২.
মইন ভাত খাচ্ছে খুবেই তৃপ্তি নিয়ে।
মিতুর মইনের খাওয়া দেখতে খুবেই ভাললাগছে।
খাওয়া থামিয়ে সে বলে, কিরে তুই খেয়েছিস?
- না আমার শরীর খারাপ লাগছে। পরে খাব। তুমি খাও।
- রান্নাটা কিন্তু অসাধারণ হয়েছে। বহুদিন পর এতটা তৃপ্তি নিয়ে ভাত খাচ্ছি। তোরে অনেক ধন্যবাদ।
-
- সকালে বাসা থেকে ভাত খেয়ে বের হওনি বলেই তোমার কাছে ভাত এত ভাললাগেছে। এত রান্নার বিশেষ কোন ভুমিকা নেই। মা বলেছে গরুর মাংসে নাকি কেমন হাম্বা হাম্বা ঘ্রান ভাসছে।
- খালার রান্নার চেয়ে ভাল হয়েছে বলে উনি হয়ত তোকে ঈর্ষা করছে।
- ঠিক আছে। তুমি খাও আমাকে আলু দিতে হবেনা।
মিতু উঠে জানালার পাশে দাড়ায়। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ তার মনকে আরো বেশি বিষণœ করে দেয়। কেন যে এই মানুষটাকে দেখার জন্য উতালা হয়ে থাকে তার মন? জেদি মেয়ে হিসেবে মিতুর বদনাম আছে কিন্তু মইনের কাছে তার কোন কিছুরই যেন মূল্য নেই। সব ব্যাপারেই মইন নির্বিকার। অসহ্য!
Ñ কিরে কি ভাবছিস?
Ñ কিছুনা।
Ñ আমার ধারণা তুই আমার প্রেমে পড়েছিস।
হঠাৎ করে আচমকা মইনের এমন কথা শুনে বুকের ভেতর ধাক্কা লাগে মিতুর। চমকে গিয়ে ম্লান মুখে মইনের দিকে তাকায় সে। মইন দাত বের করে হাসছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মিতু প্রশ্ন করে, কেন এমন মনে হল তোমার?
স্বাভাবিক কণ্ঠে মইন বলে, তুই ছাড়া এতটা আগ্রহ করে কেউ আমাকে ভাত খাওয়ায় না। তারপর অকারনেই হাসে মইন। এমন উত্তর শুনতে ভাললাগেনা মিতুর। সে মুখ ঘুরিয়ে দীর্ঘঃশ্বাস লুকায়। কিছুক্ষন পর মিতু স্বাভাবিক গলায় বলে, মইন ভাই তুমি আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাও আমি তোমাকে সারা জীবন এভাবেই আগ্রহ নিয়ে ভাত খাওয়াবো।
মইন হাসতে হাসতে বলে, ডাক্তার মেয়ের এমন বাউ-ুলে জামাই! খালা শুনলে আমাকে ক্রশফায়ারে দিবে।
মিতুর বলতে ইচ্ছে করে মইন তোমাকে ছাড়া আমি বাচবনা। আজন্ম আমি শুধু তোমাকেই চাই। কিন্তু মিতু তা বলেনা। সে এধরনের হালকা মেয়ে নয়। তার মুখে এসব কথা সাজেনা। বুকের ভেতরকার অনুভুতি প্রকাশ করার মত মেয়ে সে না।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে।
সোনালী রোদে ঝলমল করছে চারপাশ। আকাশের বুকে জমে থাকা মেঘ গুলি ঝরে গিয়েছে। চারপাশের প্রকৃতিকে বড় পবিত্র মনে হচ্ছে।
মইন টেবিল থেকে উঠে দাড়ায়। তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে বলে, কিরে মেঘকন্যা কি ভাবছিস?
মিতু তার উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকে। গাধামানবটার জন্য তার কেন এত টান সে বুঝতে চেষ্টা করে।
আমি যাইরে, খালু জেগে উঠে যদি আমায় দেখে, তাহলে দাবা খেলতে বলবে। ভাল থাকিস।
মিতুর খুব ইচ্ছে করে মইনের হাতটা ধরতে। মনে পড়ছে ছোট বেলায় মইন তাকে এমন বৃষ্টির দিনে কত গল্প শুনাতো। কত আবদার নিঃদ্ধিধায় মেনে নিত মইন!
মইন ছোট বেলা থেকেই খুব চঞ্চল। মিতুদের পরিবারে ছেলে নেই বলে অনেক টুকটাক কাজ-কর্ম মইন করে দিত আগে থেকেই। মিতুর বাবা তাই মইনকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু বড় হতে গিয়ে মিতু দেখলো সে যতই মইনকে কাছে টানতে চাইছে মইন ততই যেন নিজেকে মিতুর কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ ঘরের অন্যদের সাথে মইন বেশ স্বাভাবিক আচরন করছে। কেন এমন করছে মইন? ভেবে পায় না মিতু। সে গভির দৃষ্টি দিয়ে মইনের চোখের দিকে তাকায়। মইন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নিজেকে আবারও ধিক্কার দেয় মিতু।
মনে মনে বলে, কেন যে শয়তানটাকে ভালবাসতে গেলাম! ওর কি সময় আছে নারীর হৃদয় বোঝার? ভাল করে সে দেখলোই না আমাকে। তার জন্য একটা মেয়ে বিষের বোতল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেকি তা জানতে পারবে কোন দিন?
মিতুর কলেজে কত সুন্দর সুন্দর ছেলে আছে, যাদের কাছে মইন কিছুই না। অথচ কি আশ্চর্য তাদের প্রতি মিতুর বিন্দু মাত্র আর্কষন ফিল করে না। তার বুকের ভেতর শুধু একটি নাম মইন আর মইন।
রাত জেগে মিতু শুধু মইনকেই ভাবতে তার খুব ভাললাগে। মিতুর হৃদয় আকাশে শুধু একটাই নাম। তার খুব ইচ্ছে করে মইনের হাত ধরে পথ চলতে। মিতু ভেবে পায়না কেন মইনকে ভালবাসতে এত ভালেলাগে তার! ভালবাসা নামক বায়বীয় শব্দটা তার জীবনটাকে যেন অতিষ্ট করে তুলছে।
ভাবনায় ছেদ পড়ল আনিসের ফোনে, রিসিভ করতেই ও বললো, মিতু তুমি কি একটু হাসপাতালে আসতে পারবে? মইন মটর সাইকেল এ্যাকসিডেন্ট করেছে। অবস্থা বেশি ভাল না।
-কি বলছেন? ও না কিছুক্ষন আগে আমাদের বাসা থেকে বের হল? আতংঙ্ক মিশ্রিত কণ্ঠে বলে মিতু।
আনিসের কাছ থেকে হাসপাতালের নাম জেনে নেয় মিতু। তারপর দ্রুততার সাথে পোশাক বদলে তার মায়ের সামনে দাড়ায়। মিতুর চোখে জ্বল দেখে সিমা বেগম অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে? কাদছিস কেন?
মইন ভাই এ্যাকসিডেন্ট করেছে। আমি দেখতে যাচ্ছি।
সিমা বেগমের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে যায় মিতু।
বজলু সাহেব ঘুম থেকে উঠে আসরের নামাজ পড়তে ছিলেন।
নামাজ শেষে সিমা বেগমের কাছে এসে বললেন, কি হয়েছে মিতু কোথায় গেল?
সিমা বেগম ঝাঝালো গলায় বলে, তা তোমার মেয়েকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। মইন নাকি এ্যাকসিডেন্ট করেছে! তোমার মেয়ে তো একটা ..
বজলু সাহেব নিরর্থক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার স্ত্রীর দিকে। কিন্তু তাকে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন না করে তিনি ডোয়িং রুমে চলে গেলেন। টিভি অন করতেই দেখলেন টিভিতে টকশো চলছে। বেশির ভাগ বাংলা চ্যানেল জুড়ে শুশীল নামধারী বুদ্ধিজীবীদের উৎপাত! যেকোন প্রসংঙ্গেই দুই দলে বিভক্ত বুদ্ধিজীবীরা তর্ক যুদ্ধে মেতে উঠে। তারা কিছুতেই এক হতে পারে না। মুখে মেকাপ নিয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে বসে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায়না। কেউবা উত্তেজিত হয়ে তেড়ে যায় বলে চোখ তুলে ফেলবো!
আগে গ্রাম-গঞ্জে কবির লড়ায় হইতো, পালা গান হইতো এখন আর সেদিন নেই। এখন বুদ্ধিজীবীদের লড়াই হয়!
অনেক সময় উপস্থাপক না পেরে বিজ্ঞাপন বিরতি দিতে বাধ্য হয়। বজলু সাহেব আশা করছেন অচিরেই এইসব আঁতেল গুলিকে নিয়ে ডাবলু ডাবলু এফ টাইপের রেসলিং পোগ্রাম হয়ত শুরু করবে কোন চ্যানেল!
বিজ্ঞাপনের ফাকে ভাল অনুষ্ঠান খুজতে ছিলেন বজলু সাহেব। কিন্তু হঠাৎ করেই সিমা বেগম এসে এক ঝটকায় তার হাত থেকে রিমোট নিয়ে নিলেন।
চ্যানেল ঘুরিয়ে তিনি ষ্টার প্লাসে দিলেন। এখানে তার প্রিয় হিন্দি সিরিয়াল চলছে। এসব সিরিয়ালের সিরিয়াস দর্শক হল সিমা বেগম। মুখে এক ইঞ্চি পুরু মেকাপ লাগিয়ে আর দামি শাড়ি গহনা পরিয়ে আর পরকিয়া সহ পারিবারিক ঝগড়া ফ্যাসাদের নানা কুটচাল সম্বলিত গল্প নিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলছে সিরিয়াল। এর যেন থামার কোন লক্ষন নেই। বজলু সাহেব দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দাড়ালেন। তিনি বারান্দায় গিয়ে পত্রিকা পড়বেন। টিভি রুমে তিনি বছরের পর বছর ধরে অনাহূত।
মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে বলে কি,তার সাত খুন মাফ হইয়া যাবে?
কেন কি হয়েছে?
মইনের কোথায় বাইক চালাতে গিয়ে হাত পা একটু ভেঙেছে তা শুনে তোমার মেয়ে দৌড় দিল!
ওর ভাই না? ছোট বেলা থেকে দুটো এক সাথে বড় হচ্ছে, আর পাশাপাশি বাসা বলেইতো সর্ম্পকটা একটু বেশি। এত দোষের কি হল?
সেই বুদ্ধি তোমার কোন কালে হবে? ওমন ছন্নছাড়া বেকার যুবকের পাল্লায় পড়ে তোমার মেয়ের যদি কিছু হয় আমি তোমাকে ছাড়বো না, বলে দিলাম। আর তোমার কি লজ্জা করে না এমন একটা ছেলেকে জামাই বানাতে চাচ্ছো?
হতভম্ব হয়ে বজলু সাহেব সিমা বেগমের দিকে তাকান। বিস্মিত হয়ে বলেন, হিন্দি আজুগুবি সিরিয়াল দেখে দেখে সত্যি তুমি আ্যাবনরমাল হয়ে যাচ্ছো! মইন মোটেও খারাপ ছেলে না। তাছাড়া তোমার ওমন বদমেজাজী সেন্টিমেন্টাল মেয়ের প্রেমে পড়বে এমন বুকের পাটা কার আছে?
কথা না বাড়িয়ে বজলু সাহেব বারান্দায় গিয়ে ইজিচেয়ারে বসে চোখের সামনে পত্রিকা মেলে ধরলেন।
চলছে....

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



