এখন কোথায় যাওয়া যায় ?
শহীদ এখন টেলিভিশনে । শামসুর রাহমান
সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন । হাসানের বঙ্গজননীর নীলাম্বরী বোনা
আমার দ্বারা হবে না । জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান ।
অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না , কেননা :
আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে । (আমার সমস্ত গন্তব্যে )
বিধায় , আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন । তার নির্মিত পটভুমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতা ই আত্মবিশ্বাস । জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পুর্ন ভিন্ন প্রকৃতির কবি । কারো প্রতিধবনি নয় , নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে । ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান । আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন :
] "আমার বিষয় তাই , যা গরীব চাষীর বিষয়
চাষীর বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর
কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন
সীমাহীন মাঠ ।
চাষীর বিষয় নারী ।
উঠৌনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা ।
পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী । " (কবির বিষয় )
স্পন্দমান আবগের ভুগোল , দেশজ চেতনা ,লেককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি । যেমন তিনি তার শ্রেষ্ট কর্ম 'সোনালী কাবিন ' এ মাতৃভুমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনিষঙ্গসমুহ । তিনি এখানে শক্তিমত্তার সাথে রোমান্টিসজম প্রবেশ করিয়েছেন যা 'সোনালী কাবিন ' সনেট গুচ্ছকে করেছে মহিমান্নিত ।
"সোনার দিনার নেই , দেন মোহর চেয়ো না হরিনী
যদি নাও , দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ন কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি ;
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি । "
'সোনালী কাবিন'সনেটগুচ্ছ কবি উপমা -রুপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন , আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল । গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন , নদীর চরের প্রতি কৃষানীর পতির অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমানিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙখার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে । এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীন প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে -
"ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায় । "
বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে হলে আমাদের আল মাহমুদের কবিতার দরজায় নক করতেই হবে ।
" কবিতা কি ?
কবিতা তো শৈশবের স্মর্তি
কবিতা চরের পাখী , কুড়ানো হাসের ডিম , গন্ধভরা ঘাস
স্নান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর
কবিতাতো মক্তব্যের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার ।"
( কবিতা এমন )
কবিতা সহ সাহিত্যের কোন শাখায় নর-নারীর মিলঙ্কে অস্বীকার করা যায় না । হুইটম্যানের কবিতায় ভাবের এক বে আব্রু প্রকাশ দেখে আমরা তাই আতঙ্কিত হলেও খুব্ধ হইনা :
It is I , you women , I make my way
I am stern acrid , undissuble , but I have you
I do not hurt you any more than is necessary for you
I pour the stuff to starts sons and daughters fit for these states
I press with slow rude muscle
I brace myself effectually. I listen to no entreaties
I dare not with draw till deposit what has so long accumulated within me.
তখন আমরা মু্গ্ধ হই এই ভেবে যে , মানব মনের একটি অদৃশ্য ও আদিমতম কামনার জোয়ারকে কবি বিন্দুমাত্র বাঁধা না দিয়ে তার প্রবাহমানতাকে আরো স্বচ্ছন্দ দিয়েছেন । আল মাহমুদ 'সোনালী কাবিন' কাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপুর্ব চিত্রায়ন পুর্বক আদি ও অন্ত পর্যন্ত চিরন্তন রোমান্টিক ধারাকে প্রজ্জ্বল করেছেন :
" তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ । "( সনেট ১০ )
আল মাহমুদ যে মৌলিক ও নতুন কবি তা আগেই বলা হয়েছে । একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে । আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাকরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মানে । সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তার কবি হূদয় সর্বদা সুন্দরের পুজারী । তিনি তার কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মান করেছেন ।
বক্ষমান রচনায় আমাদের বিবেচনা তার নারী সৌন্দর্য বন্দনা । আল মাহমুদের নারী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক , কামোদ্দীপক ও সৌন্দর্যময় । এক্ষেত্রে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের মন্তব্যটি যথার্থ : "তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী । কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদাম করে । তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার । অভাবের অজগর তার টোটেম । যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানকৌড়ি পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে সে কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন । " (একজন খাটি কবি , উপমা , পৃ ২৫ )
নারী দেহের স্তনের বর্ণনা দিতে বিদ্যাপতি রাধিকার স্তনকে বলেছিলেন -"হেম কমলন জনি অরুণিত চঞ্চল ।" সৈয়দ আলী আহসান সহসা সচকিত এর ৩১ নং কবিতায় উল্লেখ করেন -
"কভু মনে হয় পদ্ম কোরক
দেহ তরঙ্গে বিকশিত
শিশির উষার সুর্যের তাপে
যেন আশংকা বলসিত । "
আল মাহমুদ নারী স্তনের সৌন্দর্য যেভাবে কল্পনা করেন -
* শঙ্খমাজা স্তনদুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি (সিম্ফোনি : লোক লোকান্তর)
*তার দুটি মাংসের গোলাপ থেকে নুনের হাল্কা গন্ধ আমার
(চক্রবর্তী রাজার অট্রহাসি : মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে)
*...চোখ যেন
রাজা মহীপালের দিঘী । আর বুক দুটি
মিথুনরত কবুতর ।
( অস্পস্ট স্টেশনঃ আরব্যরজনী্র রাজহাঁস )
*ইস্পাহানের হলুদ আপেল বাগান আমার হাতে দুলে দিয়েছে
তার সুপক্ক দুটি সোনালি ফল ।
তোমার ব্লাউজের বোতাম খো্লো ....
( অভিযোজনা ঃ আমি , দুরগামী )
আল মাহমুদ এখানে স্তনের সৌন্দর্য উপমার চিত্র কল্পনা করেছেন ঃ শঙ্খমাজা শ্বেতপদ্ম কলি, মাংসের গোলাপ , মিথুনরত কবুতর ,সোনালি ফল ইত্যাদির সাথে ।
নারী দেহের প্রধান সৌন্দর্য অংগ তার যোনী । মধ্যযুগের বেশ কিছু কবি যোনীকে পুস্পের সাথে তুলনা করেছেন । আধুনিক কবি সৈয়দ আলী আহসান যোনীকে দ্বিদল ফুলের সাথে তুলনা করেছেন -
প্রাচী্ন কাব্যে উরু সংযো্গ
যেনবা অমোঘ দ্বিদল ফুল
আল মাহমুদ রমনী দেহের যোনীকেও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিভিন্ন উপমায় শোভিত করেছেন যেমন -
*আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো বুকের গঠন
লুকানো যায়না তবু অনিবার্য যৌবনের ফুলপ্রতীকের মত যেন জেগে থাকে তোমার জঘন ।
(অহোরাত্রঃ লোক লোকান্তর)
*সর্প বিতানের কোনো ফলবান বৃক্ষের শিকড়ে
খুলে দিয়ে দুটি উষ্ণ উরুর সোপান
ঢেকে আছে নগ্নযোনি গহরফলক( শিল্পের ফলক : ঐ )
*আঘাত থকে আসবে ছেলেগুলো
নাভির নিচে উষ্ণ কালসাপ
( মাংসের গোলাপ : কালের কলস)
* তোমার নাভিমূলে দেখেছি একা আমি
নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ ।
( শোনিতে সৌরভ : সোনালী কাবিন )
* চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাজ
উগোল মাছের মতো খুলে দাও শরীরের ভাজ ।
(আষাড়ের রাত : আরব্যরজনীর রাজহাস )
*আবার বুকের কাছে মুখ । ঘামে ভেজা মাংসের কিষান
তৃপ্ত করে জ্যামিতির গুল্মময় ত্রিকোন কর্দম । ( ঐ)
* তবুওতো চাদ উঠে জনপদে । ব্রাকের
আপার মতো ঠাট
চান্দেরী শাড়ির নিচে জোছনা দেখানো গুঢ় রাত ।
(খরা সনেট ৪: দোয়েল ও দয়িতা )
* ত্রিকোন আকারে যেন
ফাক হয়ে রয়েছে মৃন্ময়ী ।
(প্রকৃতি , সোনালী কাবিন )
* জলজ তুনের মতো ফের
জন্ম নেবে ধরত্রীর মুত্রভেজা যোনীর দেয়ালে ।
( ভারতবর্ষ , বখতিয়ারের ঘোড়া )
* তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
(সনেট , সোনালী কাবিন)
নারীর যোনীকে আল মাহমুদ প্রতীকের মত জঘন, গহরফলক,উষ্ণ কালসাপ,নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ , চরের মাটির মতো শরীরের ভাজ,ত্রিকোন কর্দম ,গুঢ রাত , ত্রিকোন মৃন্ময়ী ,মুত্রভেজা যোনীর দেয়াল, যৌবন জরদ ইত্যাদি উপমায় সুশোভিত করেছেন ।
আল মাহমুদের ইসলামি কবিতা বাদে প্রায় সব কবিতায় নারী দেহের সৌন্দর্য , উপমা ও যৌনতা প্রকাশ পেয়েছে । তিনি নারী নিসর্গ প্রেম ভালবাসায় কৃত্রিমতার বা রাখ ঢাকের খোলস নির্মান করেননি । তিনি মার্ক্সিস্ট থেকে ইসলামের বিশ্বাসি হয়েছেন কিন্তু তারপরও
তার কবিতায় আমরা দেখছি মাংসের গোলাপ , মিথুনরত কবুতর , ত্রিকোন কর্দম কারন তিনি প্রথমত কবি শেষত ঐ কবিই ।
ষাটের মান্নান সৈয়দ কে আমরা দেখেছি নারী নগ্নতার মধ্য দিয়ে পরাবাস্তবাতা ও আধ্যাত্মার কথা বলতে । একই দশকের শ্রেস্ট কবি নির্মলেন্দু গুনের কাম বিষয়ক কবিতার সমগ্রও আমরা হাতে পেয়েছি ।
নর-নারীর যুথজীবন যাত্রায় নগ্নতা , রম্যতা , জীবন ঘনিস্টতা অতি বাস্তব । এই বাস্তবতাকে উপমা -চিত্রকল্পে যথার্থ করা -শব্দের এবং চিত্রের অর্থ্ময়তা ও আনন্দময়তা যে কবি যতবেশি দান করতে পারেন নব নব শিল্প চিত্রনে সে তত বড় কবি ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১১ সকাল ১১:১৮