হয়ে যায় মেয়েটা কিছুতেই দরজা খুলছে না। হঠাৎই বুকের ভেতরটা কেমন মোচর দিয়ে উঠল। আমি আরও কয়েকবার ডাকাডাকি করলাম। দরজায় কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। মনেহল সে হয়তো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে কেটে একাকার।
এমন করে আরও কিছু সময় বয়ে গেল। আমি ক্রমাগত ধাক্কা দিয়েই গেলাম। আমার ছোট ছেলেটাও আপুনি আপুনি করে ডাকাডাকি করল। কিছুতেই সে দরজা খুলল না।
আমিও এই ফাঁকে সব গুছিয়ে নিয়ে নামাজে গেলাম। ছোট ছেলেটা টিভিতে কার্টুন দেখতে বসল। আমি ওকে বললাম আপুকে আবারও ডাকো।
সে ঘাড় নাড়িয়ে বলল, " আচ্ছা "
আমি নামাজ পড়া শেষ করে এসে দেখি আমার ছেলেটা নির্বিকার টিভি দেখছে।
-- আপুকে ডাকোনি?
-- না
-- কেন?
--আম্মু কার্টুন দেখি তাই।
--এখন কার্টুন দেখা বন্ধ কর।
-- আম্মু প্লিজ একটু পর।
--একটু পর নয় এখনই বন্ধ করে আপুকে ডাকো। তারপর দু'জনে পড়তে বসো।
-- আম্মু!
--নিশো!
--আম্মু প্লিজ
--নিশো, আম্মু কোন কথা বললে তা শুনতে হয়।
-- আমি মটু পাতলু দেখছি তো। এটা অনেক মজার কার্টুন আম্মু।
-- কি এমন মজার পরে দেখো।
-- এটা অনেক মজার। তুমি আমার বয়সি হলে বুঝতে।
--কেন আম্মুরা বুঝে না।
-- না তুমি ছোট হলে বুঝতে। এটাতো ছোটদের কার্টুন।
-- বড়দের দেখা নিষেধ?
নিশো টিভির দিকে হা করে থাকে। আমার কথার কোন গুরুত্বই দেয় না। একবার ভাবলাম টিভির রিমোটটা নিয়ে নেই। টিভিটা বন্ধ করে দেই। পরে মায়া লাগল। এমনিতেই আসাদ ঘরে মারপিট করে গেছে। ছেলেটার মন খারাপ হয়ে যাবে।মনটা ছোট হয়ে থাকবে।মা হিসেবে এতোটুকু বোঝা উচিত। একদিন না হয় কম পড়াশুনা করল। সুস্থ সময় তো পার করতে পারল।
আমি চা বসালাম। ভাবলাম কি রান্না করব। আমার মেয়েটা চিজ কেক পছন্দ করে ঝটপট বানিয়ে ফেলি।
নয়তো পটেটো টর্নেডো বানাব। কোনটা যে বানাব সেটাই বুঝতে পারছি না। দেখি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে।
আমার প্রতিদিনের সব কাজেই অভিনন্দনের স্মৃতি চলে আসে। অভি পটেটো চপ আর পুডিং খেতে খুব ভালবাসতো। লৌহজং থাকতে একবার নিজ হাতে পুডিং খাওয়ানোর সুযোগ হয়েছিল।ফের যখন অভির সাথে আমার লৌহজং দেখা হল আমি বোধহয় নতুন করে বেঁচে উঠেছিলাম। কিন্তু হায় জীবন ক্ষনিকের সুখ দিয়েও ফিরিয়ে নিয়েছে।
আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। এরমধ্যে আরও কয়েকবার দরজায় নক দিলাম। কান পেতে শুনলাম। এবার মনেহল সে আর কাঁদছে না। কারও সাথে কথা বলছে।ফিসফিস আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আবার একটু পর পর হাসিরও শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি এবার একটু টেকনিক চেঞ্জ করে বললাম," নুশমা, মা বের হও তো একটু। এই তো দেখো চিজ কেক আর পটেটো টর্নেডো বানাচ্ছি। একটা টিকটক করে দিয়ে যাও। "
-- মা পরে আসছি।
-- তোমার আব্বু তো চলে আসবে। তোমার বান্ধবী ফাহার আম্মুর লাইকির একাউন্ট আছে। আমাকে একটা খুলে দিও তো।
-- ও তাই কে বলেছে আম্মু?
-- ফারহার আম্মুই বলেছে। তুমি বের হও।
-- আব্বু তো রাগ করে বের হয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি ফিরবে না। দাদুর বাসায় যাবে। ফুপুদের বাসায় গল্প করে ফিরবে।
-- আসো এক সাথে আনন্দ করি। শাহরুখ খানের একটা সিনেমার গানের টিকটিক খুব চলছে। আসো আম্মু....
-- আম্মু আসছি একটু। প্লিজ পাঁচ মিনিট ওয়েট করো।
পাঁচ মিনিটের জায়গায় সে পঁচিশ মিনিট পর বের হল।
আসাদের অন্যান্য ভাই বোনেরা ও মা বাবা আমাদের বিল্ডিংয়েই থাকে। তবে ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটে। আসাদের বাবা মানে আমার শ্বশুর অনেক আগে থেকেই দূরদর্শী ছিলেন। সন্তানদের ভবিষ্যত নির্মানের কাজটা নিখুঁতভাবে করেছেন। সবাই ঢাকা শহরে বাড়ি গাড়ির মালিক। পড়াশোনা ও সামাজিক অবস্থানে বেশ শক্ত।
আমার ছেলে মেয়ে দু'টোর ভবিষ্যৎ কি হবে আমি জানি না।
তবে আসাদ আমাকে অবহেলা করলেও সন্তানদের ব্যাপারে বেশ সচেতন। তবে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
যতো বার ঝগড়া বা সংসারে অশান্তি হলে সে বোনদের বাসায় যায়। কেন জানি ভাইয়ের কাছে যায় না। আমার ননদ ননাশ গুলো দেখতে যেমন কুৎসিত তেমনি মনের ভেতরটাও অন্ধকারে নিমজ্জিত।
আমি হয়তো রেগে গিয়ে মানুষের বাহ্যিক চামড়ার সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু রাগ করে বললেও এটাই সত্যি। প্রচলিত প্রবাদ সব বাস্তবতায় এক হয়না।
সমাজে অনেক কথা প্রচলিত আছে। লোকে বলে সুন্দরি মেয়েরা খারাপ হয়। তাঁরা লোভী হয়। কিন্তু এর উল্টোটা ও তো আছে। রূপ সুন্দর হলেই যে জীবন ও চারপাশ সুন্দর হবে তা তো নয়।
আমার ননদ ও ননাশ গুলোর টাকার অহংকার ছাড়া বলবার মতো কিছুই নেই। জীবনের অনেক সূক্ষ্ণ দিক তাঁদের অনুভূতিতে নেই।
তাঁরা বুঝে শারিরীক ও অর্থনৈতিক সুখ। আর অন্যকে কিভাবে দমিয়ে রাখতে হয়।তাঁদের রূপ ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী সবাই বেশ ভাল ভাল পাত্র পেয়েছে। বরদের বেশ শক্ত ভাবেই নিজেদের অধিকারে রাখে। বর গুলোও কি সুন্দর বিশ্রী মহিলা গুলোর নখের তলে জীবন যাপন করছে৷অনেকেই ভাববে আমি হয়তো প্রচন্ড ঘৃনাবোধ থেকে এসব বলছি। আসলে তা নয়৷ অদ্ভুত এক বাস্তবতা।
প্রতিটি মহিলা ভাল জানে ভাইয়ের সংসারে কিভাবে রাজনীতি করতে হয়। কিভাবে নিজের বর ও ভাইদের নিজেদের নখদর্পনে রাখা যায়।
জানিনা ওরা হয়তো হীনমন্যতায় ও ভোগে। টাকার মধ্যেও হয়তো সুখ খুঁজে পায় না। সব সময় ভাইকে আমার বিরুদ্ধে বলে কান ভারী করে রাখে। আসাদ যে আমায় ভালোবাসে না তা কিন্তু নয়। কিছু পারিবারিক দায়িত্ববোধ আছে বলেই সম্পর্কটা এতো বছর টিকে আছে। কিংবা আমি টিকিয়ে রেখেছি।প্রকৃতির নিয়মেই নিদারুণ নিষ্ঠুরতা আমি সহ্য করতে শিখে গিয়েছি।
আমার মেয়েটাকে নিয়েও ভীষণ ভয় হয়। এতোক্ষণ যার সাথে কথা বলছিল সে আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের নাজনিন ভাবির ছেলে। নুশমাদের ব্যাচমেট। নাজনিন ভাবির বর আসাদের বন্ধু। ভাবির সাথেও আসাদের বেশ সখ্যতা আছে।
উনারা পাশের বিল্ডিংয়ের দশ তলায় থাকে। নুশমার রুমের দিকটায় নাজনিন ভাবিদের ফ্ল্যাটের একটা ছোট বারান্দা আছে।
সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাজনিন ভাবির দুই ছেলে মোবাইলে গেমস খেলে। মাঝে মাঝে নাজনিন ভাবি দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলে৷ ভাই সিগারেট খায়। নাজনিন ভাবির বরের নাম মোস্তাক। উনারা স্বামী স্ত্রী দু'জনে শিক্ষক।
মোস্তাক ভাই একটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর ভাবি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিযুক্ত শিক্ষক। বেশ কয়েক বছর ঢাকার বাইরে ছিলেন। পাঁচ বছর হয় ঢাকার একটি সরকারি কলেজে পোস্টিং হয়েছে। বেশ খোলামেলা ও স্বাধীন জীবন যাপন করেন। খুব যে সুন্দরি তা কিন্তু নয়৷ মুটামুটি মানিয়ে নেওয়ার মতো। দুই বার আমাদের বাসায় এসেছিলেন।নুশমার পড়াশুনা ও তাঁর ছোট ছেলেকে কোন স্কুলে ভর্তি করবে সে খোঁজ নিতে।
মহিলা ভদ্র তবে আমি বাসায় থাকি। কোন চাকরি করি না তাই আমার প্রতি তাঁর একটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ আমাকে ভীষণ আহত করেছিল।
যে দুই বার তাঁরা আমাদের বাসায় এসেছেন ততোবার দেখেছি আসাদকে ও আমার সাথে তাচ্ছিল্যের সাথে কথাবার্তা বলতে দেখেছি।
অথচ নাজনিন ভাবির মতো আমার ও জীবন হতে পারতো। যদি বাবা মায়ের আর স্বামীর সাপোর্ট থাকতো।
আসাদ তাঁর চারপাশের মানুষজন দ্বারা খুব সহজেই প্রভাবিত হয়। সেই প্রভাব খুব দ্রুত সে প্রকাশ করে ফেলে।আমার ধারণা পৃথিবীর সবাই তাঁর চারপাশের মানুষজন দিয়েই প্রভাবিত হয়। আসাদ ও মানুষ। প্রভাবিত হওয়াটা স্বাভাবিক। একজন নারী শুধু গৃহে থেকে স্বামী, সন্তান ও সংসার দেখভাল করলেই সে অবহেলিত বা তাঁকে অপমান অসম্মান করতে হবে এটা ঠিক না।
নাজনিন ভাবি ছেলেদের তেমন সময় দিতে পারেনা। যতোটা আমি আমার সন্তানদের দিতে পারি।
একজন নারীর জীবনে কী চাকরিই মর্যাদা, তাঁর জীবনে মাতৃত্ব, সংসার, স্বামীর প্রতি অবদানের কোন মর্যাদা নেই?
বাস্তব সত্য গুলো সবাই জানে কিন্তু কেন জানি মানুষ অন্যকে অসম্মান করে আনন্দ পায়৷ ভীষণ রকম বিকৃত আনন্দ পায়।
ক্লাস নাইনে পড়া ছেলে মেয়েদের বয়সটা ভীষণ বিপদের।আমার খুব ভয় হয়। ওই ছেলেটার সাথে যদি নুশমার কিছু হয়। আসাদ সমস্ত দোষ আমাকেই দিবে। পুরো পরিবার আমাকে নাজেহাল করবে। পরিনতি ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠে।
এরমধ্যে হাজারও চিন্তার ভিড়ে আমি কেক ও পটেটো টর্নেডো তৈরি করে ফেলেছি।
নুশমা ও নিশো দুই ভাই বোন কি সুন্দর পাশাপাশি বসে রিল্যাক্স মুডে কার্টুন দেখছে। আর দু'জনে খুনসুটি করছে কার্টুনের বিষয় নিয়ে।
ওদের দেখে আমার অতল সমুদ্রে ডুবে যাওয়া পৃথিবী নতুন করে বেঁচে উঠতে চায়। আমি মনের অজান্তে নতুন স্বপ্নের পথে হাঁটতে থাকি। এক সময় কোন একটা ভয়াবহ পিছুটান আমার পা টেনে ধরে। আমার ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্ন গুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আমি অতলান্ত স্বপ্নের ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে আসি।
এমন সময়ে কলিং বেল বাজে। হয়তো আসাদ বাসায় ফিরেছে
আগের পর্ব -৩
https://www.somewhereinblog.net/blog/nurunnaharlilian/30292071
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:০৪